রূপক চট্টোপাধ্যায়
মনসিজকে লেখা প্রলাপ
আমি শুধু এই একপ্রস্ত জীবনকে
বাগিয়ে বাগান করতে চেয়েছিলাম
মনসিজ, তুই তো জানিস!
আমি চেয়েছি নাবিক বিজ্ঞান টেনে টেনে
জাহাজ চালিয়ে দিতে সামুদ্রিক ভাসান নগরে।
আমি চেয়েছি জীবন বিছিয়ে দিতে পৌষের
চন্দ্রতাপে। চেয়েছি ঘুমিয়ে যেতে মহুয়া নেশায়,
শুধু শিয়রে লণ্ঠন করে জ্বেলে দিতে অরুন্ধতী!
আমি চেয়েছি, তৃতীয়া চাঁদের বাটি হাতে
বসেথাকা ফুটপাত কিশোরীর কাছে
নতজানু হয়ে আমার প্রার্থনা শোনাতে।
আমি চেয়েছি, তুলসীতলা, পঞ্চ প্রদীপ,
শঙ্খধ্বনিতে, জেগে থাকুক
চৌকাঠ প্রতীক্ষা করুণ চোখের কোন!
তুই তো জানিস মনসিজ,
ঠিক যেভাবে নৌকা হয়ে যায়
বৈষ্ণবীর গান ভোরের ফেরিঘাটে!
মরামাছেরডাঁই থেকে
একটি রূপোলী স্বপ্ন উড়ে এসে
লেগে যায় মেছুনীর চোখে। টলমল করে পারদ উত্তাপ....
আমি শুধু এটুকুই চেয়েছি মনসিজ।
এর বেশি কিছু চাওয়ার ছিলনা নিরাপত্তা বাতি
এর বেশি কিছু দেওয়ার ছিলনা শ্বেতপত্রে
এর বেশি কিছু লড়াই ছিলনা অসম বণ্টনের
এর বেশি কিছু অন্ধত্ব ছিলনা ধর্মীয় পতাকায়
তুই তো জানিস মনসিজ,
অবন্তিকা আমায় কতটা ভালোবাসার ঝুঁকি নিয়েছিলো,
অবন্তিকা আমায় কতটা ঘৃণা করার
মরণ পন করেছিলো।
অবন্তিকা আমায়
কতটা উত্থান দিয়েছিলো পোড়ামাটির দেশে!
অবন্তিকা আমায়
কতটা ঠেলে ফেলেছিলো চূড়ান্ত চূড়া থেকে অতল নরকে!
তার পরেও আমি বাগানটা ঠিক বাগিয়ে নিতে চেয়েছি। যুবক দেবদারু, লাজুক ডালিম, ধূসর কাঠবাদামের আড়ালে স্বযত্নে
ডুবিয়ে দিতে চেয়েছি আমার বাউল বিকেল গুলি!
সাধের কলিজা বাজিয়ে গেয়ে উঠেছি রামপ্রাসাদি,
মন রে কৃষিকাজ জানোনা.... বুকের পাঁজর তখন
হারমনিয়াম হয়ে হাঁপাচ্ছে, লালা ঝরছে, লোক
তীব্র স্বরে আমায় গালি দিচ্ছে। ক্ষমা ঘেন্না
ছুড়ে মারছে একে একে,
আমার অন্তরা সঞ্চারী গুলিয়ে
শেষে শব্দ বমি হচ্ছে, হাহাকারের
ভোর তখন পূর্বপদে একক রক্তিম!
আমি তখন রাতের পাপ মুছে,
গা থেকে মরা তারা কণা আর
মল মূত্র বীর্য ধুয়ে, সূর্য স্নানে
ডেকে উঠতাম মোরগদের নকল স্বরে।
এসব কেউ টের পেতনা মনসিজ,
কেউ টের পেতনা আমার হাতসাফাই,
কেউ টের পেতনা আমার বুকের
শ্লেষ্মা টানে বয়ে চলা ঝড়।
কেউ টের পেতনা আমার, আনাহারের
মাথায় উলঙ্গ হয়ে বসে বসে হা জীবন
প্রেত সাধনা ;
আমি, আমার এই একপ্রস্ত জীবন নিয়ে
দশের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছি, মনসিজ
কেউ বলেছে, যান কাঁসাই জলে ভাসিয়ে দিন
কেউ বলেছে, পূন্যের নিমিত্তে বিলিয়ে দিন
কেউ বলেছে, বসিয়ে দিন সর্ষে ক্ষেতের মাঝে
শতাব্দীর কাকতাড়ুয়া করে।
কেউ বলেছে হাততালি দিতে দিতে
ভিড়িয়ে দিন কিন্নরদলে, ট্রেনের কামরায়।
কেউ বলেছে হরদম মিথ্যার ফানুস জ্বলে
জনতার মাঝে লেগে যান ভোট ভিক্ষুক।
আমি, কারও কথা শুনিনি মনসিজ
আমার কারও কথা বোঝায় ক্ষমতা নেই,
শুধু অবন্তিকা, এক ঝটকায়
বুঝে ফেলতো আমার সমস্ত অরিগামি ভাঁজ!
বুঝে ফেলতো আমার কণিষ্ক জীবনে
আর মুন্ডুর খোঁজে মিলবে না কোনো দিন।
বুঝে ফেলতো আমার শান্তির পতাকা ওড়ানো
ছাড়া, আর কোনো পদক্ষেপ নেই।
উঁটের মতো গলা বাড়িয়ে
মরুচর্চা ছাড়া আর কোনো ক্যাকটাস নেই।
নেই সেই গাঁয়ের মোড়, নীলাম্বরী বধূ,
পৌষের মেলা, হরিচৈনি, বিধুমাস্টারে লাঠি,
দুধেল গাই, কালো মেঘ বাছুর, শিলাবতির বালি,
কাশের অনন্ত দোলন, ধানের সোনালী সমুদ্র
বিধবা দুখি পিসির চায়ের দোকান
মনসার থানে বসে চৈতালী রাতে
সপ্তরথী মাঝে
নিজেকে খোঁজার দূরবীন।
নেই রথের চাকা তোলার মতো বাবা
অন্নাভাবের ঘোমটা টেনে
অন্নপূর্ণা মা। একঝাঁক পায়রা পুরাণ।
তবুও তো জীবন আছে মনসিজ
হয়তো অবন্তিকা নেই
তবুও তো হত্যাকারী আছে মনসিজ
হয়তো অবন্তিকা নেই
হয়তো ঈশ্বর আছে মনসিজ
তার বাগান খানি নেই
তবুও তো স্পন্দন আছে মনসিজ
আমার বেঁচে থাকা নেই।
হয়তো সূর্যোদয় আছে মনসিজ
কিন্তু আজ আমার পূবদিক নেই।
কোনো দশদিক নেই মনসিজ!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন