সৌমী আচার্য্য

 


আমি, নিরুমালা আর রেসিংসাইকেল

নিরুমালার সাথে আর কখনো দেখা হবে না এই সত‍্য মনে নিতে বহু রাত পার করেছি।  সময়কাল ভুলে যাবার মতো বয়স আমার এখনো হয়নি তবু কিছু মানুষ সময়কালের ঊর্ধ্বে কেবল জ্বলজ্বলে জীবন্ত স্মৃতি হয়ে রয়ে যায়। উচ্চ মাধ‍্যমিক দিয়ে ব‍্যাঙ্গালোরে মেজমাসির কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম।   সেই যাত্রাপথের গল্প অবস্মরণীয় সেগল্প বলা কঠিন তারচেয়ে নিরুমালার চকচকে কালো মুখের সরলতা,অভিব‍্যক্তি লিখে যাওয়া সহজ।

ইউক‍্যালিপ্টাসের গন্ধে,বৃষ্টির ছাঁটে,লালমাটির আকুল আহ্বানে আমি ভোর হতেই দোর খুলে নেমে এসেছিলাম জঙ্গলে। ঐদিন প্রথমদিন এরপর প্রতিদিন আমি নেশাগ্রস্তের মতো ছুটেছি। প্রথমদিনেই নিরু চমকে দিয়েছিল আধা হিন্দি আর তামিল বা তেলেগু মেশানো বাক‍্যে।আমি বুঝেছিলাম ও বলতে চাইছে, "খালি পায়ে জঙ্গলে এসেছো কেন? আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছুটছো কেন?  ইউক‍্যালিপ্টাস গাছ জড়িয়ে ধরছো কেন?" অত প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।

-আআআমিইই মানে এখানে কালকেই এসেছি।

-কিন্তু এখানকার সাপ গুলো পুরোনো, আর কাঁটাগুলোও। কার ঘরে এসেছো? যাও জুতো পরে এসো।

এরা কোয়ার্টারকে,বাড়িকে ঘর বলে। নিরুর বয়স কত? কি জানি? বোধহয় আমার সমান। নিরুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে ভোরের ঠান্ডাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ভালোবেসেছিলাম আরো অনেক মুহুর্ত।


এক সদ‍্য তরুণ প্রথম পরিচয়ের বাঁধা পেরিয়ে তার লাল রেসিংসাইকেলে রোজ বিকেলে কালো পিচ রাস্তা বর্ণিল করে তুলতো। গা ঘেঁষাঘেঁষি দুটি কিশোরী বিভ্রান্ত। এ ওর হাত অবলম্বন করে মনের জোর বাড়ায়। লাজুক কন্ঠে 'শোনো'শুনে বেহাল দুটি সুকুমার হৃদয়। তরুণের চোখ স্পষ্ট, নির্দিষ্ট। নিরু ম্লান হেসে বলে, "তোকে ডাকছে"। ব‍্যাঙ্গালোরের প্রকৃতি দারুণ অভিমানী যখন তখন বৃষ্টি ঝরায়। বৃষ্টিতে ভিজে জামা কাপড় তুলছিল নিরু। কাছে পৌঁছ দেখলাম বৃষ্টি সেখানেও। নিরুর ভাবনা ছিলো তার রঙ বুঝি বেইমান। আমার ধারণা ছিল মন বেইমান।

নিরুদের ঘরে এমন কিছু একটা গন্ধ ছিল যা আমি ব‍্যাখ‍্যা করতে পারবো না তবে এখনো অনুভব করতে পারি। নারকেল তেল, কারিপাতা, সর্ষে আরো অনেক কিছু মিলিয়ে একটা চিটচিটে গন্ধ। আমার খুব ভালো লাগতো বুকের কাছে হাঁটু টেনে বসে থাকতাম। নিরুর বিশ্বাস ছিলো ওর জীবনে কখনো উড়ান আসবে না। কাটিপতঙ্গ ওর প্রিয় শব্দ। আমি যতটাই স্বপ্নে বিভোর ও ততটাই মাটি আঁকড়ে চলে। মাটিতে আছড়ে পড়লে আমার কোমড় ভাঙে, ডানা ভাঙে, নিরু ভাঙেনা, পড়েনা কেবল হেঁটে যায়। রুক্ষ্ম লালমাটিতে একা। একদিন পরিচয় করায় ডিউটি ফেরৎ নিজের দাদার সাথে।

-খুব মজা হবে তুই যদি আমার বৌদি হোস।এখানেই থাকবি একসাথে কলেজে পড়বো।

আমি হাসি, মনের কথা সহজে বলার মতো সরলতা আমার নেই। তারচেয়ে সাইকেলে করে পুরো ব‍্যারাক চক্কর দিতে সাধ বেশি। ব‍্যাটেল শ‍্যূট পাহাড়ে চড়ে বসি একদিন। সাথে ছিল মাসির মেয়ে আর মেসো। পাহাড়ের মাঝ বরাবর একটা ঝুলন্ত পাথর। তার উপর থেকে বিস্ময়কর সূর্যাস্ত দেখার পর আর কোথাও ফিরতে মন চায়নি। আমার সত্ত্বার এক টুকরো এখনো সেখানেই বসে আছে। একদিন সবার চোখ এড়িয়ে সাইকেলে যেতে চেয়েছিলাম সেখানে কিন্তু পথে জুড়ে দাঁড়িয়েছিল রেসিংসাইকেল।


আমি বিচলিত ভীত কিন্তু আনন্দ কিছু কম নয়। তার গোঁফের আলতো রেখায় ডিফেন্সের কড়া শাসন। বাইরে যাওয়া যাবে না বরং সেই সাথে করে নিয়ে যেতে পারে। রাজি না হয়ে প‍্যাডেলে স্বাধীনতা অটুট রেখে এগিয়ে যাই। দীর্ঘ সময় রাস্তা আমাদের নৈঃশব্দ শুনেছে আমার শুনেছি বনের ভেতরের গান। মাসির কোয়ার্টারের কাছে এসে অনুমতি বা বিদায় সম্ভাষণ ছাড়াই পথ হঠাৎ আলাদা হয়েছে। কি যেন এক ব‍্যথায় সে ডেকেছে, "শোনো এমন নীরব চলাও অর্জন। একে তুচ্ছ ভেবোনা।"


আমি মনে মনে হেসেছি। নিরুকে বলতেই আকাশে মেঘ করে এসেছে। দৈববাণী হয়েছে, "ভিন্ন ভাষার প্রেম টিঁকতে পারেনা। দুদিন পর সম্পর্ক বোবা হয়ে যায়।" আঙুলে নতুন বন্ধুত্বের কাঁচা সুতো জড়িয়ে বলেছি, "তবে যে বৌদি করতে চাইছিস খুব? আমি তো চলতে ফিরতে কবিতা বানাই তাও বাংলায়।" নিরু গম্ভীর হয়েছে। আড়ি ভাবের দোটানায় আমিও ব‍্যস্ত হয়ে পড়লাম ভ্রমণে। অনেক অপরিচিত, অর্ধ পরিচিত মানুষের সাথে চললাম মহীশূর। মাসিই পাঠালো। ভাইবোনেদের পরীক্ষা তাই আমি একাই পাখা মেললাম। ভোরে যাওয়া ফেরা রাতে। টাটাসুমোতে যখন উঠলাম তখন আকাশে হালকা আলোর আভা কিন্তু আমি হতবাক। গাড়ির পিছনের সিটে রেসিংসাইকেলের মালিক। মুখে দুষ্টু হাসি। আমি চুপ। এমনকি ব্রেকফাস্টেও চুপ। যাদের সাথে গিয়েছি সবাই প্রায় দক্ষিণী খাবারে অভ‍্যস্ত। আমি তখন খাবি খাচ্ছি। চঞ্চল চোখ অজানা আশঙ্কায় মাটি ফুঁড়ে লুকিয়ে গেছে। হঠাৎ সামনে এগিয়ে এল ঘিয়ে চুপচুপে রাঙা টুকটুকে কাজু কিসমিসে মাখামাখি মিহিদানা। আমি যে কিছুই খাইনি তাই এই আয়োজন। সারাদিন টিপু সুলতানে ডুবে রইলাম। এদিকে কারো মন জ্বলছে টের পাচ্ছি ভীষণ রকম। আমি অসহায়। 'ভিন্ন ভাষায় প্রেম আজ যতই কথা বলুক একদিন বোবা হয়ে যায়।' মাথার উপর চেপে বসেছে এই শব্দগুচ্ছ। নিরু আমার উপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে তা টের পাই বৃন্দাবন গার্ডেনে গিয়ে। সেই অধ‍্যায়ের সবটুকু আমার কাছে আজো এক স্বপ্নের ইতিবৃত্ত তবে প্রতি মুহূর্তে পিছন ফিরে দেখেছি যেন নিরুর অদৃশ‍্য দৃষ্টি আমায় ছুঁয়ে রয়েছে। আমাকে নিয়ে যতবার কেউ মুগ্ধতা জানিয়েছে, আমার খেয়াল রেখেছে আমি ততই অসহায় বোধ করেছি। জনারণ‍্যে একা হয়েছি। অস্ফুটে উচ্চারণ করেছি, "নিরু আমি তো চাইনি তবু সব পাল্টে যাচ্ছে কেন?"


গভীর রাতে হুহু করে ছুটে চলেছে টাটাসুমো। পেরিয়ে যাচ্ছি অচেনা শহর। যে শহরে আর কখনো ফিরবো না হয়তো। চাঁদ উঠেছে, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মধ‍্যে দিয়ে পাল্লা দিয়ে ছুটছে চাঁদ। আমায় ছুঁয়ে যাচ্ছে নব‍্য যুবক তার গানে। " চাঁদ সে পর্দা কিজিএ কহি চুরানা লে চহেরে কা নুর"...ঘুম বড্ড ঘুম। মাথা ঠুকে গেছে জানলায় আবার ঘুমিয়ে পড়েছে চাঁদ। ঘুম ভেঙেছে যখন তখন কারো হাতের রেখায় নিজের মাথা খুঁজে পেয়ে বিরক্ত হয়েছে কিশোরী, অথবা রাই কিশোরী হয়েছে মুহূর্তে। রাতের গভীর অন্ধকারে ভেসে ভেসে উড়ে গেছে মন।

সময়রেখা বহু মানুষকে নিয়ে এসেছে জীবনে। সকলকে বোঝা হয়তো সম্ভব ছিলো না। তবে ঐ মুহূর্তে দুটো মন আমি বুঝতে পারছিলাম। নিরুমালাও বুঝতে পারছিলো। তার দীর্ঘদিনের পছন্দের পুরুষ হুট করে উড়ে এসে জুড়ে বসা মেয়ের দিকে প্রবল বেগে ছুটছে। কিন্তু এরা দুজনাই জানতো না আমি কোথাও ছুটছি না। কেবল ভালোবাসছি এই নতুন পরিবেশ, এই মুক্তি আর এদের সবাইকে। তবে একটা অঘটন ঘটেছিলো। যেটা আমি চাইনি। সেদিন বিকেলে একাই সাইকেলে চলেছি টেলিফোন বুথের দিকে। অফিস ফেরৎ চোখ আমায় ঠিক খুঁজে নিয়েছে। রেসিংসাইকেল তখন উড়োজাহাজ। আকাশে মায়ারঙ। দাঁড়ানোর অনুরোধে থেমে গিয়ে কথা বলেছি সহজ ছন্দে। তারপর সরাসরি প্রস্তাবে ভূমিকা ছাড়াই বলেছি, 'নিরু যে পথ চেয়ে আছে।'  হতবাক বিস্ময়ে বলেছে সে, "আমি তো কখনো কিছু বলিনি। ভাবিওনি, কেবল প্রথম তোমাকেই..." আমিও অনড় 'সে তো হয়না।' পিছন ঘুরতেই দেখি সাইকেল নিয়ে অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে নিরু। ওর চোখ রেসিংসাইকেল এর হাতের দিকে।যে হাত আমার সাইকেলে।

-নিরু যাসনা,দাঁড়া নিরু।

আমি ডাকি নিরুকে আমায় ডাকে কেউ। সময় ভাসে স্রোতের মতো। হারিয়ে যায় সব। আমার বাড়ি ফেরার দিন এসেছিলো নিরু। জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলো, বলেছিলো, "আমার জন‍্যে তুই যে পথে গেলি না, সে পথ আমার চিরতরে বন্ধ। তুই আমায় ভুল বুঝিস না।" শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম বুকে। রেসিংসাইকেল সেদিন বাইক কিনেছে সদ‍্য।  একবার বলেছিলো, "শুধু একবার এইবার, শেষবারের মতো আমার বাইকে বসো পৌঁছে দি।" আমি বারবার না বলতে বলতে ক্লান্ত। যাবার সময় নিরু সামনে আসেনি। বাসটা যখন ইয়ালাঙ্কা ছেড়ে স্টেশনের পথ ধরছে শেষ পর্যন্ত দেখেছি আমার পরিচিত মানুষদের। অনেকে এসেছিলো আমায় পৌঁছে দিতে। ঝাপসা হয়ে যায় দৃষ্টি, হারিয়ে যায় মানুষ। আর কখনো যাদের দেখা যায় না তারাই চিরকাল মনের ভেতর রূপকথা বুনে চলে।





মন্তব্যসমূহ

  1. চমৎকার লেখা। খুব নিবিড় স্মৃতিচারণ। এক টুকরো ভ্রমণকথা-- লাল রেসিং--টিপু সুলতান আর নিরুতে মিলেমিশে এক আত্ম মন্থন যেন। চিত্রকল্প অসাধারণ। এ হল গল্পকারের বর্ণনা। এ তো শুধু গদ্য নয়, এ হলো গল্প-গদ্য।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য