দেবাশিস ঘোষ
রণজিৎ দাশের কবিতা : উটের চোখের জলে ভেজা অক্ষরমালা
রণজিৎ দাশের কবিতায় সবার আগে নজরে পড়ে সটান শুয়ে থাকা রোদ্দুরের লম্বা লম্বা ফালি। যত সামনে পৌঁছনো যায় সে রোদের ঝিকিমিকির ভিতরে ভিতরে সব আলো অন্ধকারের সলমা জরির কাজ। হয়তো সেইসব কাজগুলো চোখে পড়বে না একটু সন্ধানী নজর না দিলে। যা হয়ে থাকে কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতায়। বাংলা ভাষায় কবিতা লিখেছেন অনেকেই। তাদের বেশ কিছু কবির স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত স্বরক্ষেপ আলাদাভাবে নজর টানতে বাধ্য করে। রণজিৎ দাশের কবিতার উজ্জ্বল পংক্তিমালা সমুদ্রের ওপর ভেসে থাকা ফসফরাসের আবরণে ভরা কোনো প্রাণী যেন। ঘোর অন্ধকারেও দূর থেকে চকচক করছে।
নাগরিক জীবন লিখেছেন রণজিৎ দাশ। আমাদের লাজুক কবিতাকে তিনি বলেন 'ফুটপাথে শুয়ে থাকো তুমি কিছুকাল'। যদিও তাঁর কবিতা লাজুক নয়। আবার আব্রুহীন নিলাজও নয়। ঠিক ততটাই স্পর্ধা ততটাই আবরণ আভরণ মেনে চলে যতটা দরকার। সব শব্দ শিল্পির হাতেই নিজস্ব প্রয়োগকৌশল থাকে। নন্দনতত্ত্বের সামগ্রিক রীতিনীতি হাজার শব্দ শিল্পির হাতেই গড়ে ওঠে ও নতুন নতুন বাউন্ডারি ভেঙে নতুন করে সংজ্ঞায়িত হয়। আলটিমেট কিছু নেই। রণজিৎ দাশের কবিতাকেও সময়ের নিরিখে বিচার করতে হবে। তাঁর কবিতায় সার্কাস তাঁবুর পেট ফুলে ওঠে, যতীনের বোনের সঙ্গে উষ্ঞ রসায়নে ডুবুরির নগ্নছবির ভূমিকা, সাবমেরিনের ছায়া, নীল বিবাহ (স্বাভাবিক হিসেবে যদিও লাল), উদাসী সঙ, মারোয়াড়িদের জ্বালাতন, আমাদের জঙ্ঘাক্রিয়ার উল্লাস মেলে। মেলে হিজড়েদের নাচের ভিতর আমাদের জন্মের কথা। তার কবিতা ছড়িয়ে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা, বিহার, ধলভূমগড়, কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত। মোট কথা কোনও বিশেষ একটা সুরের ঘ্যানঘ্যানানি নেই রণজিৎ দাশের কবিতায়। যেমন ইচ্ছে চলতে পারার স্বাচ্ছন্দ্য দেখা যায়। আর এই কারণেই কবিতায় শব্দ নিয়ে কবি অডিট করতে বসেন নি। যেমন স্বাভাবিক কথা বলার ভঙ্গিতে ভাবনা এসেছে তাকেই তিনি শব্দরঙে কবিতায় এঁকেছেন। তার লেখার ধারার সঙ্গে হয়তো খানিক মিল পাওয়া যায় ভাস্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে। তবে সে শুধু ফর্ম এবং কিছু বাকরীতিতে। তাও সুস্পষ্ট করে বলা চলে না। চলনের দিক থেকে একটা অন্তর্লীন মিল পাওয়া যায়। তাও বড়জোর কিছু শব্দ ও কথনরীতির মিল।
রণজিৎ দাশের কবিতায় বলার ভঙ্গিটা বিশেষ নজরে দেখতে হয় এর গভীরে পৌঁছতে। 'মানুষীর মধ্যভাগ' কবিতার প্রথম লাইনটাই পাঠককে গেঁথে ফেলে নিপুণ বল্লমে। পাঠকের রক্তক্ষরণ চলতে থাকে। কবিতা শিল্পের বিকল্প ধোঁয়াটে জগত মুহূর্তেই নির্মিত হয়ে যায়। 'তোমার একান্ত আমি ধরে থাকি, অন্যপ্রান্ত নিয়ে খুব খেলা করে গন্ধমূষিকেরা' -- তোমার একান্ত, কেউ বলেনি আগে। তোমাকে একান্তে বহু বলা হয়েছে। তোমার একান্ত শব্দযোটকে তোমার এবং একান্ত এই দুইয়ে একটি অদ্ভুত আবেশ তৈরি করে। একান্ত অর্থে আমরা নিভৃতি বুঝি। সেই নিভৃত, নিতান্ত দুজনার ব্যক্তিগত মুহূর্তের বাকক্ষেপ সঞ্চারিত হয়। তারপরেই আমরা অন্যপ্রান্তের কথা জানতে পারি। সে প্রান্ত নিয়ে খেলা করে গন্ধমূষিকেরা। একান্ত অর্থে এক দিকের অন্ত এই আলোক সম্প্রপাত ঘটে যায় লাইনটিতে। ছুঁচোকে কবি তৎসম শব্দে বলছেন গন্ধমূষিক। ছুঁচো কথাটাকে গাল দিতে, অবজ্ঞা করতে, বিরক্তি বোঝাতে আমরা ব্যবহার করি। সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছুঁচোরা খুব খেলছে তোমার অন্যপ্রান্ত নিয়ে। মধ্যভাগে তুমি স্বয়ং, বিম্বানুরাগিনী, বসে থাকো তানপুরা হাতে। চলতি কথাবার্তায় মাঝে মাঝেই তৎসম শব্দের সংহতিময় দক্ষ প্রয়োগে স্মার্ট উচ্চারণ পাঠককে দাঁড় করায় নতুন নতুন পরিস্থিতির সামনে। বিম্ব -- প্রতিবিম্ব, ছবি। তুমি বিম্বের অনুরাগিনী। কবি তার মানুষীকে এইভাবেই বর্ণনা করছেন। পরে বলেন, 'স্থিতিস্থাপকতা নেই তোমার চরিত্রে, গানে'। এই লাইন অনিবার্যভাবে মনে করিয়ে দেয় মায়ের প্রতি হ্যামলেটের উক্তি -- 'Frailty thy name is woman'. হ্যামলেটের বাবাকে তার কাকা খুন করেছেন। বিয়ে করেছেন হ্যামলেটের মাকে। মায়ের প্রতি হ্যামলেটের আক্ষেপ ফেটে পড়েছে এই বিখ্যাত লাইনে।
'আরও কিছু রঙ্গ' কবিতায় মধ্যবিত্ত জীবনকে নিয়ে মারাত্মক রঙ্গ তামাশা রয়েছে -- 'যেমন কেরানি, তারা, শোনা যায়/স্বপ্নে দ্যাখে -- জল বা পাহাড় নয় -- রেফ্রিজারেটার'। আবার এমন রোপনের প্রচন্ডতাই বা কটা কবিতায় মেলে 'তোমার প্রখর চুলে গোপনে লুকিয়ে আছে সাপ, পোড়োবাড়ি/আছে ফাঁদ, আছে মায়াবী শিকড়, তারা কষ্ট পায় রাত্রিবেলা/তাদের ভীষণ খিদে, তারা ভালোবাসে শুধু সবল মুঠোর টান, ঘাম/পাউরুটি খায় তারা পুরুষের হাড়-মাংস খায়'। এই যে প্রচন্ডতা, এটাই কবি রণজিৎ দাশের। কী বলা যায় একে! মোটা দাগের ছবির মতো পেনিট্রেটিং! মোটা অর্থে আমরা স্থূলতার একটা ডিসকোর্স আগেই বানিয়ে রেখেছি বলে মোটা কথাটার নেতিবাচক অর্থকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। অনেক উঁচুতে থাকা হোর্ডিংয়ের বিজ্ঞাপনকে মোটা অক্ষরেই লেখা হয় যাতে দূরত্ব থেকেও সুস্পষ্ট পড়া যায়। তেমনি রণজিৎ দাশের কবিতায় এই grossness বাজারের হলুদ সেলোফেন পেপারে মোড়া বইয়ের grossness এর সঙ্গে মেলে না। এটা জীবনের তীব্রতা। তাকে তীব্র শব্দে ধরতে না পারলে ব্যর্থ হয় তির নিক্ষেপ।
নারীকে সুতীব্র ও নিরপেক্ষ (?) পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা ঘুরেফিরে আসে তার কবিতায়। 'নারীরা বিষণ্ণ উট। তাদের ছায়ায়/বস্তুত যা শরীরের উত্তাল সমুদ্র, তা/ স্তব্ধ মরুভূমি হয়ে যায়।' উটকে সবসময়ই বিষণ্ণ মনে হয়। উট বিষণ্ণতা বয়ে বেড়ায় দীর্ঘদেহের সামনে ছুঁচলো মুখে। অন্য কোনও প্রাণীর এমন বিষণ্ণ মুখ দেখা যায় না। কুকুর আনন্দময়, চঞ্চল। বিড়ালের সফিস্টিকেশন অতুলনীয়। গোরু প্রায়শই কেয়ারলেস। কিন্তু উটকে কখনও কেউ আনন্দরত দেখেছে বলে জানি না। সেই উটের বিষণ্ণতার ছায়ায় শরীরের উত্তাল সমুদ্র ঢাকা পড়ে স্তব্ধ মরুভূমি হয়ে যায়। এখানেই কবিত্বশক্তি। এই কারণেই রণজিৎ দাশকে পাঠ করতে হয়। পাশাপাশি রাখা যাক অন্য কয়েকটি লাইন । 'সেদিন চিড়িয়ামোড়ে, তীব্র পিপাসায়/একটি সবুজ ডাব/নারীর মুখের মতো দু'হাতে আগলে ধরে/টানা এক চুমুকে খেলাম।' এখানে সবুজ কথাটা কী অদ্ভুতভাবে একটা সেতুর কাজ করছে। সবুজ ডাব-সেতুর একপারে তীব্র পিপাসা, অন্যপারে নারীর মুখ। 'এক চুমুক' এসে দু'পারকে মিলিয়ে দিল এক অনিবার্যতায়।
দৈনিক জীবনের ছবিকে বারবার পাই তার পংক্তিতে। 'ওজন মুদির ধর্ম। সন্দেহ, তোমার। প্রশ্নাতীত বাটখারা। দুলে-ওঠা ধাতব পাল্লায় ডুবন্ত নৌকোর ছায়া।' সন্দেহ তোমার। এই তুমি কি কেবলমাত্র খদ্দের! উত্তরটা হ্যাঁ, না দুটোই। আসলে একটা পর্যায় পর্যন্ত হ্যাঁ তারপর হ্যাঁ-কে ছাড়িয়ে না-তে পৌঁছে যায়। কারণ শেষে আসে 'মুদি ও তোমার মধ্যে সম্পর্কের নিভৃত বেদনা'।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন