সুস্মিতা সাহা
হৈমন্তী বিকেলের গল্প গাছা
হৈমন্তী - ১
এই তো আলোর নাচন খানি পাতায় পাতায় সবুজের মেলায় শরতের ছুটির খবর দিচ্ছিল।
এবার এসেছে হেমন্ত। শস্যের সুবাস উঠছে মাঠের ভরা ক্ষেত থেকে।
পূর্ণ চাঁদের মায়ায় পিছু ফিরে ডাকছে বারবার ফেলে আসা সময় - চলে যাওয়া শৈশব - কৈশোর - যৌবন...
একলা একটি সাদা টগর ফুটে উঠলো সেদিন ছোট্ট মাটির থেকে একটু বেড়ে ওঠা গাছটিতে।
ক'দিন একলা একলা - একদিন হঠাৎ দেখি ওর পাশে আরেকটি নতুন ফুল।
দোসর জুটে যায় সকলেরই
শুধু কেউ কেউ চিরকাল নিস্তব্ধ বালুচরে একা একা
কোজাগরীর চাঁদ দেখে।
হৈমন্তী- ২
এমন এক গোলমেলে পরিস্থিতিতে ফেলে দিলেন তিনি যে কি বলবো! জলের নরম ঘ্রাণ পাচ্ছেন - ঘাসের উপর মাথা রেখে শুয়ে ঘাসের রস চুমুকে চুমুকে পান করতে চাইছেন - লম্বা পথ হেঁটে চলেছেন তো হেঁটেই চলেছেন।
তিনিই তো চেনালেন কার্তিকের গর্ভবতী মাঠের সৌন্দর্য - অনায়াসে 'বিয়ানো' শব্দ প্রয়োগ করে নিজেকে এবং পাঠকদের বিপদে ফেলে দিতে পারেন।
একটা সময়ে নষ্ট শশা পচা চালকুমড়ো লিখে খুব জোরালো নিন্দা শোনেন আর তারপর কিছু যদি থেকে যায় তাঁর কাছে তা হোলো হেমন্তের গান।
কার্তিকের পড়ন্ত বেলায় নবান্ন খেতে বসে কাকের দল- গড়ে ওঠে অন্য রকম ভাষা ও ভালবাসা কবিতার।
কি যে মুশকিলে ফেলেন তিনি!
আচ্ছা দিদিমণি, মিনারের মতো মেঘ?
বেতের ফলের মতো ম্লান চোখ?
কথা বলতে পারা সবাক পাণ্ডুলিপি?
দিদিমণি দিব্যি টরটর করে উত্তর দিতে থাকেন।
শুধু নীরবে রয়ে যায় মোটাসোটা পাণ্ডুলিপি - দীর্ঘ কাজের পরে প্রাপ্ত গবেষণার ডিগ্রি ঠিকঠাকই আসে বাড়িতে কিন্তু সেই মুখটি হারিয়ে যায় চিরতরে। এমনই হেমন্তের শেষ বেলায় হিম হিম ঠান্ডায় তোমার কাছে না বলা থেকে যায় এই সব পাওয়া না পাওয়ার কথা।
জীবনানন্দ - তাঁকে নিয়ে কাজ হোলো - নেশা জাগলো তাঁর লেখায় - Dr. উপাধি হোলো,
শুধু তুমিই দেখলে না।
হৈমন্তী বিকেলে বড্ড মন কেমন হয় যে।
শুনছো,বাবা?
হৈমন্তী - ৩
একেকটা নিম্নচাপের - ঝোড়ো হাওয়ার দিন আসে শীতের মুখে মুখে।
একদম বোরিং, ডিপ্রেশন ঘিরে ধরে আমূল গ্রাস করে নিতে চায় টুঁটি চেপে ধরে। তার মধ্যেই চিন্তা থাকে খিচুড়িতে ফুলকপি পড়বে কতোটা? ভাজা মুগের ডাল একটু বেশি দিলে ভোগের সুবাস ওঠে।
মুসুর ডালের সঙ্গে যায় পেঁয়াজি, হাঁসের ডিমের মোটুসোটু মামলেট। কাঁচা লঙ্কা কুচি ঝাল ঝাল।
আর ভাজা মুগডাল দিয়ে রান্না হলে একটু বেগুনি, পটল আলু ভাজা, গাওয়া ঘি অল্প খানিক।
খুব ঘ্রাণ ওঠে জানেন। ঘ্রাণ নেই পেট পুরে, মন ভরে। দৌড়ে দৌড়ে জামাকাপড়ের বোঝা ঘাড়ে করে এঘর ওঘর করতে থাকি। এ বোঝা নামাই কোথায়? শীতের বৃষ্টিতে যে ফ্যান চালানো যায় না।ঘর জুড়ে একটা ভেজা জলের গন্ধ ওঠে। তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় পাঁপড় ভাজা ও গোবিন্দভোগ আতপ।
উফ্ফ একজন ছিল বটে, একটা ভোট কম্বল, মোটা উলিকটের গেঞ্জি পরে বসতো পুঁথি পত্তর খুলে। মাঝে মাঝে একটু ভক্তিগীতি। আর উঁকি মেরে মেরে দেখে নিতো কলেজ পড়ুয়া কন্যে বস্তাপচা সিরিয়াল গিলছে না তো?
মেয়ে আর মানুষ হোলো না রে।
লেপের গরম শুধু আরামই দিতে জানে না- জানে আরো অনেক পুরোনো গল্প জমাতে।
জমুক তাহলে...
হৈমন্তী - ৪
শীত আসবো আসবো করছে- কিন্তু ঠান্ডার আমেজ নেই। তাতেই তো পা ব্যথা - গলা খূশখুশ- মন উসখুস।
শীতে মনও উসখুস করে বুঝি?
কিসের জন্য ঠিক বুঝলাম না তো।
এই ফুলকপির বড়া খাওয়ার জন্য,
এই মেথি শাকে মুচমুচে বড়ি ভাজা ও বেগুন শিম দিয়ে রান্না করে খাওয়ার জন্য,
ধনেপাতা দিয়ে লাউ ঘন্ট আর তাতে ছোট ছোট টাটকা ট্যাংরা মাছ।
শিম বেগুন দিয়ে কালোজিরের ঝোল - তাতে আর মাছ চলতেই পারে। বড়ি মাস্ট।
কুমড়ো ফুলের বেসনে চুবিয়ে বড়া খাচ্ছি বেশ ক'দিন ধরে।
ও হ্যাঁ, নলেন গুড়ের রসগোল্লা - সন্দেশ ও মাখা সন্দেশের কথা আবার বলতে লাগে নাকি?
সেদিন ঘোষের দোকানে নতুন গুড়ের ছানার মুড়কি দেখলাম।
উফ্ফ জাস্ট জমে যায় - তাই না?
শুধু মাঝে মাঝে গন্ডগোল পাকায় পেটুক ক্ষেন্তিরা,
নারকেলের মালায় করে একটু কোরানো নারকেল খেতে পেয়ে কি যে খুশি ও।
পাটিসাপটা পেলে তো আর কথাই নেই।
''যেমন ভাবে হোক্ মেয়ে পার করো তো। জ্বালাতন যতো।''
২০২১ চলছে চলবে - কথাগুলো কিন্তু সেই এক রয়ে যাবে।
কিছূ কিছু পাল্টায় না, না?
খেজুর রস তো তেমনই।
হৈমন্তী - ৫
ক্ষত মুখগুলি আরো বেশি করে শুকিয়ে ওঠে শীত পড়লেই।
পা ফাটতেই থাকে- সুন্দরী সহকর্মীর পাশে বসলেই মোজা পরতে হবে মনে পড়ে যায়। ম্যানিকিওর প্যাডিকিওর করলে হয় বেশ।এইসব ভাবতে ভাবতে খড়ি ওঠে গায়- ঠোঁট জোড়া ফেটে চৌচির।
মাথার চুলে নারকেল তেল মাখলে একটু জৌলুস ফোটে বটে কিন্তু সে তো জমে বরফ।
বরফ - বরফ- বরফের চাঁই একেবারে। অথচ কোথায় কোথায় নাকি হিমবাহ গলছে ক্রমাগত।
সুরভিত অ্যানটিসেপটিক বোরোলীনের ফুরিয়ে যাওয়া কৌটোটা পুরোনো বালাপোষের মধ্যে এখনো খুঁজলেই পাওয়া যায় অবিশ্যি।
আর কি? এক ফোঁটা বোরোলীন - আর অনেকটা নস্টালজিয়া মেখে সেঁধিয়ে যাই সিদেঁলের মতো গর্ত খুঁড়ে মমতার উষ্ণতা বের করে আনতে।
এই তো শীতের মায়া।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন