সোমা কুশারী

 


দেহজকুসুম


প্রাণপনে ঘাম ঝরাচ্ছে ঈশিতা। স্পট জগিং করতে করতে দরদর করে ঘামছে! থামলে চলবে না! একদম না! এখনো পঁচিশ মিনিট সাইক্লিং আর স্ট্রেচিং আছে। পাশাপাশি আরও ছজন জগারে উঠেছে তীব্র গতিতে হাঁটছে...

শাওনাটা নেওয়ার পর কেমন একটা ঝিমঝিমে ঘুম এসে যায়। একটু আরামসে পাশবালিশ বাগিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করে। উপায় কৈ? স্কুটি বাগিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরেই ছত্রিশরকমের কাজ। যুবরাজকে ডেকে ডেকে তুলতে হবে, গ্রিনটি বসিয়ে হালকা হাতে ডাস্টিং। তারপর ব্রেকফাস্টের আয়োজন। সেখানেও শান্তি নেই! একজন চপচপে বাটার মাখানো ব্রেড চাখবে আর অন্যজন একবাটি ওটস্ নিয়ে বেজার মুখে বসে থাকবে।


ঈশিতা একটা কনসালটেন্সিতে বিয়ের আগে থেকেই চাকরী করতো। বাবা মার আদুরে মেয়ে চিরকাল দুধে ভাতে মানুষ। খাওয়াটা যে একটা উৎসব চিরকাল তাই জেনে এসেছে। আর্সেনালের বিরিয়ানি, পিটার ক্যাটের কাবাব, মেইনল্যান্ড চায়নার চাইনিজ আর পিৎজাহাটের নানান আকর্ষণীয় পদ ঈশিতা খেয়ে খাইয়ে খুশি হয়েছে বরাবর। বন্ধুরা মিলে শুধু খেতে যাওয়ার মধ্যে একটা আলাদা চার্ম খুঁজে পেতো ওরা। বাড়িতেও মা বাবা দুজনেই মস্ত রাঁধুনী।ঝালে ঝোলে অম্বলে বেড়ে ওঠাটাকেই স্বাভাবিক জানতো ঈশিতা।

যুবরাজ ছিপছিপে সুপুরুষ। পেশায় একজন সি এ। সম্বন্ধের বিয়েতে মেয়ের ডিগ্রি আর পেডিগ্রিটাই মুখ্য বলে বোধহয় ঈশিতা মোটাসোটা গোলগাল চেহারাটা অতকিছু আলোচ্য হয়ে ওঠেনি। নাকি রুপের চেয়ে যুবরাজ আর ওর বাবা মা রুপোর প্রতি বেশী মনোযোগী ছিলেন? এখন মাঝেমাঝে ঈশিতা কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে। সেই যে বৌভাতের সকালে ভাত কাপড়ের সময় পিসতুতো জা হেসে হেসে বলেছিল...

-যুবি! ভাতটাত একটু কমই খাইও বৌকে!
খুড়তুতো ননদাই চোখের বিশেষ ইঙ্গিতে শালাবাবুকে বলেছিলেন...
-পাশবালিশের খরচ বেচে গেল কী বলো?
যুবরাজ হেসেছিল। তবে, বিকেলে রিসেপশানের লেহেঙ্গার সাথে ওড়না ডেপিং করছিলো পার্লারের যে মেয়েটা শাশুড়িমা তাকে বেশ কড়া গলায় বলেছিলেন...
-ঈশার কোমর কিন্তু বেশ ভারী! খেয়াল রেখো।

তারপর গোটা সন্ধ্যে ধরে ফটোগ্রাফারের নানান নির্দেশ আর নতুন আত্মীয়দের ফিসফাসে ঈশিতা টের পাচ্ছিল মোটা মেয়েদের চেহারাটা বড্ড চোখে পড়ে। ঐ যে ব্লাউজ আর লেহেঙ্গার ফাঁক দিয়ে উত্তল অংশ ওতেই কৌতুক মেশানো হাসি ছিটকে আসে খানিকটা কৌতুক আর অনেকটা করুণাও থাকে।


ফুলসজ্জার রাতেও যুবরাজের আচরণে ঈশিতা টের পেয়েছিল অনেকটা অনীহা, ছিপছিপে তন্বী বান্ধবীদের এর আগে কখনো বিশেষ মনে হয়নি সেদিন মনে হয়েছিল। শরীর জুড়ে ঐ খাঁজগুলো যদি না থাকতো... মামাতো বোন রাহীর কথা মনে পড়ছিল... 
-বুটুনদিদি তুই তো এমনিতেই সিক্সপ্যাক!পিঠ পেট দেখেছিস কখনো আয়নায়? 

সেদিন মামাবাড়ির আইবুড়িভাতের মটনকষাটা কিন্তু বিস্বাদ লাগেনি। রেওয়াজিমাংসের স্বাদ চেটেপুটে নিয়েছিল আর আজ! যুবরাজ কেমন একটা বিব্রতমুখে ঘনিষ্ঠ হলো। প্রথম মিলনের সেইসব অতিকথনগুলো মুছে গেল দ্রুত।

ময়ূখকে ভালো লাগতো কলেজে। হাসিখুশি স্মার্ট ময়ূখ ঈশিতার দেওয়া ট্রিটগুলোতে জমিয়ে খেত, মজা করত হাসতো... ঈশিতার মনের কথা কী জানতো না? একশোবার জানতো... কিন্তু এগোতো না। ঈশিতা টের পেত একলা ময়ূখ ঈশিতার কাছ থেকে পালাতে চাইতো! জড়িয়ে পড়তে ভয় পেত।

চারবছর হতে চলল ঈশিতার বিয়ে। রাজারহাটের এই ফ্ল্যাটেই আগাগোড়া ওরা দুজন। শ্বশুরশাশুড়ি সেই পৈতৃক বাড়ি বারাকপুরে মা বাবাও একরকম দূরেই, গড়িয়ায়। দুজনের সংসারে বড়সড় ফাটল নেই হয়ত তবে মনের বাঁধনটাও খুব বেশি শক্তপোক্ত নয়। অফিসিয়াল পার্টিতে বন্ধুদের গাদারিং-এ ঈশিতার কোম্পানি যুবরাজ ঠিক পছন্দ করে না টের পায় ঈশিতা। ডায়েটিশিয়ান বদলে তেল মশলা ছেঁটে নানান ভাবে সে এই ভারি শরীররটার ভার থেকে প্রাণপনে নিজের দাম্পত্যটুকু বাঁচাতে চায়। শুধু রবিবারগুলো একসাথে খেতে বসলেই ঈশিতার মনে হয়, যুবরাজ যেন ঈশিতার প্লেটের দিকে আড়ে আড়ে নজর রাখছে। একদিন তো বলেই ফেলেছিল...

- ডোন্ট মাইন্ড! তোমার প্লেটে ভাতের পরিমাণ দেখলেই দিদার একটা কথা মনে পড়ে যায় বিড়াল ডিঙোতে পারবে না! 

মণীষা, ঈশিতার স্কুলবেলার বন্ধু। দুজনের মধ্যেকার সম্পর্কটা স্বচ্ছ জলের মতো। ঈশিতার এই যুবরাজকে খুশি করার জন্য দিনের পর দিন তেল ছাড়া চিকেন স্টু আর সেদ্ধ শাকপাতা সোনা মুখ করে খাওয়া আর আমাজন থেকে ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে প্রোটিন সাপলিমেন্ট কেনা দেখলেই ক্ষেপে লাল হয়ে যায়, রেগে কাঁই হয়ে বলে...

-তোর শরীরটা কী বিয়ে করেছে বলে ঐ লোকটার প্রর্পাটি? ইডিয়েট! এরকম করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাঁচতে ঘেন্না করে না তোর? 

ঈশিতা কিছুতেই বোঝাতে পারে না, যুবরাজের মানসিক অত্যাচারের কথা। এমনকি মিত্তির বাড়ির নানান পারিবারিক অনুষ্ঠানে তাকে যে কী কী শুনতে হয় বলতে গেলেই ঈশিতা খেঁকিয়ে ওঠে...

- এই তোর শিক্ষিত শ্বশুরবাড়ি? চুপ কর! নিজে রোজগেরে হয়ে যে মেয়ে এসব পাত্তা দেয় তাকে আমার জাস্ট করুণা হয়!

ঈশিতা বোঝাতে পারে না, মণীষার কোথায় ভুল হচ্ছে! ছেড়েছুড়ে বেরিয়ে আসার পক্ষেও এই চেহারা নিয়ে বিদ্রুপ যে কত দূর্বল যুক্তি মা বাবার সাথে কথা বলেও বুঝতে পারে ঈশিতা, মা পর্যন্ত বলে...

-আজকাল তো কত কী হয়েছে! টিভিতে দেখি তো, কতরকম ব্লেট, মেশিন ওষুধ ওসব ঠিকমতো ইউজ করলেই তো পারিস মা!

বাবাও কম যায় না! এদিক সেদিক থেকে অজস্র উদাহরণ খুঁজে এনে বলতে থাকে কে কে কী কী ভাবে রোগা হলো।

যুবরাজের মা আবার বছর খানেক ধরে ইস্যু নেবার জন্য উত্যক্ত করে মারছেন। ঈশিতা নিজেও দু - একবার যুবরাজকে বলে দেখেছে বিশেষ কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। অফিসে মেঘাশ্রীদি চন্দ্রিমা রাধাশ্রীরা যেচে পড়ে পরামর্শ দিয়ে চলেছে বিয়ে হওয়া ইস্তক, আর তাতে ফোড়নের মতো সবসময় লেগে থাকে ওজন কমানোর পরামর্শ।আর টোটকার তো শেষ নেই লেবুজল,জিরের সরবত, লাউয়ের রস, এ্যলোভেরা জুস কত কী যে খেয়ে চলেছে ঈশিতা! ফল বলতে ঐ আধ কেজি বা এককেজি! শাশুড়িমার ঐ একই টপিক নিয়ে ফোনে টানা এপিসোড মুখ বুজে শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে মনে হয় দেয় বলে...
-কথাগুলো আমাকে না বলে ছেলেকে বলুন! ইস্যু তো আর শপিংমল থেকে কিনে আনা যায় না! লোকটা ও কালেভদ্রেও এগোয় না! 

ছ'মাস আগে বাধ্য হয়ে শাশুড়ির তাড়নায় তার সঙ্গে গাইনোকোলজিস্ট ডক্টর কুনাল রায়কে দেখাতে গেছিল ঈশিতা। নানান টেস্ট করে আর রিপোর্ট দেখে সব নর্মাল পেয়ে তিনি শাশুড়িকেই যুবরাজকে চেম্বারে আনতে বলেছেন। মায়ের বাধ্য ছেলে তার জবরদস্তিতেই বাধ্য হয়ে চেম্বারে আসতে রাজি হয়েছিল , ডাক্তারবাবুর প্রশ্নের এটা ওটা উত্তর দিতে দিতে স্পষ্টত কনজুগাল লাইফের প্রশ্নে ঝুলি থেকে বেড়াল বেড়িয়ে এলো, উর্বর দিনগুলোতে মিলিত হলেই ফল পেতে দেরী হবে না শুনেই যুবরাজ মিত্র কিন্তু কিন্তু করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেলল... 

- একটা কথা ছিল... ডাক্তারবাবু মানে আমি ঠিক আপনাকে বোঝাতে পারছি কিনা জানি না...ওর ঐ ভীষন ভারি চেহারাটা মানে ঠিক ঐ সময়ে আই এম নট কমফর্টেবল উইথ হার!এ্য লিটিল বিট্ নার্ভাস! 

খুব ভেঙে পড়েছিল ঈশিতা, অপমানে চোখ মুখ জ্বলছিলো। ফেরার পথে মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিল যে যাই বলুক সত্যিই বেরিয়ে যাবে এই সম্পর্কের দায় থেকে। মনের সাথে অনেক লড়াই করে একাই আরেকদিন এ্যপার্টমেন্ট করে চলে গেছিল ডাক্তার কুণাল রায়ের কাছে। মধ্যবয়স্ক ডাক্তারবাবু মন দিয়ে শুনেছিলেন সবটুকু, ভিজিট নিতেও রাজি হননি। ঈশিতার মনে আছে, জীব জগতের বংশবৃদ্ধির দৃষ্টান্ত আর ব্যাখা দিতে দিতে মানুষের প্রবৃত্তি ছুঁয়ে অনায়াসে ঢুকে পড়েছিলেন তাদের মনোজগতে। বলেছিলেন...

- ইস্যু নেবে কিনা সেটা তোমার চয়েজ! তবে হেরে যেও না। নিজেকে সুন্দর ভাবো নিজেকে ভালোবাসো।

গত ছ'মাস ধরে সেই অসাধ্য সাধন করছে ঈশিতা, জিম করে ডায়েট চার্ট মেপে চলে। যুবরাজকে অবশ্য বুঝতে দেয় না। কাজের মেয়ে দেবীকে দিয়ে রোজ যখন যুবরাজের জন্য নিত্য নতুন লাঞ্চ রান্নার ফরমায়েস করে বুকের ভেতরটা সত্যিই টনটন করে। তবু চোখ বুজে টিফিনক্যারিয়ারে নিজের জন্য ট্যালট্যালে ডালিয়া বা ওটস্ ভরে নেয়। সেদ্ধ ডিম আর সেদ্ধ চিকেনের টুকরোতে সামান্য বিটনুন আর গোলমরিচ ছড়িয়ে রোজ যখন খিদের মুখে খায় তখন আজকাল আর চোখ ফেটে জল আসে না শুধু চোয়ালদুটো শক্ত হয়।

জুম্বা ডান্সের ফাঁকে, স্ট্রেচিং করতে করতে পিলাইটিসের কেরামতি শিখতে শিখতে ঝরঝরে লাগে নিজেকে ঈশিতার। দেহের ওজন আর মনের ভার কমে যায় যেন! ঢলঢলে কুর্তিগুলো গায়ে ঢুকিয়ে পেটের মাপ নিতে নিতে আপনমনে হাসে ঈশিতা, ফোঁটা ফোঁটা ঘামের নোনতা জলের সাথে ভেসে যায় যত তির্যক মন্তব্য...

-তোমার পিঠে ও দুটো কী ঈশুদি?

-তোমার পেটটা দেখলেই মনে হয় তুমি ক্যারি করছ!

-ইশ! বিরিয়ানি ভালোবাসো? যা ক্যালরি খেও না! ফেটে যাবে! 



রাত বিছানায় মোবাইলের মৃদু আলোয় ঘরটা যেন আজ একটু বেশিই রোমান্টিক আর কোজি অনেক অনেক রাত পরে যুবরাজের গলায় আজ কেমন একটা ঘোর...

-ঈশু! সত্যিই তোমাকে বেশ লাগছে কিন্তু! এই জিমটাতে অনেকেই দারুণ রেজাল্ট পেয়েছে শুনেছিলাম...

দুটো পুরুষালী হাতের আগ্রাসন আর অনিবার্য কিছু ইঙ্গিত সচেতনভাবে উপেক্ষা করে ঈশিতা পাশ ফিরে শোয়...

-সকাল সাড়ে পাঁচটায় আমার ওয়ার্ক আউটের টাইম, যুবরাজ! আই নিড প্রপার রেস্ট!

ঈশিতার সজাগ অনুভূতি টের পায় যুবরাজ কেমন যেন ছটফট করছে,অস্থির পায়ে ব্যালকনি-তে গিয়ে দাঁড়ায় অচেনা যুবরাজ মিত্র লাইটারের আগুনে জ্বলে ওঠে সিগারেট। 

ভীষন আরাম পায় ঈশিতা,হালকা চাদরটা টেনে নেয় শিরায় শিরায় অদ্ভুত একটা ভালো লাগা অবশ করে দেয় ওকে, মনে মনে বলে ডাক্তারবাবু ঠিকই বলেছিলেন নারীকে অর্গাজম দেওয়ার সাধ্য গড়পড়তা পুরুষের কই ? অনেকটা ভালোবাসা আর নির্ভরতার রসায়ন না মিশলে শুধু শুধু দেহ বিনিময় করে কী লাভ? অমৃতের জাতকের আগমন অত সোজা নয়! 

কাল সকালেই মণীষাকে ফোন করতে হবে! একজন ভালো ল-ইয়ার দরকার!




মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য