অমিতাভ দাস


শ্মশান-বন্ধু



 শেষবার দেখেছিলাম তাঁর বাড়িতে।ডিসেম্বরের অলস মন্থর এক বিকেলবেলায়। দু'কামরার সেই ঘর। পলেস্তারা খসা, রঙহীন সেই ঘর।নিজেই চা করে নিয়ে এলেন।চা খেতে খুব ভালোবাসতেন। কেউ গেলেই নানারকম চা খাওয়াতেন। আমার কয়েকবার সে সৌভাগ্য হয়েছে। চা নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও অধ্যয়ন ছিল।বৌদি বলতেন: চা-বাতিক।

     বৌদি গত হয়েছেন বছর দশ। তারপর একমাত্র মেয়েই শ্বশুর বাড়ি থেকে এসে বাবার দেখভাল করত। আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল না। ছোট্ট একটা কাজ করতেন-- দোকানের খাতা লেখা। শেষকালে কিছু টিউশন। বয়স্ক মানুষের কাছে আজকাল ছেলেপুলেরা পড়তে আসতে চায় না। তাছাড়া তিনি কোনো স্কুল-কলেজের টিচার তো ছিলেন না।আজকাল ভালো পড়ানোর থেকেও বেশি জরুরী যিনি পড়াচ্ছেন তিনি কোন স্কুল বা কলেজের টিচার এইটে জানা।
      বছর দুই আগে হঠাৎ করেই মেয়েটাও মারা গেল। সেই আঘাত আর সহ্য করতে পারলেন না কমলেশদা। একা হয়ে গেলেন। একটু বেশিই চুপচাপ। কমলেশ ভৌমিক। বাংলা সাহিত্য জগতের এক বিশিষ্ট নাম। ' সাহিত্যের আলো' পত্রিকার সম্পাদক। প্রতিবাদী চেতনার মানুষ। সারাজীবন মানুষের অধিকার ও দাবীর কথা বলে গেলেন। প্রথম জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করলেও পরবর্তীকালে সরে আসেন। তবে তিনি আদর্শের ফাঁপা বুলি আওড়াতেন না কখনো। জীবনে ও কাজে করে দেখাতেন। মেনে চলতেন নিজস্ব কিছু ধ্যান-ধারনা।
       আমরা পরবর্তী প্রজন্মের লেখকরা তাঁর স্নেহ-সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম। চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে ' সাহিত্যের আলো' পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন।
       সুভদ্র মার্জিত, নিচু স্বরে কথা বলা একজন মানুষ। সর্বদা ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি, এমনকী ধুতি-পাঞ্জাবি পরতে দেখেছি।  মন ভালো থাকলে পান খেতেন। সাদা পান--চবন মৌরী এলাচ দেওয়া। আমাকেও তিনি এই পান খাওয়া শিখিয়েছিলেন। তখন আমার কলেজ জীবন। সদ্য লিখতে আসা এক তরুণের প্রতি কী তাঁর স্নেহ-ভালোবাসা! কত যত্ন করে লেখার ভুলগুলো শুধরে দিতেন। সংশোধন করতেন লেখার দুর্বল অংশ।
      রঞ্জন ডাক দিল। নিমতলা শ্মশানে তখন সারি সারি মৃতদেহ সাজানো। ডোম বললে,' এইবার আপনাদের আনা বডি চুল্লিতে যাবে'। বডি কথাটা শুনেই কেমন যেন বিরক্ত লাগল। আমরা বলতাম,' কমলেশদা।' সদা হাস্যময় লোকটা চলে যাচ্ছেন চুল্লির ভিতর। তিনি এখন বডি। দেখলাম চুল্লির দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
      অনেকেই জানেই না, কমলেশদা চলে গেলেন। করোনা পেশেন্ট।দেখতেই তো দেয় না। তবু রঞ্জন সরকারী ডাক্তার বলে শেষবার দেখার সুযোগ পেয়েছি।ওই তো ভর্তি করে দিয়েছিল সরকারী হাসপাতালে। সাতদিন লড়াই করে শেষে আজ ভোরে চলে গেলেন। 
    আটাত্তর বছরের একটা নিঃসঙ্গ মানুষ। দেখার কেউ নেই। তবে কমলেশদা নিজের কাজ নিজেই করতেন। শক্ত-পোক্ত লোক ছিলেন। আমরা কয়েকবার আর্থিক সাহায্য করেছিলাম মাত্র। বৃদ্ধভাতা পেতেন নিয়মিত। সরকারী চাল-ডাল-আলু। ' তিনি তো বাড়ি থেকে খুব একটা বেরতেন না' , বললে রঞ্জন। ' কীভাবে যে করোনা হল কমলেশদার!'
--'তিনি নিজেও জানেন না হয়ত। শুনেছি সকাল-বিকেল গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসতেন এইটুকুই।'

'--এখনো চল্লিশ-পয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগবে। চল চা খেয়ে আসি'। বললে রঞ্জন। প্রায় লকডাউন চলছে। তবু কিছু কিছু দোকান খোলার সুযোগ দিয়েছে সরকার। তাই চা খাওয়ার সুযোগ হল। 
      চায়ের দোকানে ঢুকতেই বৃষ্টি নামল। কয়েকদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে। আঙুল দিয়ে দেখালাম--'দু-কাপ চা।' আমরা গিয়ে চা দোকানের ভিতর কাঠের বেঞ্চে বসলাম। চা চলে এলো।
    'এবার তো ঝেঁপে বৃষ্টি নামল'। বললে রঞ্জন। । সে আমার স্কুলবেলার বন্ধু। কবিতা লেখে। আমরা দু-জনেই ছাত্র বয়স থেকে কমলেশদার বাড়ি যেতাম। ও এখন এই শহরের বেশ নামকরা ডাক্তার। লেখে। বড় বড় কাগজে লেখে। আমি এখনো লিটিল ম্যাগাজিনেই লিখি। কালেভদ্রে বড় কাগজে লেখা ছাপা হয়। আমার লেখা রঞ্জন পড়ে কিনা জানি না। তবে কমলেশদা পড়তেন। ফোন করতেন। শুভেচ্ছা জানাতেন। আলোচনা হত।
--'কী রে চুপ করে আছিস', আমার দিকে তাকিয়ে বললে রঞ্জন।
--'না এমনি। ভাবছিলাম।'
--'কী'?
--'মনে আছে আমরা প্রথম যেদিন কমলেশদার বাড়িতে যাই, সেদিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল। '
--'চা-মুড়িমাখা খেয়েছিলাম। খুব মনে আছে'। বললে রঞ্জন।' একটা সৎ মানুষ চলে গেলেন। লোকটা সারাজীবনে কিছুই পেলেন না।'
চায়ের ভাড়টা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে দিয়ে সিগারেট ধরালাম। রঞ্জনের দিকে এগিয়ে দিলাম।বললাম,'কী হয় সাহিত্য করে? সাহিত্য, পত্রিকা করা একটা নেশার মতোন। এই নেশাতেই ডুবে থাকতেন কমলেশদা। পত্রিকা তো বিলি-বন্টন করে দিতেন। কেউ দাম দিলে নিতেন। চাইতেন না হাত পেতে। বৌদি বলতেন, অনেক তো পত্রিকা করলে এবার ক্ষ্যামা দাও বাপু।'"
--'ঠিক বলেছিস। আবার দ্যাখ, এই বৌদিই নিজের সোনার বালা একবার আমাদের কাছে দিয়ে বলেছিলেন: লোকটা পাগল। পত্রিকা ছাড়া বাঁচবে না। এবার পুজো সংখ্যার টাকা জোগাড় হয়নি তাই মনখারাপ। তোমরা এইটে বেঁচে টাকা জোগার করো। বলবে না যে আমি দিয়েছি।বলবে, তোমরা সংগ্রহ করেছ।' বলতে বলতে রঞ্জন কেমন যেন উদাস হয়ে গেল। সিগারেট হাতেই রয়ে গেল।
      কেন জানি না এই সময় আমার চোখে জল এলো, এতক্ষণ তো আসেনি। আবেগে মানুষের চোখে জল আসে। বললাম,' বৌদির মতো মানুষেরা সারাজীবন আড়ালেই থেকে যান। বাংলা সাহিত্যে তাঁদের অবদানের কথা কোথাও লেখা হয় না।'
     সন্ধ্যা নেমেছে। দোকানটা এখন ফাঁকাই। দোকানদার ছেলেটা বললে, ' আরো দুটো চা দেবো বাবু ?'
বললাম, ' দাও। আদা আছে?'
--'হ্যাঁ বাবু। আদা দিয়েই বানিয়ে দিচ্ছি।'
     আবার মনে পড়ল কমলেশদার কথা। তিনি আদা চা খুব পছন্দ করতেন শীত আর বর্ষায়। একবার আমাকে আদা আনতে বাজারে পাঠিয়ে ছিলেন। 
--'ক্ষ্যাপাটে মানুষ ছিলেন।' বললে রঞ্জন।
--'হ্যাঁ রে, ক্ষ্যাপাটে ছিলেন বলেই তো একটা লেখা লিখলেই রাত-বিরেতে ফোন করতেন।

আমি একবার ' সারা বাংলা গল্প প্রতিযোগিতা'য় প্রথম হয়েছিলাম বলে কমলেশদার সে কী আনন্দ! আমাকে বাড়িতে ডেকে মাংস-ভাত খাইয়ে ছিলেন। উপহার দিয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ' প্রথম আলো' দুইখন্ড। আর্থিক অবস্থা কোনো কালেই ভালো ছিলো না মানুষটার-- তবু একটা মন ছিল।'
      ' এই রকম মানুষ আর আসবে না।' সিগারেটের অবশেষ অংশটা বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে বললে রঞ্জন। 'লিটিল ম্যাগাজিনকে একটা আন্দোলন ভাবতেন। পেলেন না কোনো সরকারী বা বেসরকারী সম্মান। নিজেও তো কত ভালো লিখতেন।'
--'ওঁর পত্রিকাতেই তো আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়।' বললাম আমি। বাইরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। কিন্তু বেরতে পারছি না। বৃষ্টি নাকি সময় কে আমাদের আটকে রেখেছে এই চায়ের দোকানে?
      ' কমলেশদার মতো মানুষের শেষ যাত্রায় মাত্র দুটো লোক। এমন একটা রোগ কেউ আসতেও চায় না। সবাই ভয় পায়। লোকজনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেছে।'
      রঞ্জনের এই কথার উত্তরে বললাম, ' করোনা না হলেও তুই আশা করিস অনেক লোক আসত আর কমলেশদাকে শ্রদ্ধা জানাত! আমার তা মনে হয় না। শেষদিকে কে খোঁজ নিয়েছে তাঁর? আমরাও তো সেভাবে তাঁর কাছে যেতাম না। আগে সবাই যেত লেখা ছাপানোর জন্য---ভালোবেসে নয়। ধান্দায়।'
    --'তা অবিশ্যি ঠিক-ই বলেছিস। ' আমার দিকে তাকিয়ে রঞ্জন বললে,'কিছু ভালো লাগছে না জানিস। একটা কষ্ট বুকের ভিতর থেকে ঠেলে উঠছে।'
    আমি ওর হাতটা চেপে ধরলাম। দেখলাম রঞ্জনের চোখ ভিজে উঠেছে।
    চা দোকানের ছেলেটি বললে,' বাবু , যা বুঝছি বৃষ্টি আজ আর ধরবে না। আপনাদের ভিজেই যেতে হবে। এখানে রাস্তায় কিন্ত জল জমে যায়, সাবধান।'
 --'আমার গাড়ি আছে।' বললে রঞ্জন। ' আচ্ছা তুই কিসে যাবি?'
--'সেসব কিছু তো ভাবিনি। সকালে ফোনটা পেয়েই দ্রুত চলে এসেছি। একটা অটো পেলাম, দিয়ে গেল।ছেলেটা অবিশ্যি বলছিল, কাজ মিটলে ওকে ফোন করতে।সেসব তো ভুলেই গিয়েছি। এই বৃষ্টির ভিতর সে কী আর আসবে? ' আমি আতান্তরে পড়লাম দেখে রঞ্জন বললে,' চল--আমি তোকে পৌঁছে দিয়ে আসি।'
--' এমন কিছু দূর নয়। আমি হেঁটেই চলে যাবো।' বলায় রঞ্জন বললে, 'ক্ষেপেছিস? কী রকম বৃষ্টি হচ্ছে দেখেছিস--কোথায় আটকে যাবি ঠিক আছে...চল, আগে শ্মশানের ফর্মালিটিস্ গুলো সেরে আসি।'
             

গলির মুখে রঞ্জন আমাকে নামিয়ে দিয়েছে কিছু আগে।রাত এখন আটটা মতোন বাজে। আমি ভিজতে ভিজতে বাড়ির দিকে যাচ্ছি। ফোনটায় চার্জ নেই।বাড়িতে সবাই হয়ত খুব চিন্তা করছে।অথচ আমার কেন যেন বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না।
     বৃষ্টির বেগ আরো বেড়েছে। এখন মনে হচ্ছে এই বৃষ্টি আরো হোক।আমাদের রাস্তাটায় জল জমতে শুরু করেছে।চপ্পলটা খুলে হাতে নিলাম।হঠাৎ কী মনে হল কে জানে--গলা ছেড়ে গাইলাম: বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান...। গানটা কমলেশদার খুব প্রিয়।তাঁর গলায় কতবার যে শুনেছি তার হিসেব নেই। আমার মনে হল কমলেশদা আশেপাশে কোথাও আছেন। তিনি শুনছেন। হয়ত এখনি বলে উঠবেন,' হল না , হল না-- এই জায়গাটায় সুরটা ঠিক হল না।'





মন্তব্যসমূহ

  1. ভালো লাগলো অমিতাভ। এরকম সম্পাদক ও সাহিত্যপ্রাণ মানুষ বিরল হয়ে আসছেন।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. হ্যাঁ দাদা, এই রকম সম্পাদকরা হারিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই এই লেখা🙏🙏

      মুছুন
  2. একেবারে অন্যরকম গল্প পড়লাম। এমন গল্প সুন্দরের থেকেও বেশি প্রয়োজনীয়। অন্তত যাঁরা সাহিত্যপ্রেমী তাঁদের কাছে।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. তুমি পড়লে, আনন্দ পেলাম। ঠিক-ই বলেছ।ভালো থেকো নীলম।

      মুছুন
  3. গল্পটা তোমার কণ্ঠেই শুনেছিলাম। বেশ ভালো গল্প।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনি গল্পের মানুষ। প্রিয় গল্পকার। আপনার মতামত সর্বদাই উৎসাহ দেয়। ভালো থাকবেন💕

      মুছুন
  4. অসাধারণ একটি গল্প। বিশেষত শেষ দৃশ্যটি কী সুন্দর আঁকা হয়েছে!

    উত্তরমুছুন
  5. এমন মানুষদের কথা আরও বেশি বেশি করে উঠে আসুক গল্পে।ভালো লাগল লেখকের লিটিল ম্যাগাজিনের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা দেখে। গল্পের চরিত্রেরাই এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে সাহিত্যের প্রকৃত জগতকে।

    উত্তরমুছুন
  6. লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের দিশারীর জীবন পরিক্রমা এমনই হয়ে থাকে।ভাল লেখা

    উত্তরমুছুন
  7. এ যেন গল্প নয়, এ যেন স্মৃতিচারণা। লেখনীর আবেগই তো পাঠককে ধরে রাখে। খুব ভালো লাগল

    উত্তরমুছুন
  8. শোনা জানা লাগছে গল্পটা! এরকম একটা বিরল চরিত্র আঁকা কঠিন কাজ। ভালো লাগল।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. গল্পটা অবগুণ্ঠনের বৈঠকে গত নভেম্বরে পাঠ করেছিলাম। তখন শুনেছিলে। তোমার ভালো লাগাটা আমার কাছে প্রাপ্তি। আনন্দের।

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য