মেঘনা রায়
তখন বিশ্বজোড়া উষ্ণায়ন ছিল না। ছিল না স্লিম ফিটের পোশাকি সচেতনতা। তেমনই ছিল না ডিক্যাথলন বা নর্থ পোলের হাতছানি। বাঙালির শীতকাল কবেই বা পারদ পতন দেখেছে এযাবৎ কালে!
কবেই বা আবহাওয়া দপ্তর ঠিক করেছে বাঙালির রোদ পোহানোর দিন? যেদিন থেকে পাড়ার মোড়ে ফের কেউ হাঁক দিয়ে গেছে চিঁড়ের মোয়া,মুড়ির মোয়া,,,সেদিন থেকেই শীত উদযাপন শুরু।
ভোরবেলা একটা পাতলা সরের মত কুয়াশা ঘিরে ধরত সদ্য শস্যনিঃসৃত ফাঁকা মাঠ, বাঁশ বাগানের মাথা , নিশ্চুপ রেলস্টেশনের সমান্তরাল রেললাইন, রাস্তার দুই ধারের নয়ানজুলি, কমলা সূর্যটা ঢেকে ঢেকে যেত । শীতকাতুরে ফিঙে কিংবা কাক বসে থাকত ল্যাম্পপোস্টের কালো তারে। শিশিরে শিশিরে ভিজে যেত নিকানো উঠোন, তুলসী মঞ্চ। বাঙালির ঐতিহ্যের অনেক কিছু তামাদি হয়ে গিয়ে ও রয়ে গেছে চিকণ চালের ভাত,পিঠে পুলি,পায়েস, কীর্তন ভাটিয়ালি, মসলিন— আর সনাতন জল বাতাস। শীতের বুড়ি ছোঁয়া রোদ্দুর জানলার ভাঙা শার্সি দিয়ে ঢুকে পড়ে জুবুথুবু ক্যানভাসে।এই শীত বিষন্ন। নিঝুম দ্বিপ্রাহরিক গৃহস্থালি তে মন খারাপের মতো ঘুরে বেড়ায়। তবু আজও রিক্ত, নিঃস্ব খন্ডিত বাংলার দিগন্ত প্লাবী হাহাকারে কে শীতের উষ্ণতা দেয়?সেই কুয়াশা কলোনি অজ্ঞাত। লন্ঠন হাতে মেঘ জানালায় শীতের কুয়াশার অভিমান রেখে যায়।
শীত এখন বাঙালির প্রতি সদয় বলতে হবে; মেরে কেটে এক মাস একটু চিল চিল ভাব। তারপর ই পাঙ্খা চালু। আমাদের ছোটবেলায় যেটুকু শীত পড়ত,এখন তার ধারে কাছে পড়ে না। "কুয়াশা যখন" টাইপ নামের টিভি সিরিয়াল শীত নামক এই ফেক নিউজের সিজনে চলত একমাত্র শীত স্মৃতি কে তোলপাড় করার জন্য। তবু আমাদের এই এলেবেলে শীত কে আবাহন করার জন্য কত কিছু। কাগজে পড়ি শীতের আগমনে বিলম্বের জল্পনা —হিমালয় থেকে যাত্রা পথে কতশত বাধা,। আরও ঝাড়া দুসপ্তাহের অপেক্ষা অফিসিয়াল উইন্টার এর জন্য। অপেক্ষা তে সারা শরীর জুড়ে রক্তপাত, হাজারো প্রশ্নের বর্শামুখ খুঁচিয়ে চলে অবিরত গুড়ে গন্ধ হবে কি? পনেরোর নীচে নামবে তো পারদ? ওরা কাশ্মীর রাখতে দেবে কি?নিউ ইয়ার্স ইভের পার্টি তে কী পোশাক অঙ্গে তুলবো? শীত তার উত্তেজনা, ওম, ভয়, কাঁপুনি সবটুকু নিয়ে আমাদের আদুরে গা জাপটে জড়িয়ে নিরুত্তর ।
একবার দার্জিলিং এর ম্যালে বসে নজর করেছিলাম, ক্লক টাওয়ারে ঢং করে বিকেল চারটে বাজার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক অলিম্পিকের সিনক্রোনাইজড সুইমিং এর মতো অন্তত জনা ছয়েক বাঙালি গৃহিণী একসঙ্গে ব্যাগ থেকে মাঙ্কি ক্যাপ বার করে পরিয়ে দিচ্ছেন সলজ্জ স্বামীর মাথায়। আমরা বান্ধবীরা কিছুটা তার্কিক হয়ে উঠেছিলাম গৃহপালিত স্বামী কে টুপি পরাচ্ছ ! কিন্তু আজ বুঝি কত কিছুই আছে যা বাঙালির মাঙ্কি ক্যাপের কবোষ্ণ আদরে আগলানো। সেই সময় আজকের সুপার কুল ডুডদের মতো ব্র্যান্ডেড বিনি হুডি দোকানে কিনতে পাওয়া যেত না। কোথাও তখন সোয়েটশার্ট? ,ফ্লিস জ্যাকেট,? পার্কা?
মাঙ্কি ক্যাপ,সোয়েটার কিনতে হলেও একমাত্র ভরসা ছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ারে সার বেঁধে বসা ভুটিয়ারা।
নলেনগুড়ের রসগোল্লা সেজেগুজে দোকানের ট্রে তে শুয়েছে মানে শীত নেমেছে কড়াইশুঁটি কচুরির পাশে। বাড়িতে বাড়িতে চলছে ফুলকপির সিঙাড়া বানানোর তুমুল এক্সপেরিমেন্ট।
তবে হ্যাঁ শীতের অনেক আগে থেকেই সোয়েটার বানানোর ধুম পড়ে যেত পাড়ায় পাড়ায়। সেখানে ও ডিজাইনের সেটিংস, চোরাগোপ্তা কম্পিটিশান চলতো মা কাকিমাদের। শ্যামবাজারের ফুটপাতে হাজারো উলের সম্ভার,গম গম করছে ন্যাশনাল ভ্যারাইটি স্টোর। বিভিন্ন নম্বরের কাঁটা, থ্রি প্লাই, ফোর প্লাই উল,ডবল নেটিং, সোজা উল্টো, ঘর ফেলা, উল্টো সোজা,সোজা উল্টো বুনট, হাই নেক, প্রতিটি বিশেষণ যেন শীতের পিছু ডাক ! শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদে তুমুল স্পিডে চলছে মা কাকিমাদের সোয়েটার বোনা ছাদের আসরে । এর মধ্যে যদি এক আধটা বিয়ে বাড়ি থাকে তো আরও সোনায় সোহাগা।,যে ব্যাক্তির জন্যই সেই সুচারু শিল্প দক্ষতার সাথে একটি নিটোল রূপ পাবে তার কাঁধের মাপ আর লম্বার মাপ নিতে নিতে এমন অবস্থা হতো যে তিনি উল কাঁটা দেখলেই পলায়নে প্রবৃত্ত হতেন। শঙ্করী প্রসাদবসু অতুলনীয় ভাষায় আমাদের শুনিয়েছেন ইডেনে শীতের দুপুরে রমণীয় টেস্ট ক্রিকেটের আসরে অখন্ড মনোযোগে গ্যালারিতে মহিলাদের সোয়েটার বুনে চলার কথা। এখন হয়তো পেট্রোনাইজিং মনে হচ্ছে কিন্তু বিগত দিনের কলকাতায় বিগত দিনের ক্রিকেটের বর্ণনে অনবদ্য ছিল।
আমাদের কিশোরী বেলায় শীতের শুরুতে তোরঙ্গ থেকে বের হতো লেপ, কম্বল, শেয়াল রঙা আলোয়ান। শীতের রোদ্দুরে পা ঠেকিয়ে গল্প-দাদুর আসর,লুডো, চাইনিজ চেকার। আণ্ডাবাচ্চা সবাই মিলে পিকনিক, সার্কাস, চিড়িয়াখানা। বাজারে তুমুল গরম হেঁকে দার্জিলিং কমলা আর জয়নগরের মোয়ার রেশারেশি,,তখন কার সেই,,,, তাই এবার বর্ষণ স্নাত শীতের আফুর দুপুর পেরিয়ে কুয়াশা যখন শীতের খোঁজে পথে নামে।
আমাদের প্রজন্মের জীবনে আমাদের মনের ষড়ঋতুর আনাগোনা নিয়ন্ত্রণ করতেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সেই কলমের ডগায় তার আশ্চর্য কুহক নিয়ে শীত আমাদের শরীর ও মনে চারিয়ে দিত প্রসন্ন প্রসার। নকশিকাঁথার মতো বিচিত্র এক পৃথিবী ছিল আমাদের । এখন ও সেই মাটি,গাছপালা একই আছে কিন্তু লম্বা শ্বাস টেনে দেখি শীতের সকালে কুয়াশা ভেজা বাগান থেকে যে রহস্য ময় বন্য গন্ধ পাওয়া যেতো তা যেন কবেই উবে গেছে। কিন্তু তাও আমনে সামনের চলতি পথে পরখ করে দেখি বনতুলসীর ওপর ভোরের শিশিরের সোঁদা সোঁদা গন্ধ তা কী একই আছে? মফস্বলের বড় বড় ফাঁকা মাঠে সকাল সন্ধ্যায় সাদা তুলোর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকতো একান্ত কুয়াশা। কোনাকুনি সেই ছায়াপথ চিরে চলে যেতাম টিউশন নিতে স্যারের বাড়ি।শীতের সন্ধ্যায় সেই পথে কিছু দামাল ক্রিকেট পিটিয়ে ঘরে ফিরত। তাই আমাদের ছোট বেলায় হেমন্তের লম্বা হাইফেন অনুভব হলেও শীত ছিল শান্ত নিরুপদ্রব। তার অগ্রসঞ্চার নিয়ে এত্ত মাতামাতি ছিল না। ভাই ফোঁটার পর স্কুল খুললেই আস্তে আস্তে বাতাসের ত্বকে শীতের শিরশিরানি টের পেতাম।
পাতা খসানোর সরসর শব্দ তো আগেই পৌঁছে গেছে আমলকী বনে। ফাঁক ফোকর দিয়ে দেখতাম এক নতুন ঋতুর জন্য তৈরী হচ্ছে মধ্যবিত্ত সংসার।পুরোনো ট্রাঙ্ক থেকে, স্টিলের আলমারির মাথায় রাখা গন্ধমাদন প্যাঁটরা থেকে বেরোতো লেপ, খেস, সোয়েটার, মাফলার, চাদর, কাশ্মীরি শাল, উলেন স্টোল। গ্রামগঞ্জের মফস্বল শহরের পুরোনো পাড়ার পুরনো বাড়ির আলসে তে লাল শালুর লেপ রোদ খেতো পোষা বেড়ালের মতো। সেই ছাদেই এক পিঠ চুল রোদে শুকাতে শাড়ি পড়া দিদি। হেলান দিয়ে বই হাতে কমলা লেবু খেতো। এই পুরো দৃশ্য জুড়ে যেন কমিউনিটি যৌথযাপনের কৌমজীবনের অনুষঙ্গ ছিল। শীত কে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করার হাজারো মজা কে অনায়াসে উপভোগ করতাম আমরা। প্রতি বার আমাদের শহরে অতিথি ছিল কোনো না কোনো সার্কাস পার্টি। তাদের বাঘ,হাতি গন্ডার, রিং মাস্টার, সাইক্লিস্ট,পরমা সুন্দরী জিমন্যাস্ট আর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে মাথা তুলে দেখা সেই ট্র্যপিজের আর্টিস্টরা । বড়দিনে দিকে দিকে চড়ুইভাতি বা বনভোজন যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই বনভেজন। পাড়ার সব কাকু,কাকিমা,দাদা দিদি সমবয়সী বন্ধু দের সাথে বাস ভাড়া করে একটু দূরে গিয়ে সারা হতো।
ক্লাসরুমের বাইরে যে শিক্ষা পেয়েছি তাতে এইসব পিকনিকের অবদান ও কম ছিল না। কিন্তু মনে চিরস্থায়ী দাগ রেখেছে উচ্চমাধ্যমিকের ঠিক আগে নবদ্বীপের গঙ্গা বক্ষে মায়াপুরের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছিলাম কিছু বন্ধু বান্ধবী নৌকায় করে। প্রবল শীতের ঠকঠকানির মধ্যে ও গমগম করে উঠেছিল ট্রানজিস্টারের স্ট্যাটিক আর ইডেনের তরঙ্গায়িত পুষ্পেন সরকারের গলায় কমেন্ট্রি। ম্যাচের চতুর্থ বলে গাভাস্কার শূন্য রানে আউট। ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ শোকাহত বন্ধুদের একটা ভয়ানক চেঁচামেচি সামলাতে সামলাতে দেখি ভাগীরথীর বিপুল বিস্তারের মধ্যে মাঝ নদী তে কুয়াশা আর কবোষ্ণ রোদ পরস্পরের সাথে মাখামাখি হয়ে উলম্ব বিন্দু স্পর্শ করছে।
সেই শীতবেলা ছাইচাপা দুঃখ নিয়ে চিনচিনে ব্যথা হয়ে রয়ে গেছে। রেসের মাঠের যে ঘোড়া টা সবার পিছনে একা একা দৌড়ে গেল এক্ষুনি সেই ঘোড়া টার মতোই অলস মন্থর শীতকাল আজও কী নামে বাঙালির ময়দানে।
আজকাল সকাল সাড়ে ছ'টায় উঠে জ্যাকেট, মাফলার, স্নিকার পায়ে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়ে দেখি,জীবন সংগ্রামে জর্জরিত মানুষেরা ছেঁড়া সস্তার সোয়েটার আর মাঙ্কি ক্যাপ পরে তাদের চ্যালাকাঠ আর জং ধরা টিনের ডালা গুলো খুলে আদা পিষছেন, বা খোসাসুদ্ধ দাগি আলু কাটতে শুরু করেছেন। কোথাও লিট্টি সেঁকবার আগুনেই হাত গরম করার চেষ্টা চলছে। ফুটপাতে এ সবের মধ্যেই পড়ে থাকে জরাজীর্ণ ভুষো কম্বলে আপাদমস্তক মোড়া ইতস্তত বডিব্যাগ,আর কাঠকুটো কার্ড বোর্ডের প্রাত্যহিক বেডরুম ভেঙে উঠে বসে সকালের প্রথম বিড়িটি ধরায় আধপাগল উলোঝুলো হোমলেস সান্টাক্লজ। পায়ে পায়ে চলে আসি ফুটপাতের বাজারে সেখানে ভোর তিনটে তিপ্পান্নর লোকাল ধরে শহরে এসে বিবিধ প্রাকৃতিক বেগের টুঁটি চিপে আনাজ বিক্রি করে দৈনিক একশো ত্রিশ টাকায় সব্জী মাসি । আনাজ বিক্রি করে ফ্রিতে বিকোলাই — ইকোলাই ইনফেকশন অর্জন করেন মধ্য বা বৃদ্ধ বয়সী মাসিমা।বরফ শীতল হৃদয়ে নির্মম হাসি নিয়ে দরাদরি করি ; শীতের ব্রকোলি,রেড ক্যাবেজ,
সেলারি আর পার্সলিপাতা কিনে ঘরমুখো হই। সন্ধ্যায় ভিনিগ্রায়েট ড্রেসিং মাখিয়ে স্যালাড খাব বলে। এই ছিঁচকে শীত কে উপেক্ষা করে আমার দেশের অগুনিত সংগ্রামী মানুষ অপেক্ষা করছেন অবস্থান করছেন। যুঝে চলেছেন পার্ক সার্কাসে,শাহিন বাগে।কত মানুষ এগিয়ে এসে খাবার অন্ন তুলে দিয়েছেন। মানুষের উষ্ণতা কী শীতের প্রকোপ কমিয়েছে? হয়তো একটু হলেও পার্ক সার্কাসের তাঁবুর ছাদ আটকেছে বরফ শীতল শিশিরের আক্রমণ। সব যে বুঝতে পারি তা নয় তবে দরিদ্র মানুষের জন্য শীতের এই সমবেত প্রর্থনা বিফলে যাবে না।
স্যাঁত স্যাঁতে ভিজে ঘরে ফুরফুরে সোনালী রোদ উড়িয়ে আনে একটা আস্ত খেজুর রসের ভোর। রেডিও স্টেশন খোলার সেই সুরের মধ্যেই টিপ করে ছুড়ে দিয়ে কুয়াশায় মিলিয়ে গেল পেপার ওয়ালা।রান্নাঘর জুড়ে লিকার টিয়ের সুঘ্রাণ, শীতের কুয়াশা ডোরবেলে প্রথম টিপ দিল যে..
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন