নন্দিতা মিত্র
প্রকৃতির চটক এখানেই
‘To
one who has been long in city pent’- কবি জন কিটস তাঁর কবিতায় সেই সব মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন যারা দীর্ঘদিন এই শহরের খাঁচায় বন্দী। শহরের কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ত সময় আর বিষবাস্পে জর্জরিত প্রাণ এক মুহূর্তের জন্য খুঁজে নিতে চায় নীল আকাশ, কলুষতাহীন নির্মল বাতাস আর সবুজে ভরা পৃথিবী। অতিমারীর এই পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি আমারও কবির মতো ছুটে যেতে ইচ্ছে হয় পাহাড়ি কোনও ছোট্ট গ্রামের অধিবাসী হতে। যেখানে নেই শহরের ধূলিমাখা বিষাক্ত বাতাস, নেই শব্দদানবের আগ্রাসী আস্ফালন।
এমনই এক সবুজের গালিচায় মোড়া জায়গা চটকপুর। মুক্তির আনন্দে আনলক পর্বে বেরিয়ে পড়েছিলাম সবকিছু উপেক্ষা করে। সোনাদা থেকে চটকপুরের রাস্তায় উঠতেই বাইরের শান্ত, নিঃঝুম প্রকৃতি আর গাড়ির স্টিরিওতে সুরের মূর্ছনা প্রাণে জাগায় আনন্দলহরী। দার্জিলিং জেলার সিঞ্চল ওয়াইল্ডলাইফ স্যাঙ্কচুয়ারির মাঝে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম চটকপুর। দার্জিলিং থেকে সোনাদার ডানদিকে মাত্র ৮ কিমি জঙ্গল পেরোলেই চোখে পড়বে এই সবুজের আস্তানা। উচ্চতা ৭৮০০ ফুট। জানুয়ারিতে মাঝে মাঝে তুষারপাতও ঘটে। সোনাদা পেরোতেই বাঁকাপথে মন হারায়। চারপাশে জঙ্গুলে গন্ধমাখা পথ ধরে এগোতে থাকি। মাঝে একবার পারমিট করানোর জন্য বিরতি। গাড়ি যত এগোতে থাকে নির্জনতাও তত আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরতে থাকে। পথ ঢেকে দেয় কখনও মেঘ, কখনও গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে এসে হামলে পড়া অবাধ্য ফার্ন। তারা আগাম জানান দেয় সামনের পথ আরও দুর্গম। হঠাৎ হঠাৎ বাঁকা পথ হারিয়ে যায় মেঘমাখা ভিজে পাহাড়ের আঁচলে।
চটকপুর যাওয়ার রাস্তা মোটেই সুখকর নয়। শেষ কয়েক কিলোমিটার তো গাড়ি প্রায় নৌকার মতো দুলতে দুলতে যাচ্ছিল। পিঠ, কোমর বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ড্রাইভার প্রবীণ ভাইয়ার অভয়বাণী ‘এই তো আর কিছুটা’। বারবার অসম্ভব ঝাঁকুনিতে মনে হচ্ছিল শেষপর্যন্ত শরীরের সব কলকব্জাগুলো ঠিক থাকবে তো? কিন্তু খারাপ রাস্তা পেরিয়ে যখন পাহাড়ের কোলে থাকা ছোট্ট গ্রামটিতে পৌঁছালাম তখন বিরক্তি আর শরীরের যন্ত্রণা দূরে কোথায় মিলিয়ে গেছে। গাড়ি যত ওপরের দিকে উঠছিল হিমালয়ের কোলে লুকিয়ে থাকা এক গোপন আস্তানা যেন চোখের সামনে ধরা দিচ্ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তা দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে। একটা গেছে আপার চটকপুরের দিকে, আরেকটা লোয়ার চটকপুরের দিকে। গাড়ি এসে পৌঁছায় এই দুই জায়গা যাওয়ার সন্ধিস্থলে। প্রথমে আপার চটকপুরের দিকে যাওয়া মনস্থির করলাম। প্রথম দর্শনেই প্রকৃতি উপহার দেয় সবুজ রঙের মলাটে মোড়া আনকোরা এক নতুন বই। হিমালয়ের কোলে থাকা এই গ্রাম ভালোলাগার, ভালোবাসার। জঙ্গল, পাখি, ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট বাক্সবাড়ি দেখতে দেখতে ঘুরতে লাগলাম চটকপুরে। আর পাঁচটা পর্যটনকেন্দ্র থেকে একদমই আলাদা এই গ্রাম। বড় শহরের গোলমেলে হট্টগোল নেই এখানে। এ পথ গাঁয়ের অপার শান্তির পথ। চারপাশে গ্রামীণ নির্জনতায় হারিয়ে যেতে থাকি। প্রকৃতির চটক এখানেই। উত্তরে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর দক্ষিণে চোখজুড়ানো সবুজ ঢেউখেলানো উপত্যকা। চটকপুরের মিঠে সৌন্দর্য উপভোগ করতে দুটো দিন এখানে কাটিয়েই দেওয়া যায়। পুরো গ্রামের ছবি যেন এক পিকচার পোস্টকার্ড।
প্রকৃতি এখানে রূপের পশরা সাজিয়ে বসে আছে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ আর তাতে সেজে আছে জানা-অজানা হরেকরকমের বুনো ফুল। জায়গায় জায়গায় গাঢ় সবুজ ঘাসের ওপর অযত্নে ফুটে থাকা হলুদ, গোলাপি ফুল এ জায়গার সৌন্দর্য স্বর্গীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ফুলে ফুলে উড়ে এসে বসা মৌমাছি আর প্রজাপতি অন্তর্জালবন্দি শহুরে মনে দোলা দিয়ে যায়। ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটায় মাত্র ২০-২৫ টি পরিবারের বাস। গ্রামবাসীরা বাঁচেন চাষবাস, পশুপালন, হাজারো রঙিন পাখি, প্রজাপতি, নানা বন্যপ্রাণী, অভাব-অনটন ও সীমাহীন সারল্যকে পুঁজি করে। পুরো গ্রামেই জৈবসার দিয়ে চাষ করা হয় বিভিন্ন সব্জির। সেই সব্জি দিয়েই অতিথিদের জন্য রান্না করা হয়।
হোমস্টেগুলো একে অপরের থেকে প্রায় ৭০-৮০ মিটার দূরে দূরে অবস্থিত। হোমস্টের সুন্দর করে সাজানো ছিমছাম ঘর, সামনের বারান্দা আর দিগন্ত-বিস্তৃত সবুজ পাহাড় এক নজরেই মন কেড়ে নেয়। গ্রামের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম চটকপুর ওয়াচটাওয়ারে। এটিই এখানকার ভিউপয়েন্ট। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে এখান থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার দর্শন পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের ভাগ্য সেদিন ভালো ছিল না। আকাশের মুখ ভার। তার সাথে সাথে আমারও মনকে বিষণ্ণতা গ্রাস করে। আমাদের এই ট্যুরে সবজায়গায় কাঞ্চনজঙ্ঘা সপার্ষদ দেখতে পেয়েছি। কিন্তু চটকপুরে সে মেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েই থাকল। থেকে থেকে হানা দিচ্ছে মেঘের দল। মেঘেদের এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে না পাওয়ার আক্ষেপ ভুলিয়ে দিয়েছিল। ওয়াচটাওয়ারের পিছনেই রয়েছে ঘন জঙ্গল। সেখানে পাখিদের সংসার। ভিউপয়েন্ট থেকে নীচের উপত্যকাকে দারুণ লাগে দেখতে। চারিদিকে ছোট ছোট বাক্সবাড়ি ছোটবেলায় সাজানো ঝুলনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। ভালোলাগার উদ্দামতাও বৃদ্ধি পায়। ঘুরতে ঘুরতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কফিপানের ইচ্ছা জাগে। কিন্তু গ্রামে কোনও দোকান না থাকায় সেই ইচ্ছেপূরণ করা যাচ্ছিল না। প্রবীণ ভাইয়া তাঁর পরিচিত এক হোমস্টের মালকিনের কাছে নিয়ে গেলেন। মালকিন সাথে সাথে ধুমায়িত কফি এনে হাজির করলেন আমাদের সামনে। দাম দিতে চাওয়ায় কিছুতেই নিতে রাজী হলেন না। বললেন- আমরা ওঁদের গ্রামের অতিথি। এটুকু আতিথেয়তা তো ওঁদের কর্তব্য। আরও একবার মুগ্ধতার পালা। ক্রমাগত নাগরিক চাহিদায় আমরা যখন নাভিশ্বাস ফেলি, তখন এই সহজ-সরল মানুষগুলো কত অল্পেতে সন্তুষ্ট। কফিপান করতে করতেই ওঁর কাছে শুনতে লাগলাম মন ভালো করা এক ভোর হয় এখানে। চোখ মেলে দেখা যায় প্রকৃতির হোলিখেলা। জঙ্গলরঙা এই ভিউপয়েন্টের মাথায় উঠে দেখা যায় এক রঙিলা ভোরের সূচনা। তবে তার জন্য অবশ্যই প্রকৃতিদেবীর অপার আশীর্বাদ থাকতে হবে। টাইগার হিলের পাশের পাহাড়টাই চটকপুর হিল। মালকিনের বর্ণনা শুনে বুঝতে পারলাম চটকপুরের সূর্যোদয় গুনে গুনে কয়েক গোল দিতে পারবে টাইগার হিলকে।
এবার গন্তব্য লোয়ার চটকপুর। গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যাই চটকপুর ইকো ভিলেজে।চারিদিকে পাইন আর ধুপির বন। নির্জন পাইনবনে জড়িবোনা রোদ কুড়োতে কুড়োতে হাঁটতে লাগলাম পায়েচলা সরু রাস্তা ধরে। শুকনো পাতা মাঝে মাঝে মর্মর ধ্বনি তোলে। ভালোলাগার জঙ্গুলে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে শিখতে থাকি প্রকৃতিপ্রেমের সহজপাঠ। আলো আর সবুজ অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয় মন। হঠাৎই চমক ভাঙায় লালরঙা বনমুরগী। খরচোখে ধরা দেয় আকাশরঙা ফ্লাইক্যাচার। স্থানীয়রা সাবধান করে দেন চারপাশ ভালো করে নজর রাখতে। মাঝে -মাঝে এখানে এখানে হানা দেয় ভাল্লুক, চিতা। এদিকটায় জঙ্গল বেশ ঘন। ভালোলাগা ক্রমেই বৃদ্ধি পায় পাহাড়ি নির্জনতায়, জঙ্গলের গভীরতায়, অচেনা পাখিদের গুঞ্জনে আর সীমাহীন রোমাঞ্চে। কারণ এ পথের জঙ্গলের গল্পও বেশ ছমছমে। এভাবেই জংলিপথে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেলাম কালিপোখরি। অর্ধেক চাঁদের মতো পাহাড়ি পুকুর। স্থানীয়দের কাছে খুবই পবিত্র। দুদিকেই সবুজঘাসের জমি। পোখরির পাড়ে থাকা পাথরকে ঘিরে আছে নানা দেবদেবীর মূর্তি। এই পোখরিতেই লুপ্তপ্রায় স্যালাম্যাণ্ডারের সংসার। তবে বর্ষাকাল ছাড়া তাদের দেখা মেলে না। যেহেতু এটা শীতকাল তাই পোখরিতেও বেশী জল নেই। চারিদিকের প্রকৃতি অপরূপ সুন্দর। পোখরির চারপাশের ঘন সবুজ অরণ্যে বেশ কিছু পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। জঙ্গলের নীরবতার মাঝে শুধুমাত্র পাখিদের কলতান শুনতে শুনতে মন ভরে গেল। ভাগ্য সঙ্গ দিলে এখানে নানা প্রজাতির পাখির দেখা মিলতে পারে। তাদের মধ্যে কারও কারও সাথে দেখা হলেও আমি পক্ষী বিশারদ না হওয়ায় তাদের সাথে ভালো করে পরিচয়পর্ব সাড়া হল না।
বেশ কিছুটা সময় এখানে কাটিয়ে ফিরতি পথ ধরি। স্থানীয়দের সাথে অনেক কথা হল। তাঁদের কাছ থেকেই জানতে পারলাম অনেকেই ব্রিটিশ আমল থেকে বংশপরম্পরায় এখানে বসবাস করছেন। কন্কনে হিমেল হাওয়া বইছে। গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। হঠাৎই দূরে এক নাম না জানা পাখি টিইইই টিইইই শব্দে জানিয়ে গেল – “ভালোলাগার রেশটুকু থাকতে থাকতে বাড়ি গিয়ে চটকপুরের ঠিকানায় একটা চিঠি লিখো”।
কীভাবে যাবেনঃ দার্জিলিং, নিউ জলপাইগুড়ি বা বাগডোগরা থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসা যায়। আবার শেয়ার গাড়িতে সোনাদা পর্যন্ত এসে এখান থেকেও গাড়ি ভাড়া করা যায়।
কোথায় থাকবেনঃ ইকো ভিলেজের ইকো রিসোর্ট ছাড়াও অনেক হোমস্টে আছে।
কখন যাবেনঃ রাস্তা খুব খারাপ থাকায় বর্ষাকাল এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
পড়তে পড়তে ঘুরে এলাম যেন এক মুহুর্তে চটকপুর। এমনিতে ভ্রমনের গল্প, তার ওপর সুন্দর লেখনী। সহজেই দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো চটকপুরের সৌন্দর্য।
উত্তরমুছুনদুরন্ত ,খুব ভালো
উত্তরমুছুন