নির্মাল্য ব্যানার্জী



শেষ অধ্যায়

"শেষে তোমারই এই পরিনতি হতে হল? হায় ঈশ্বর!!

এই জন্তু-জানোয়ার, পোকা-মাকড় সবার প্রান থাকবে আর তোমাকেই কিনা মরতে হল? এই গাছপালা, অরণ্য, এই প্রাসাদ সবই থাকবে আর তুমিই কিনা চিরতরে হারিয়ে গেলে? না না এ হতে পারে না। এ হতেই পারে না। এই এই তোমরা চেয়ে দেখো। ওর ঠোঁটটা হালকা নড়ল না? হ্যাঁ তাইতো। তাই না? কি হল তোমরা কিছু বলছ না কেন? চুপ করে আছ কেন? বল ও বেঁচে আছে। বল তোমরা। বল।" বলে চিৎকার করে বৃদ্ধ রাজার দেহটি লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। যবনিকা পতন শুরুর সাথে সাথে দর্শকদের হাততালির শব্দে গোটা প্রেক্ষাগৃহে তখন কান পাতা দায়। বৃদ্ধ রাজা লিয়ার তখনও নিশ্চল হয়ে পড়ে আছেন স্টেজের মাঝে। সমস্ত দর্শকের অভিবাদন কুড়োচ্ছেন লিয়ারের রোলে অভিনয়কারী মঞ্চের দাপুটে অভিনেতা রোহিতস্য চৌধুরী। সকলে প্রতিবারের মতোই তার অসামান্য অভিনয়শৈলীতে মুগ্ধ।


আজও হোটেল সংলগ্ন রেস্তোরাঁটি মোটামুটি ভর্তি। এর আগেও বহুবার এখানে এসছে শিখা। যখনই শিলিগুড়ি আসে,তখনই এখানে অন্তত একবার আসার চেষ্টা করে। হিল কার্ট রোডের ওপর ওর এই হোটেলটি ওর খুব প্রিয়। বিয়ের পরপরই যখন নর্থ বেঙ্গল ট্যুরে এসেছিল তখন ও আর রোহিতস্য এটাতেই উঠেছিল। বাকিরা উঠেছিল হংকং মার্কেটের কাছে একটি ছোট্ট হোটেলে। তখন ওদের নাটকের দল "বালার্ক" অত নাম করেনি। বাজেটের টানাটানি ছিল। তবুও বাকিরা ওদের হানিমুন স্পেস দিতে এই কান্ডটি করেছিল। ভাবলে আজও হাসি পায় শিখার। আনন্দে বুকটা ভরে যায়। তখন জীবনটা অন্যরকম ছিল। তখন তার পছন্দের মানুষটাও অন্যরকম ছিল। ওই স্মৃতিগুলোই সে বারবার আঁকড়ে ধরতে চায়। তাই সুযোগ পেলেই নানা অছিলায় এখানে একবার ঢুঁ মেরে যায়। অনেক কিছুই বদলে গেছে আগের তুলনায় কিন্তু আজও ও যেন একটা চেনা গন্ধ পায় এখানে এলেই। রোহিতকে ও অনেকবার বলেছে এখানে থাকার কথা। কিন্তু ওই যে সেদিনের মানুষটা আজ আর নেই, তাই সে বেশ অহং নিয়ে বলে দেয় "ওসব সাবস্ট্যান্ডার্ড হোটেলে আমি পারব না।" অগত্যা আজ স্টার হাটেলেই থাকে তারা কিন্তু সেখানকার সুইটেও শিখা সেরম পরিতৃপ্তি পায়না। আজ অবশ্য ওর আসার কারনটা অন্য। আজ ও একজনের সাথে দেখা করতে এসেছে। ওর পুরোনো বন্ধু সুবীর এখন শিলিগুড়িতে আছে। কাল রাতেই ফেসবুকে ওর স্ট্যাটাস দেখেছে - "Happy Homecoming!!!"। ম্যাসেঞ্জারে দু একটা কথা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলে শেষে কাজের কথাটা পাড়তে পেরেছে। "কাল দেখা করতে পারবি? একটু আর্জেন্ট দরকার আছে।" শিখা জানত সুবীর ওকে ফেরাবে না। কলেজে সবাই ওদের কাপল হিসেবে ধরেই নিয়েছিল। সুবীর ওকে ভালবাসত এ কথা সে বেশ জানত। শিখারও ওকে ভালই লাগত কিন্তু ও কিরম একটু কনফিউসড ছিল। তারপর ওর জীবনে আসে এই নাটকের দল। গানবাজনা, নাটক, নাচ, আবৃত্তি এসবের প্রতি শিখার এক তীব্র ঝোঁক ছিল। সুবীর ছিল পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে। এসব আর্ট আর কালচারের থেকে শত হস্ত দূরে। কিন্তু শিখাকে কোনওদিন সে বাঁধা দেয়নি। দুয়েকবার ওর গানের, নাচের বা নাটকের অনুষ্ঠানেও গেছিল ও। সেসবের কিছুই ও বুঝত না। যেত শুধু শিখাকে দেখতে। কিন্তু যেদিন ওদের দলে রোহিতের প্রবেশ ঘটল, সেদিন শিখার যেন সব তালগোল পাকিয়ে গেল। রোহিত ছিল প্রতিভাবান উঠতি আর্টিস্ট। যেমনি সুপুরুষ, তেমনই গানের গলা, অদ্ভুত আবৃত্তি ক্ষমতা এবং সর্বোপরি সে ছিল এক অসম্ভব ভাল অভিনেতা। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে ওরা মঞ্চস্থ করল "ওথেলো"। ওথেলোর চরিত্রে রোহিত আর শিখা ডেসডেমোনা। রিহার্সালে প্রতিদিন রোহিত শিখাকে ঘসটাতে ঘসটাতে নিয়ে যেত। খালি বলত "লেট লুস শিখা। ইউ নিড টু লুস কন্ট্রল অফ ইওর ফিট।" শিখা শেষদিন হেসে জবাব দিয়েছিল "ইউ গট মি সোএপট অফ মাই ফিট লং ব্যাক।" নাটকের দিন সবাই ওদের ভূয়সী প্রশংসা করেছিল। ব্যাকস্টেজে সেদিন সুবীর গিয়ে দেখে ওরা দুজন আলিঙ্গনবদ্ধ। কোনো কথা বলেনি সে। চুপচাপ ওখান থেকে চলে এসেছিল। তারপর ওদের সাথে খুব একটা দেখা করেনি। বিয়েতে এসেছিল কিছুক্ষণের জন্য। শিখা বলেছিল খেয়ে যেতে অন্তত। কি একটা অজুহাত দিয়ে চলে গিয়েছিল। তারপর থেকে কখনও ফোনে, কখনও সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা হওয়া ছাড়া আর সেরম যোগাযোগ নেই। এখন সুবীর থাকে মুম্বাইতে। এখন ও একজন সফল ব্যবসায়ী। ধনী ও ব্যাচেলর। শিখাকে আজও ভুলতে পারেনি। পুজোর ছুটিতে বাবা-মায়ের কাছে শিলিগুড়িতে এসছে। ও নিজেও জানতে পেরেছিল বালার্ক ওর শহরে এসছে। নিশ্চই শিখাও আছে। আগে তো ও সব নাটকেই বাঁধা নায়িকা ছিল। কিন্তু এখন তো ওর ও বয়স চল্লিশের কোঠায়। অভিনয়ের লাইনে মেয়েদের বয়স হয়, ছেলেদের না। তাই এখন নয় সে চরিত্র-অভিনেত্রী হয় নয়ত কাগজে-কলমে সহকারী পরিচালক। এখন ওই ক্যারোল না কি যেন নাম মেয়েটির, ও খুব নায়িকা হয়। মেয়েটি দেখতে শিখার আশেপাশেও না।অভিনয়ও নাকি আহামরি কিছু নয়। তবে বেশ একটা চটক আছে চেহারায়।

যাইহোক এতদিন পর ওর ও শিখাকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। কেমন আছে এখন? ফেসবুকে তো বেশ খুশি খুশি ছবি উপলোড করে। শরীরে গত্তি লেগেছে, বয়স হচ্ছে বোঝা যায়। কিন্তু এখনও কিন্তু মিষ্টতাটা আছে মুখে। ছেলেমেয়ে তো কিছু হয়নি যতদূর জানে। আজই বা হটাৎ ডাকল কেন? 
এসব কথা ভাবতে ভাবতেই রেস্তোরাঁর কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সুবীর। ভর্তি ঘরটায় একটু এদিক সেদিক চোখ ঘোরাল সে। একটা কোনের টেবিলে ওর দৃষ্টি স্থায়ী হল। শিখা ওকে কিন্তু দেখতে পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। মুখে সেই মিষ্টি হাসিটা লেগে আছে। সুবীরের মুখেও একটা হাসি খেলে গেল। কতদিন পর দেখছে ওকে। প্রায় ১৫ বছর পর। দুজনে মুখোমুখি বসে খানিকক্ষণ চুপ থাকল। তারপর একসাথেই বলে উঠল 

"কেমন আছিস বল?"

কথাটা বলামাত্র দুজনে আরও হেসে উঠল। শিখার খিলখিলানো হাসিটা বড় ভাল লাগল সুবীরের। বহুদিন পর এভাবে খোলামেলাভাবে হাসতে পেরে শিখাও যেন একটু সুস্থ বোধ করল। ঠিক মরুভূমিতে জল পাওয়ার মতই আজ তার জীবনে খুশি নামক বস্তুটি খুঁজে বের করা কঠিন। প্রতিটা দিন আজ তার দুর্বিষহ ভাবে কাটে। খানিক্ষণ এদিক সেদিক পুরনো কথা হওয়ার পর শিখা কাজের কথাটা উপস্থাপন করল

"তোর কোনও ভাল উকিল চেনা আছে?"

কফিতে হালকা চুমুক দিয়ে সুবীর জবাব দিল "হ্যাঁ। প্রপার্টির ব্যাপারে কিছু? ওই তোদের দত্তপুকুরের বাড়িটা বিক্রি করবি বুঝি?"

মাথাটা একটু নিচু করল শিখা। তারপর ধীরে কিন্তু স্পষ্টভাবে জবাব দিল "না। ডিভোর্সের ব্যাপারে।"

সুবীর কিরম যেন একটু অস্বস্তি বোধ করল। কিরম একটা সাফোকেশন হতে লাগল। ঈষৎ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল "কার ডিভোর্স?"

"আমার" একটুও না ইতস্তত করে জবাব দিল শিখা।

কি বলা উচিত ভেবে পেল না সুবীর। একটু চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল " হোওয়াই? কি হয়েছে?"

মাথা তুলে এবার অন্যদিকে চেয়ে রইল শিখা। তারপর যেন নিজমনেই বলতে লাগল "আর পারছিনা। সবকিছুরই তো একটা সীমা থাকে। কত মেনে নেব?"

অন্যমনস্কভাবে জুসের গ্লাসটা আরও শক্ত করে ধরে বলতে লাগল -

"প্রচুর স্যাক্রিফাইস করেছি ওর জন্য। অভাবের দিনগুলো একরকম ছিল। তখন মানুষটার জন্য গর্ব হত। দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি আমরা বালার্ককে দাঁড় করাতে। তারপর আস্তে আস্তে মানুষটা বদলে গেল। ক্রুর, দাম্ভিক, অর্থের পিশাচ হয়ে উঠল। সঙ্গে জুটল রাজনৈতিক মদত আর অবৈধ নারীসঙ্গ।"

"ওর কি কোনও আফেয়ার চলছে?" জিজ্ঞেস করল সুবীর।

"আফেয়ার তো লাভের হয়। ওরটা লাস্ট। যৌনখিদে। অভিনয়ের সুযোগের লোভ দেখিয়ে ও এখন নিত্য শিকারে মেতে ওঠে।"

"তোকে কে বলল এসব? মানে প্রমান পেয়েছিস কিছু?" প্রশ্ন করল সুবীর।

"প্রমান। স্নিগ্ধা বলে একটি মেয়ে ছিল। তাকে রিহার্সাল শেষের পর নিজের বাইপাসের ফ্ল্যাটে নিয়ে যেত রোজ। মেয়েটির স্বামী ক্যান্সার পেশেন্ট। তার অসহয়তার নির্মম সুযোগ নিত। একদিন মেয়েটি আমার সাথে দেখা করে সব বলে। আমি রোহিতকে চার্জ করলে ও হিংস্র হয়ে ওঠে। পরে খোঁজ নিয়ে দেখি ওর কোন খাতিরের নেতার সাহায্যে ওরা মেয়েটির অসুস্থ স্বামীকে পর্যন্ত মারধর করে। খুনের হুমকি দেয়। ওরা ভয়ে পুলিশের কাছে যাওয়ার সাহস পায় না। এখন এই ক্যারোলের সাথে তাই করছে। এই মেয়েটি অবশ্য অসহায় নয়, সুযোগ-সন্ধানী। দুজনে ট্যুরে গেলে এক ঘরেই থাকে। আগে লুকিয়ে করত, এখন সমক্ষেই করে। আমি গেলে আমায় আলাদা ঘরে থাকতে হয়। পার্টি বা যে কোনও অনুষ্ঠানে অবশ্য আমাকেই নিয়ে যায়" একটি দীর্ঘস্বাস ফেলে শিখা।

"এসব দেখেও তুই চুপ করে আছিস?" উত্তেজিত হয়ে পরে সুবীর। "সোজা পুলিশে যা। লেট দ্যাট রাস্কেল গো টু জেল।"

"পুলিশ" একটু কাষ্ঠ হাসি হাসে শিখা। "পুলিশ, মন্ত্রী সব ম্যানেজ করে চলে। দু একবার হয়রানি করাতে পারি। কিন্তু কি লাভ? পরকীয়া ক্রাইম নয়। টর্চার জিনিসটা কোর্টে প্রমান করা কি অত সহজ? মিউচুয়াল ডিভোর্স চেয়েছিলাম।" বলে হাতের স্লিভটা একটু তুলে কুনুইয়ের কাছে কালশিটের দাগগুলো দেখালো।

রাগে ফেটে পড়তে চাইছিল সুবীর। "শয়তানটাকে চাবকানো উচিত। ব্লাডি সন অফ এ বিচ। তোর কোনও ভয় নেই। আই জি সাহেব আমার পরিচিত। হারামজাদাকে যদি জেলের ঘানি না টানাতে পেরেছি।" 

"না সুবীর। অনেক ভেবে দেখেছি। ওসব করে কোনো লাভ হবে না। সেপারেশনে ব্যাপারটা ঝুলে থাকবে। আমি নিস্তার পাব না। আই নিড এ ট্রাস্টেড লইয়ার। যে বিকিয়ে যাবে না, পলিটিকাল প্রেসারে সাকাম্ব করবে না। সেই জন্যেই তোর কাছে আসা।" বলে আলতো করে শিখা সুবীরের হাতটা স্পর্শ করল। সুবীরের ইন্দ্রিয়গুলো যেন কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে গেল। এই টাচটা ও সারাজীবন হাতড়ে বেরিয়েছে। শিখার বিরহে ও কোনোদিনও দেবদাসমার্কা জীবনযাপন করেনি। সুন্দরভাবে নিজের ক্যারিয়ার গড়েছে। মা বাবার যত্ন করেছে। কিন্তু যখনই কোনও মেয়ের সান্নিধ্যে এসছে, তখনই যেন শিখার অভাবটা খুব বেশি করে অনুভব করেছে।অনেকেই শিখার চেয়ে বেশি সুন্দরী, বুদ্ধিমতিও কিন্তু ওর ঠিক শিখার মত কারোর খোঁজই ওকে এখনও পর্যন্ত একলা রেখেছে। আজ এই আলতো ছোয়ায় ওর মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল।

একটু সামলে নিয়ে হাতটা ও আস্তে করে সরিয়ে নিল। শিখাও অল্প অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। সুবীর বলল "তা বেশ কিন্তু মিউচুয়াল হলে তো খোরপোষের ব্যাপারটা থাকবেই না। সেটা ভেবে দেখেছিস?"

"হ্যাঁ রে। সত্যি বলতে আমার তার প্রয়োজন নেই। না টাকার গরম দেখাচ্ছি না। আমার সে মুরোদ নেই। আসলে একটা চাকরি বাঁধা আছে। তোর রুনু মাসিকে মনে আছে?" 

"ওই তোর সেই গোলপার্কের মাসি?" জবাব দিল সুবীর।

"আরিব্বাস। কিছু মেমরি তো তোর?" হেসে বলল শিখা।

"এই মেমরিটা তোর ক্ষেত্রেই এত সতেজ" বলতে মন চাইল সুবীরের কিন্তু ও চুপ রইল। শিখাই বলে চলল " ওই রুনু মাসির মেয়ে রিমঝিম কার্শিয়াং এ একটা কনভেন্ট স্কুলে পড়ায়। ওদের ওখানে আমার ইংরেজি টিচারের চাকরিটা প্রায় পাকাই হয়ে আছে। মা গত বছর মারা যাওয়ার পর থেকে দত্তপুকুরের বাড়িটা খালি পরে আছে। এক প্রোমোটার চড়া দামে কিনতে চাইছে অনেক দিন ধরে। ওটার ও রফা হয়ে যাবে। একলা মানুষের দিব্বি চলে যাবে।"

সুবীর কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল "কিন্তু স্কাউন্ডরেলটার তো শাস্তি হওয়া উচিত। আইনে না হোক, লোকের তো জানা উচিত বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব রোহিতস্য চৌধুরীর আসল রূপটা কি?"

"তাতে কি কিছু আসবে যাবে?" প্রশ্ন করল শিখা। "শিল্পীর সাত খুন মাফ হয় মানুষের চোখে। তার ওপর নারীঘটিত কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে তো উল্টে মান বাড়ে। ওসব করে লাভ নেই।"

সুবীর বুঝল কথাটা ঠিক। শিখাকে জিগ্গেস করল "কদিন আছিস এখানে?"

"শিলিগুড়িতে আর দুদিন। পরের সপ্তাহে দার্জিলিং গভর্নর হাউসে একটা অনুষ্ঠানে পারফর্ম করে কলকাতা। সব মিলিয়ে দিন ৬ আর।"

"বেশ তাহলে আমি পরের সপ্তাহে নিজে তোকে একজন ভাল উকিলের কাছে নিয়ে যাব। ভাবিসনা। আমি আছি।"

শিখা কি বলবে ভেবে পেল না। এই মানুষটা মনে হয় তাকে আজও ভালবাসে। একেই একদিন ও সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অন্য কারোর হয়েছিল। সেই কারনে বোধহয় বেচারা বিয়েই করেনি। একটুও কি ক্ষোভ নেই সুবীরের ওর প্রতি? এও কি সম্ভব?

যেতে মন চাইছিল না শিখার। কিন্তু ওদিকে আজ একটা ডিনার ইনভিটেশন আছে। তাই ও খানিকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে উঠল "এখন আমায় উঠতে হবে রে। আজ একটা ডিনারে...

সুবীর চুপ করে কি যেন ভাবছিল। শিখার কথা ও কানেই তোলেনি। কারন জিজ্ঞেস করায় বলল

"সব মানছি কিন্তু শয়তানটা ছাড় পেয়ে যাবে এটা মানতে পারছিনা। দা বাস্টার্ড শুড পে ফর হিজ সিন্স।"


উষ্ণ-গরম জলের ফোঁটা গায়ে পড়তেই আজ শিখার বেশ অদ্ভুত এক অনুভূতি হল। শরীরটা বেশ হালকা লাগছে ওর। এমনিতে এই সময়ে ও স্নান করেনা কিন্তু আজ ইচ্ছে হল করার। মাঝে মাঝে হটাৎ যেমন কোনও কারন ছাড়াই কোনোকিছু মানুষের ভালোলাগে, ঠিক তেমনই। শাওয়ার থেকে বেরিয়ে তোয়ালেটা মাথায় জড়িয়ে নিল। শরীরের আর কোথাও একফোঁটা সুতোও নেই। নিজেকে ভাল করে বিরাট আয়নাটায় দেখল। অনেকদিন যেন নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করেনি ও। আজ কিন্তু নিজেকে খুব ভাল লাগছে ওর। কবি বলেছেন বাগানের গোলাপ আর নারীর সৌন্দর্যের যদি কেউ কদর না করে, তাহলে তার কোনও দাম নেই। সত্যি কি তাই? আজ তো ওর নিজেকে খুব ভাল লাগছে। বয়সটা হুট করে কমে গেল নাকি ওর? আচ্ছা যদি সুবীর ওকে এখন এ অবস্থায় দেখত? কি করত ও? ভেবে সলজ্জে একটু নিজের ঠোঁট কামড়াল। তখনই বাথরুমের দরজায় একটা টোকা পড়ল। 

"তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। আর কতক্ষন? লবিতে অনিরুদ্ধ অপেক্ষা করছে।"

ঠিক দুঃস্বপ্নে যেমন সুন্দর ঘুম নষ্ট হয়ে যায়, রোহিতস্যর ওই কঠিন স্বরে শিখার তাই হল। সুবীরের একটা কথা ওর বারবার যেন কানে বাজছিল

"দা বাস্টার্ড শুড পে ফর হিজ সিন্স"

মুখটা আয়নার কাচের কাছে নিয়ে মুখ থেকে দুবার "হাঃ হাঃ" শব্দ করে একটু বাষ্প তৈরি করল শিখা। তারপর নিজের আঙ্গুল দিয়ে লিখল -

দা বাস্টার্ড শুড পে ফর হিজ সিন্স।

তিনজনেই একটু পরে লবি লাগোয়া রেস্তোরাঁয় বসল। অনিরুদ্ধ পালিত বালার্ক দলটির পৃষ্ঠপোষক। পাতি কথায় প্রোডিউসার। শিখা ভাল করেই জানে অনিরুদ্ধ কেন এসেছে। হালে বলিউডের এক নামকরা পরিচালক 'মার্চেন্ট অফ ভেনিস' কে হিন্দিতে আড্যাপ্ট করছে। সে নিজেই কলকাতা উড়ে এসেছিল রোহিতকে শাইলকের রোলটা অফার করতে। রোহিত শুধু নাই করেনি, পরিচালককে রীতিমত অপমান করেছে। অনিরুদ্ধ নিশ্চই এসছে ওই ব্যাপারে ওকে বোঝাতে। ওরা তিনজনে অর্ডার দিল। রোহিতস্য এদিক সেদিক দেখতে লাগল। কারোর আসার জন্য অপেক্ষা করছে বোধহয়। একটু পরেই উত্তর পাওয়া গেল। ক্যারোলের আগমন ঘটল। মেয়েটি খুব সুন্দরী না হলেও মোটের ওপর ভালই দেখতে। কিন্তু আজ কিরম যেন বিকট সেজেছে সে। শিখা ওকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিল। অনিরুদ্ধ ব্যপারটা বুঝেও না বোঝার ভান করল। শান্ত গলায় বলল " বাসওয়ানীর অফারটা ভেবে দেখলে পারতিস।"

"কে?" তাচ্ছিল্যভরে বলল রোহিতস্য। "ওই সঞ্জয় বাসওয়ানি? দূর দূর। ও করবে নাকি শেক্সপিয়ারের গদ্যরূপ। তাহলেই হয়েছে। ওই ইউপি বা হরিয়ানার গ্রামে চারটে বদমাশ দেখিয়ে, খিস্তি বলিয়ে যদি শেক্সপিয়ার হত তাহলে তো আর চিন্তাই ছিল না।"

ক্যারোল খিল খিল করে হেসে সমর্থন জানাল। শিখার কিন্তু এই উন্নাসিক মানসিকতা একদমই বরদাস্ত হয়না। ও চুপ করে রইল। অনিরুদ্ধ আরও একটু সংযত হয়ে নিজেকে বলল "দেখ মানছি। কিন্তু সর্বভারতীয় অডিয়েন্স ব্যাপারটা তো ভুললে চলবে না। আর সঞ্জয় কিন্তু একের পর এক হিট দিচ্ছে। আজ তোর স্টারডমটা সারা ভারতময় ছড়াক তুই কি চাস না?"

"রাখ তো। রোহিতস্য চৌধুরীর খ্যামটা নাচের প্রয়োজন নেই। আমার গুরু নাট্যসম্রাট মনীন্দ্র ভটচাজ্ কি বলতেন জানিস? সিনেমায় যে ছেলেরা যায় তারা অশিক্ষিত আর যে মেয়েরা যায় তারা পতিতা। সিনেমা আবার কিসের আর্ট? বদ্ধ জায়গায় দশবার এক লাইন আওরে বা পরে ডাব করে জুড়ে দিয়ে কিসের শিল্প? ও তো যে কেউ পারে। কলজে থাকে তো দর্শকের সামনে নিজের হিম্মত দেখাও। সিনেমায় চার্লস চ্যাপলিন ছাড়া কোনও শিল্প নেই।"

অনিরুদ্ধকে দেখে মনে হল ও আর কথা বাড়াতে ইচ্ছুক নয়। বালার্ক কে দাঁড় করাবার মূলে আজ রোহিতের পর সবচেয়ে বেশি এই মানুষটিরই অবদান। মানুষটা ভাল। সভ্য,ভদ্র একেবারে নিজের বন্ধুর বিপরীত বলা চলে। শিখার খুব খারাপ লাগছিল।

অনিরুদ্ধ বলে উঠল "দেখ তুই সবই জানিস। আগের মত পরিস্থিতি আর নেই। একের পর এক হল বন্ধ হচ্ছে। সরকারি সাহায্য দিনে দিনে কমে আসছে। বিদেশে শো তো কালেভদ্রে জোটে। ভারতের বাকি শহরে শো করতে হলে, উই নিড এ স্ট্রিং অফ শোওস। তার জন্য সর্বভারতীয় প্ল্যাটফর্মে মুখ হওয়াটা জরুরি। আজ নাসিরসাবকেই দেখ। কলকাতায় শো হলেও হাউসফুল, আবার চন্ডীগড়ে হলেও তাই। এটা কেন বলত? আমি আমার কথাটা বললাম। বাকিটা তুই ভেবে দেখ।"

রোহিতস্য জোরে হেসে উঠল। বন্ধুর কাঁধ চাপড়ে বলল "আরে অত চিন্তা করিস না। এই মরসুমটা খুব একটা ভাল যায়নি মানছি। পরেরবার আমরা পুষিয়ে দেব। ঘাবড়াচ্ছিস কেন? আরে তোকে আমি কথা দিয়েছি ভুলে গেলি, আমি মরে গেলেও লোকের মুখে মুখে বালার্কএর নাম ফিরবে। দা শো মাস্ট গো অন।"

শিখা আর থাকতে না পেরে বলে উঠল "তুমি সব কথা ওভাবে উড়িয়ে দাও কেন? খারাপের জন্যে তো কিছু বলছে না অনিদা। তুমি এই ছবিটা করলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হবে?"

রোহিতস্য প্রচন্ড রেগে গিয়ে বলল "দেখো আমার আর অনির মধ্যে কথা হচ্ছে। তোমাকে এর মধ্যে কেউ নাক গলাতে বলেনি?"

"তোমাদের মধ্যে মানে? এটা আমাদের সবাইকে নিয়ে কথা হচ্ছে। আর আমি এই দলটার কেউ না?" উত্তেজিত হয়ে বলল শিখা।

রেস্তোরাঁর বাকি লোকেরা ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। অনিরুদ্ধ ব্যাপারটাকে সামাল দিতে চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে রোহিতের মেজাজ সপ্তমে চড়েছে। 

"হ্যাঁ কিন্তু এটায় আমার আর অনির কন্ট্রিবিউশান সবচেয়ে বেশি। তাই এর ভাল-মন্দ ঠিক করার অধিকার আমাদের। আর তুমি কেন এত কথা বলছ? কই ক্যারোলও তো এখানে বসে আছে। ও তো কোনও কথা বলছে না। তাহলে তোমার এত ফরফর করা কিসের?" চেঁচিয়ে বলল রোহিত।

শিখার যেন সমস্ত সহ্য-ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। হিংস্র পশুর মত সে উন্মত্ত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচাতে লাগল " আমি আর ক্যারোল এক না। আমিও নিজের রক্ত জল করেছি বালার্ককে প্রতিষ্ঠা করতে। ভুলে গেছ তুমি। তোমার বোধহয় এটাও মনে নেই আমি তোমার স্ত্রী। ক্যারোল তোমার স্ত্রী না। ও তোমার রক্ষিতা।"

রোহিতস্য উঠে সপাটে এক চড় বসালো শিখার গালে। একে ও লম্বা চওড়া চেহারার পুরুষমানুষ, তার ওপর সর্বশক্তি দিয়ে মারা চড়ের ওজন শিখা সামলাতে না পেরে সোজা মেঝেতে পড়ে কাঁদতে লাগলো হাউমাউ করে।  ম্যানেজার ও দু জন ওয়েটার ছুটে এল ওখানে। অনিরুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে শিখাকে তুলে ওঠাল। মেয়েটি তখনও অঝোরে কাঁদছে। অনি ওকে সান্ত্বনা দিতে দিতে লিফটের দিকে নিয়ে চলল। ক্যারোলও রোহিতস্য কে নিয়ে তাড়াতাড়ি করে বিল মিটিয়ে ওখান থেকে বার হয়ে গেল।

একলা ঘরে এসিটা খুব আস্তে চলছে। শিখা বিছানার নীচে বসে তখনও কাঁদছে। জামাটা ছাড়বে ভেবেছিল, ছাড়েনি। কিছুই ভাললাগছে না ওর। গালে যন্ত্রনাও হচ্ছে। এতদিনে ভালবাসার পুরষ্কার ও পেয়েছে সর্বসমক্ষে। ফর্সা গালে যেন পাঁচ আঙুলের দাগ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বার করে ও সুবীরের নাম্বার ডায়াল করল

"ক্যান ইউ প্লিজ কাম টু মাই রুম রাইট নাও?"

শিখার গলা শুনেই সুবীর বুঝল কিছু গন্ডগোল হয়েছে। ও মিনিট পনেরোর মধ্যেই হোটেল রুমে হাজির হল। রুমের দরজা লক ছিল না। ভেতরে ঢুকে ও তাড়াতাড়ি শিখাকে ধরে তুলল। শিখা ওকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগল। সুবীর ওকে শান্ত করার চেষ্টা করল। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর ও সব ঘটনা খুলে বলল সুবীরকে। 

"এক্ষুনি চল এখন থেকে। প্যাকিং করে নে। আর এক মুহূর্ত এই কুকুরটার সাথে থাকতে হবে না। এখনই চল।" সব শুনে বলল সুবীর। শিখা এবার একটু ধাতস্থ হয়ে বলল "না। আমি অন্য কথা ভাবছি।"

"কি?" প্রশ্ন করল সুবীর।

"তোর ওই কথাটা। 

দা বাস্টার্ড শুড পে ফর হিজ সিন্স।" বলল শিখা।

"ও আমার জীবনটা নষ্ট করেছে। এখন আমি চলে যাব আর ও ওই সস্তার মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করবে? এটা হতে দেওয়া যায়?"

"তাহলে তুই কি করবি?" বলল সুবীর।

আস্তে আস্তে হেঁটে ও ড্রয়ারের দিকে গেল। মনে হল কোনও নিথর দেহ হেঁটে যাচ্ছে। ওর ঘরেও এরম একটা ড্রয়ারে কি আছে জানিস?

"কি?" কৌতুকভরা গলায় বলল সুবীর।

"একটা স্মিথ আর ওএসন" ঠান্ডা গলায় জবাব এল।

"পিস্তল?" আতঙ্কের স্বরে পাল্টা প্রশ্ন করল সুবীর।

"রিভলভার। লাইসেন্সড। সবসময় সাথে থাকে ওর।" জবাব দিল শিখা।

"তো?"

হটাৎ করে ঘুরে দাঁড়াল ও "তুই বললি না হি শুড পে ফর হিজ সিন্স। ইটস টাইম। সময় এসেছে ওকে সাজা দেওয়ার। আমার জীবন ছারখার করে দিয়েছে ও। হি শুড পে।", চেঁচিয়ে বলল শিখা।

সুবীর চুপ করে দেখছিল। একসময় যে মানুষটাকে প্রান দিয়ে ভালবেসেছিল এই মেয়েটি আজ প্রতিশোধস্পৃহায় তারই খুন করতে চাইছে। সময় কিভাবে সব বদলে দেয়। আস্তে করে গিয়ে ও শিখার কাঁধ স্পর্শ করে বলল "শান্ত হ। বোস আগে।"

"না আমি শান্তই আছি। ছেলেভোলাতে হবে না। ওর এই বন্দুকেই ওর প্রান নেব আমি" হিমশীতল গলায় বলে শিখা।

"বোকার মত কথা বলিস না। ওর বন্দুকের নাগাল তুই পাবি কিভাবে? আর না হয় পেয়ে মেরেও ফেললি। পুলিশ তোকে ছেড়ে কথা বলবে? ওর জন্যে ফাঁসিতে ঝুলবি না আজীবন জেলে পচবি?" বুঝিয়ে বলে সুবীর।

একটা ক্রুর হাসি খেলে যায় শিখার মুখে। এরম মুখ ওর কোনোদিন দেখেনি সুবীর। এ যেন ওর চেনা শিখা নয়। এ যেন অন্য কেউ।

"ধর ওর মৃত্যুটা যদি নিছক এক্সিডেন্ট হয় বা যদি গুলি অন্য কেউ চালায়?"  হেসে জবাব দেয় শিখা।

"তুই কি বলছিস তার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিনা" অস্থির হয়ে ওঠে সুবীর।

"বলছি। একটা প্ল্যান আছে। ওর একটা অদ্ভুত কুসংস্কার আছে। ওর যখনই কোনও গান-সিন হয়, ও নিজে নিজের রিভলভারই ব্যবহার করে। অবশ্যই লোডেড থাকে না। এই তো আগের মাসে কলকাতায় 'মাউসট্র্যাপ' এর সময় তাই করেছিল। গতবছর ডালাসে আমরা 'টিকিটিকি' করেছিলাম। সেখানেও বৃদ্ধ লেখকের রোলে রোহিতস্য চৌধুরী নিজের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছিল। এবারে আমরা গভর্নর হাউসে 'মেফিস্টো' মঞ্চস্থ করছি। হফগ্যানের চরিত্রে যথারীতি রোহিত। এখানে ও বেশ কিছু অদলবদল করেছে মূল স্ক্রিপ্টে। এক, আমার ডাবল রোল আছে - গুড এঞ্জেল আর ব্যাড ডেভিল। দুটোই নায়কের বিবেক বলতে পারিস। আর দুই ক্যারোল হবে হফগ্যানের রক্ষিতা বেভি। কি মিল না বাস্তবে আর মঞ্চে।" বলে একটু যেন বিরতি নিল শিখা।

সুবীর খুব মন দিয়ে ওকে লক্ষ্য করছিল। এই মহিলাটি সত্যিই ওর অজানা, অচেনা। কে এ? গুড এঞ্জেল না ব্যাড ডেভিল?

শিখা আবার শুরু করল "নাটকের শেষ সিনে হফগ্যান বাড়িতে আতঙ্কে কাঁপছে। নাৎসিরা চারিদিকে হারস্বীকার করছে। হিটলারের আত্মহত্যার খবর ততক্ষনে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। রেড আর্মি বার্লিনের দখল নিয়েছে। এমন অবস্থায় নাৎসি সমর্থক হিসেবে খ্যাত বিশ্ববরেণ্য শিল্পী ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। বেভিকে বলছে চল আমরা এখনই পালাই। রাশিয়ানরা আমায় পেলে মেরে ফেলবে। বেভি হেসে জবাব দিচ্ছে এই দিনটার অপেক্ষাই সে এতদিন ধরে করছিল। বলে নিজের কোমরে গোঁজা রিভলভার বার করে বলছে হফগ্যানকে - আমার পুরো নামটা তোমায় বলা হয়নি ডার্লিং। আমার পুরো নাম বেভ ফ্র্যাঙ্ক লাইনবর্গ। আমি একজন ইহুদী। বলেই বন্দুক গর্জে উঠছে ঠাঁই। দি এন্ড।"

"হ্যাঁ কিন্তু এটা তো অভিনয়। সত্যি তো না। পিস্তল তো লোডেডও না। তাহলে" উদগ্রীব হয়ে বলল সুবীর।

"জানি জানি স্যার জানি। কিন্তু এটাও জানি কোনও ফায়ারিং সিন থাকলে রোহিত ইনসিস্ট করে ট্রিগার টেপার জন্যে। রিহার্সালেও আমরা তাই করি। এবার ধর যদি সেই সময় পিস্তল লোডেড থাকে?" একটা বাঁকা হাসি হেসে বলল শিখা।

"হাউ ইস দ্যাট ইভেন পসিবল।"

"পসিবল। ভেরি মাচ পসিবল। গভর্নর আউট-হাউসে ও আমার সাথেই এক ঘরে থাকবে। সরকারি আমলাদের চোখে তো ভদ্রলোক সাজতে হবে। আমি আজই একটু ন্যাকামি করে ক্ষমা চেয়ে নেব ওর আর ওর বেশ্যার কাছে যাতে আমায় নাটক থেকে বাদ না দেয়। এত তাড়াতাড়ি অবশ্য ওরা রিপ্লেসমেন্ট পাবেও না। এবার গ্রিনরুমে প্রপ বক্স থাকবে। ওর মধ্যেই থাকবে খালি পিস্তলটা। ওই বাক্সের ৭ টা চাবি আছে যার মধ্যে একটা আমার কাছে থাকবে। আমায় দুটো কাজ করতে হবে। এক, একটা ছুতো করে ঘরে এসে ওর ড্রয়ার খুলে ৬ টা বুলেট নিতে হবে। বন্দুক ছাড়া বুলেট কেউ যত্ন করে চাবি দিয়ে রাখেনা। তাই সহজেই পেয়ে যাব। দুই আমায় প্ৰপ বক্স খুলে বন্দুক বার করে ওতে বুলেট ভরে দিতে হবে। তাহলেই কেল্লা ফতে। অভিনয়ের আগমুহূর্তে তো আর ও স্টেজে বসে রিভলভার চেক করবে না।"

অবাক হওয়া সত্ত্বেও সুবীর কি একটা বলতে যাচ্ছিল। শিখা থামিয়ে দিয়ে বলল "এটাই বলবি তো ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাবে পুলিশ? প্ৰপ বক্স আর ড্রয়ারে না হয় আমার হাতের ছাপ পেতে পারে কিন্তু বুলেটের শিশিতে বা বন্দুকে পেলে ঝামেলা করবে।বলে রাখি আমার দুটো চরিত্রেরই হাতে গ্লাভস থাকবে। তাই সে গুড়ে বালি।"

"সেটা তাও মানলাম। কিন্তু গ্রিনরুমে কেউ বন্দুকে গুলি ভরতে দেখলে? বা যদি পুলিশ বলে নাটক চলাকালীন আপনি গ্রিনরুমে কি করছিলেন?" বলল সুবীর।

"হায় ভগবান। তোর ঘিলু বলে কি কিসুই নেই? এঞ্জেল আর ডেভিল সাদা আর লাল পোশাক পরে দেখিসনি কার্টুনে? এখানেও আমার দুটো গাউন। পোশাক বদলাতে তো গ্রীন রুমে ঢুকতেই হবে। তখন তো লক করব না কি? সবার সামনে কাপড় পাল্টাননি কেন এই প্রশ্ন করবে পুলিশ?" হেসে বলল শিখা।

সুবীর কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। এই চিন্তা তো কোনও চরম কুচক্রী ক্রিমিনালের মাথাতেও আসবেনা। ওর দৃষ্টি স্থির হল শিখার ওপর। এখন শিখাকে অনেক স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। খানিক্ষণ ভেবে ও প্রশ্ন করল " আমায় কি এটা বিশ্বাস করতে হবে এটা আজ এক্ষুনি বসে ফাঁদা প্ল্যান?"

শিখা মনে হয় এই প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল। ও সুবীরের কাছে এগিয়ে এসে দু হাত দিয়ে ওর গলাটা জড়িয়ে ধরল। তারপর ওর ঠোঁটটা একদম সুবীরের ঠোঁটের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল "আমায় কি এটা বিশ্বাস করতে হবে তুই আমার কার্শিয়াং যেতে দিবি?" দুজনে আর কথা বাড়াল না। একে অপরের ঠোঁটের স্বাদ নিল অনেক্ষন ধরে। যাওয়ার সময় শিখা বলল নাটকটা আর ৪ দিন পর। ও যেন এর মাঝে ওকে ফোন, ম্যাসেজ না করে। পুলিশ কল ট্রেসিং থেকে অনেক কিছু বার করে। সে সুযোগ দেওয়া যাবে না।


সুবীরের মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করতে লাগল। একে তো কি হবে, কি হবে একটা ব্যাপার আছেই। তার ওপর ওর মধ্যে একটা প্রশ্ন দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছে। পুরোটাই কি একটা সেট-আপ। শিখা কি সব সত্যি কথা বলছে? রোহিত মারা গেলে ওর তামাম ধনসম্পত্তি শিখাই পাবে। কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে ওকে সব কথা শিখা খুলে বলতে যাবেই বা কেন? কি লাভ? এটা তো মার্ডারের সাক্ষী রয়ে যাওয়া। ও দিন গোনে। ভাবে আগেভাগে দার্জিলিং গিয়ে বসে থাকবে কিনা। কিন্তু তাতে পুলিশের সন্দেহ ওর ওপর পড়তে পারে। আচ্ছা ওর কি উচিত হচ্ছে সবকিছু জেনেও জিনিসটায় বাঁধা না দেওয়া। এটা তো খুন। ঠান্ডা মাথায় করা হত্যা। ও তার শরিক হয়ে ঠিক করছে কি? কিন্তু শিখা যদি খুনি হয় তাহলে যে জজসাহেব ফাঁসির আদেশ দিচ্ছেন তিনিও তো খুনি। তার সাথে যেহেতু আইনের কতগুলো ধারা আছে, তাতেই তার সব ঠিক? আইন তো নিজেই সময়ে সময়ে বদলায়। তার ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড কতটা যুক্তিযুক্ত? কিন্তু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে একটা ক্ষীণ যুক্তি আছে। যে সব মানুষ সমাজের ক্ষতি করে। যাদের জন্য একাধিক প্রান বিপন্ন হয়, তাদের বাঁচতে দেওয়া মানে আরও কিছু নিরাপরাধ মানুষের জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া। আজ রোহিতস্যর মত কীটরা আরও অনেক শিখা, স্নিগ্ধাদের জীবন নষ্ট করবে। এরম পাষন্ডদের মারা কি অপরাধ?  আর ক্যারোলের মত মেয়ে যারা নিজের শরীরকে কাজে লাগিয়ে সব হাসিল করতে চায়, তাদের যদি শাস্তি হয়, তাতেই বা খারাপ কি? যা হচ্ছে , বেশ হচ্ছে। এখন শুধু তার অপেক্ষা করার পালা। মুম্বাই অফিসে ফোন করে সে আগেই জানিয়ে দিয়েছে তার ফিরতে দেরি হবে।

অবশেষে সেই দিনটা যখন এল, সুবীরের তখন প্রায় উৎকণ্ঠায় পাগল হওয়ার জোগাড়। সবকিছু প্ল্যানমাফিক হবে তো? কিছু গড়বড় হলে? নাটকটা কি সকালে না সন্ধেবেলায় সেটাই ও শিখাকে জিজ্ঞাসা করেনি। নির্বোধ ও একটা। বারবার মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে ও। ইচ্ছে হচ্ছে ফোন করার। কিন্তু শিখা তো বারণ করে রেখেছে। অবশেষে অন্যমনস্ক ভাবে ফেসবুক ঘাঁটতে গিয়ে নিউজফিডে একটা লিংক চোখে পড়ল

"নাট্যব্যক্তিত্ব রোহিতস্য চৌধুরীর মর্মান্তিক মৃত্যু।"

উত্তেজনায় ওর হাত পা কেঁপে উঠল। লিংকে ক্লিক করে ও পড়ল 

"আজ দুপুরে দার্জিলিং গভর্নর হাউসে বিখ্যাত নাট্যকার রোহিতস্য চৌধুরীর নির্মম হত্যা হয়েছে। নাটক চলাকালীন দুপুর ১:২০ নাগাদ রোহিতস্যকে ওনারই সহ-অভিনেত্রী ক্যারোল বিশ্বাস গুলিকরে সর্বসমক্ষে খুন করেন।  নাটকের অন্তিম দৃশ্যে ক্যারোলের রোহিতস্যকে গুলি করার কথা ছিল। কিন্তু অভিনয়ের এই দৃশ্য উঠে এল ভয়াবহ রূপে বাস্তবে। ক্যারোল অভিনয়রত অবস্থাতেই রোহিতস্যকে বুকে গুলি করার সঙ্গে সঙ্গেই, প্রখ্যাত অভিনেতা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এই ভয়ানক ঘটনায় গোটা শিল্পীমহল স্তম্ভিত। ক্যারোল আপাতত পুলিশ হেফাজতে। মার্ডার মোটিভ সম্মন্ধে এখনও কিছু জানা যায়নি কিন্তু পুলিশ আন্দাজ করছে এর মধ্যে একটা অবৈধ প্রেমের রসায়ন আছে। এর আগেও স্নিগ্ধা রায় নামে এক উঠতি অভিনেত্রীর সাথে রোহিতস্য চৌধুরীর নাম জড়িয়েছে। রোহিতস্য ছিলেন বাংলা নাট্যজগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যু শিল্পীজগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা তার স্ত্রী শিখাদেবী ও বাকি ওনার সকল পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।"

টিভিটা খুলে বিভিন্ন নিউজ চ্যানেল ঘোরাতে লাগল সুবীর। সবজায়গায় 'ব্রেকিং নিউজ' একটাই। কোথাও কোথাও তো রীতিমত প্যানেল বসে গেছে। একজন মনোবিদকেও তার মধ্যে এরা ধরে এনেছেন। তিনি শিল্পীদের ব্যভিচার নিয়ে লম্বা জ্ঞান দিচ্ছেন। এত বাজে বকতে পারে কিকরে লোকগুলো? আদৌ এরা জানে কি হয়েছে? শুধু অবান্তর কথা বলে টিআরপি বাড়াবার ধান্দা। দু একটা ক্লিপে শিখাকে দেখতে পেল। শোকে মুহ্যমান। কিন্তু কোনও বাড়াবাড়ি নেই। জাত অভিনেত্রী। আচ্ছা পুলিশ যদি জানতে পারে ওর ঘরে যাওয়ার ঘটনাটা? ওকে তো কড়া জেরা করতেই পারে। পুলিশের জেরার মুখে কিন্তু অনেক বড় বড় শর্মাই ভেঙে পরে। শিখা যদি নার্ভ না ধরে রাখতে পারে? ওই ক্যারোলকে তো হাজতে রেখেছে। চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য না পেলে ওর ছাড়া পাওয়া দুস্কর। বেশ হয়েছে।

ঠান্ডা মাথায় এসব ভাবছিল সুবীর। হটাৎ ফোনটা বেজে উঠল। "সুজয়" নামটা ভেসে এল স্ক্রিনে। সুজয় ওদের কলেজের ব্যাচেরই ছেলে। কমন ফ্রেন্ড যাকে বলে। ফোন তোলামাত্রই ওর প্রচন্ড উত্তেজিত কন্ঠ শুনল

"রোহিতের খবরটা শুনলি? কি মারাত্মক!!!"

সুবীর যথাসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলল " হ্যাঁ।"

"তুই কি মুম্বাইতে? কলকাতায় আসবি? ওদের বাড়ি যাবি?" ঝড়ের বেগে কথাগুলো বলে গেল সুজয়।

"না আমি শিলিগুড়িতেই আছি। কিন্তু দার্জিলিংএ আর যাব না। ভাবছি কাল কলকাতায় ওদের বাড়িতেই যাব। কটায় আসবে কিছু জানিস? আবার তো পোস্ট-মর্টেম ফর্টেম হবে।" বলল সুবীর।

"সে সব দু-তিন ঘন্টার ব্যাপার। জাস্ট কাল সকাল অবধি ওরা ওয়েট করছে অটোপসির জন্য। অরিত্র ওদের দলের সাথেই আছে। বলল রিপোর্টটা পেতে পেতে মনে হয় পরশু রাত হবে। জটিল কিছু না পেলে তরশু সকালে ওরা বডি নিয়ে আসবে কলকাতায়। তুই পরশু রাতের মধ্যে ইন করে যা। আমি কলকাতাতেই আছি। রাখি রে, পরে কথা হবে।"

সুজয়ের সাথে পরশুর কথা হলেও সুবীর আজ রাতেই রওনা দেবে স্থির করল। কোনভাবেই কারোর যেন এটা না সন্দেহ হয় যে সে রোহিতস্যর কারনে কলকাতা এসেছে। দু দিন শুধু নিজের গড়িয়ার ফ্ল্যাটে চুপ করে বসে থাকবে। তারপর হাজির হবে ঠিকদিন ওদের বাড়িতে। শিখার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ও ঠিক সামলে নেবে। ক্যারোলের বিরুদ্ধে প্রমান যথেষ্ট জোরালো। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সে বেড়িয়ে পড়ল।

সুজয়ের কথাই ঠিক হল। নির্দিষ্ট দিনেই ওরা সকলে এসে পৌঁছল কলকাতায়। ওরা আসার আগেই ভিড় জমেছিল রোহিতের বালিগঞ্জের বাড়িতে। শিল্পী তো বটেই অনেক নামকরা নেতা-মন্ত্রীরাও হাজির। মিডিয়ার ওবি ভ্যানে ভ্যানে বাড়িসংলগ্ন রাস্তাটা ভরে গেছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও গান-স্যালুট দিয়ে সম্মান জানিয়ে সৎকারের নির্দেশ দিয়েছেন। দেশজুড়ে অনেক হোমরা-চোমরা ব্যক্তিরাই টুইট করে মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সুবীর এই ভিড়ের মধ্যেও ছিল একটু তফাতে দাঁড়িয়ে। সুজয় অনর্গল কিছু বকে যাচ্ছিল। ওর সেদিকে কোনও হুঁশ ছিল না। ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল ওরা কখন আসবে। নিউজ তো বলছে ওরা দমদম থেকে রওনা হয়ে গেছে। আর বেশিক্ষন না।

কফিন বহনকারী শবগাড়িটা যখন ওই বাড়িতে ঢুকল, তখন যেন এক জনসুনামি ঘটল। অসংখ্য মানুষ মাইক ও ক্যামেরা নিয়ে যেন হামলে পড়ল। ওর পেছনে লাল বিএমডাব্লুর ও একই অবস্থা। পুলিশ কে অনেক হ্যাপা পুষিয়ে ভিড় ফাঁকা করতে হল। একে সেলিব্রিটির মৃত্যু, তারওপর মার্ডার। এর সাথে রয়েছে অবৈধ প্রেমের মশলা। আর কি চাই লোকের?

একটি মেয়ে নেমে এল বিএমডাব্লুর পেছনের গেট ঠেলে। ধরে ধরে নামাল শিখাকে। শিখাকে দেখলে কে বলবে এই নিধনযজ্ঞ ওরই মস্তিষ্কপ্রসূত। শোকে মুখ যেন বিকৃত হয়ে গেছে। সাদা চুড়িদারে কিন্তু তাও মানাচ্ছে ওকে। অসংখ্য ক্যামেরার শব্দ আসছে চারদিক দিয়ে। ধরে ধরে ওরা শিখাকে নিয়ে গেল শবগাড়ির পেছন দিকটা। কাঁচের ভেতর থেকে কাঠের কফিনটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বেশ ডেকোরেটেড। সবাই ধরাধরি করে কফিন নামাতে উদ্যত। শিখা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। পাশের মেয়েটি ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কফিনটা ধরে নামাবার সময় ওখানে কি একটা জটলা হচ্ছে না? ওই যে ছেলেটি কফিনটা টানছে সে কি যেন একটা বলছে। বেশ রেগেমেগেই। কি হল হটাৎ? শিখার কান্নাও ইতিমধ্যে থেমে গেছে। সুবীর আস্তে করে এগিয়ে গেল গাড়িটার দিকে। ছেলেটি বেশ চেঁচিয়ে বলছে

"আরে দাদা আমরা এই কাজই করি। কেন বুঝছেন না? ভরা কফিন এত হালকা হয় না। এটা তাও চার দিনের পুরোনো বডি। এত হালকা হতেই পারে না। কিছু গন্ডগোল আছে। সেই তখন থেকে বলছি। শুনছেন না কেন? একবার খুলে দেখুন।"

এ আবার কি ফ্যাসাদ? কফিনটা নীচে বেদিতে নামানো হল। দুজন সেটির পাল্লা খুলতেই যা দেখল সকলে, তাতে আর যেন কারোর দেহে প্রান থাকল না। এবনি কফিনটা হাট করে খোলা আর তার ভেতরে কিচ্ছু নেই। চারিদিকে হৈচৈ পরে গেল। শিখা একটা বিকট আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে গেল। ভিড়ের মধ্যে কেউ কেউ ভূত ভূত বলে পালাতে লাগল। সে এক ভয়ানক স্ট্যামপিড হওয়ার মত অবস্থার সৃষ্টি হল। সুবীর বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল। সুজয় ওকে একপ্রকার জোর করেই গাড়িতে তুলে নিয়ে পালাল ওখান থেকে। গোটা মহানগরী যেন বিস্ময় ও ভয়ে এস্ত্র হয়ে রইল।

এর পরের কদিন যা হল তা সার্কাসের কম কিছু নয়। জায়গায় জায়গায়, পাড়ার মোড়ে, চায়ের ঠেকে, অফিস-কাছারিতে, সোশ্যাল মিডিয়াতে সর্বত্র খালি এক আলোচনা - লাশ নিখোঁজ। নতুন নতুন থিওরিতে বাজার গরম হতে লাগল। কেউ ভৌতিক, কেউ ঐশ্বরিক, কেউ বা কোনও গভীর ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আওড়াল। ক্যারোলের আইনজীবী বক্তব্য রাখল " যেখানে বডিই পাওয়া যায়নি, সেখানে কিসের খুন?" কিন্তু আদালত জানাল, খুন হয়েছে তার প্রমান স্বরূপ ডেথ সার্টিফিকেট ও কোরোনারের রিপোর্ট রয়েছে। যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে লাশ গায়েব। সেটা ভিন্ন ঘটনা। তার জন্য খুনের ওপর সন্দেহ প্রকাশ করা যায়না। তাই অপরাধীর জামিন নাকচ। সবচেয়ে করুন অবস্থা হয়েছে শিখার। সম্পূর্ণ নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছে ওর। চলে ফিরে বেড়ানো তো দূর, কথা বলার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে ওর। ডাক্তাররা সন্দিহান আদৌ কোনোদিন ও সুস্থ হবে কিনা। সুবীর আইনত ওর কাস্টডি নিতে চেয়ে কোর্টে আপিল করেছে। বিবাহ তো দুজনের সম্মতি ছাড়া সম্ভব নয় আর শিখা সম্মতি দেওয়ার মত অবস্থায় নেই। হাসপাতাল থেকে ফিরে বেশ অবসন্ন লাগছিল সুবীরের। শিখাকে ওই অবস্থায় দেখে রোজ একটু একটু করে রক্তক্ষরণ হয় ওর। এসে সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছে, চাকর এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল। একবার চোখ ফিরিয়ে দেখল। এখনকার দিনে অফিসের চিঠি ছাড়া কিছু আসে না, কিন্তু এটা তা না। খামের ওপর প্রেরকের নাম 'অনিরুদ্ধ পালিত'। খামটা ছিঁড়ে আলস্যভরে চিঠিটা বার করল সুবীর। কিন্তু একটু পড়েই সোজা হয়ে বসল সোফায়।

"প্রিয় সুবীরবাবু,

আপনি আমায় চিনবেন না। আমার নাম অনিরুদ্ধ পালিত। আমি 'বালার্ক' দলটির পৃষ্ঠপোষক। ডাক্তার অনিমেষের কাছে শুনলাম শিখার দেখাশোনা আপনিই করছেন। তাই আপনাকে কিছু কথা জানানোর একান্ত প্রয়োজন বোধ করলাম। চাইলে ফোন করে বা দেখা করেও বলতে পারতাম। কিন্তু যে কথা বলতে যাচ্ছি তা সামনাসামনি বা ফোনেও বলার সাহস আমি পাচ্ছি না। আর যে সাংঘাতিক আত্মগ্লানিতে আমি ভুগছি, তাতে এ কথা না বললে হয়ত আমার শান্তি হবে না। আজ শিখার যে করুন পরিণতি হয়েছে তার জন্য আমিই দায়ী। হ্যাঁ শুধুমাত্র আমিই দায়ী। ঘটনাটা আপনাকে খুলে বলছি।

বালার্ক আমার আর রোহিতেরই ব্রেইনচাইল্ড। নামটা আমারই দেওয়া। আমার অর্থ, ওর ট্যালেন্ট - এই ছিল মিশ্রণ। শুরু করেছিলাম একটা এককামরার অফিসে। আজ সেটা ফুলেফেঁপে এত বড় হয়েছে। রোহিতস্য শুধুমাত্র আমার ব্যবসায় অংশীদারই ছিল না, ও ছিল আমার বন্ধু, আমার ভাই। যেরম ছিল অসম্ভব প্রতিভাশালী, তেমনই ছিল রেকলেস। রাতের পর রাত জেগে আমরা কাজ করেছি। আমি হাঁপিয়ে উঠতাম, ওকে একবারের জন্যও দমতে দেখিনি। অদ্ভুত চার্জড থাকত সবসময়। সবসময় সেই ফায়ার ইন দা বেলি যাকে বলে তাই ছিল। তাই হয়ত পৌঁছতে পেরেছিল খ্যাতির চূড়ায়। স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই, আজ আমার যা আছে সব ওর জন্যেই। হ্যাঁ উন্নাসিক ছিল, নারীর প্রতি আসক্তি মারাত্মক ছিল। কিন্তু বন্ধু হিসেবে আমার জন্যে যা করেছে তার ঋণ আমার হয়ত একশ জন্মেও শোধ করা সম্ভব হবে না।

তখন আমরা নিউ ইয়র্কে একটা নাটকের প্রস্তুতি নিচ্ছি।কিংবদন্তি এস্কেপ আর্টিস্ট হ্যারি হুডিনীর জীবনের ওপর একটা নাটক। রোলের জন্য রোহিত কি ভয়ানক ভয়ানক সব ম্যাজিক শিখেছিল। ভাবতে পারেন ডেডিকেশন!!! ওই নাটকের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় আমরা এক হুডিনির শিষ্যের কথা জানতে পারি - রসকো ফারলিনি। এই ফারলিনিও ছিল বড় জাদুকর। মৃত্যুর সময় যখন ওকে কবর দিতে নিয়ে আসা হয়, তখন দেখা যায় কফিন খালি। সবাই ভেবেছিল এই মহান এস্কেপ আর্টিস্ট মরার পরেও নিজের কেরামতি দেখিয়ে গেল অলৌকিকভাবে। পরে জানা যায় ওরই এক বন্ধু কফিন পাল্টে দিয়েছিল। ওকে গোর দেওয়া হয় অন্য কবরস্তানে। রোহিত ব্যাপারটা পরে খুব এমিউসড হয়েছিল। ও বলে ওর মৃত্যুর পর যেন আমি এমনটা করি। শুধু বলেই থামেনি। রীতিমত নিজের হাতে লিখে দিয়েছিল আমাকে যাতে সবাই পরে বিশ্বাস করে। বলেছিলাম এসব ছেলেমানুষির মানে কি? উত্তরে বলেছিল "এটা ঘটলে ১০০ বছর পরও লোকে এই নিয়ে কথা বলবে। তোমার বালার্ক অমর হয়ে থাকবে।" প্রায় বলত আমায় কথাটা। আমি বলেছিলাম বেশ তা নয় হল। কিন্তু লোকে যদি তোমার কাজ নিয়ে আলোচনা না করে শুধুই তোমার শরীরের কি হল তাই নিয়ে মাথা ঘামায়, তাতে তোমার ভাল লাগবে? ও বলেছিল "করবে করবে, সুভাষ বোসের মৃত্যু নিয়ে যেমন লোকের কৌতূহল আছে , তেমনই কাজ নিয়ে শ্রদ্ধাও আছে। কোনোকিছুই ফেলা যাবে না।"
আমি তাও বলেছিলাম,তাও মানলাম। কিন্তু আমি যদি আগে মরি? হেসে জবাব দিয়েছিল "এত মদ আর নারীসঙ্গের ফল কোথায় যাবে? স্বর্গ নরক না থাক, লিভার আর সিফিলিস তো আছে।" তখন কে জানত ওর এরম করুন পরিণতি হবে।

তাই ওর মৃত্যুর পরপর আমি কমিশনার সাহেবের সাথে ওর শেষ ইচ্ছের দলিল নিয়ে দেখা করি। উনি একটু কিন্তু কিন্তু করছিলেন কিন্তু শেষে রাজি হয়ে গেলেন। এক উচ্চপদস্থ মন্ত্রীকে ব্যাপারটা জানানো হল। ওর চাপেই রাজি হলেন। এ দেশে রাজনৈতিক মদতে কি না হয়? কমিশনার সাহেবের কথা মতোই আমরা দুজন পুলিশ নিয়ে মর্গের পেছনের দরজা দিয়ে ওর বডি বার করে আনলাম। খালি কফিন সযত্নে রেখে দেওয়া হল ওর জায়গায়। তারপর মিরিখের একটু আগে একটা ছোট শ্মশান আছে। সেখানেই ওকে দাহ করা হয়। আমিই সৎকার করি।

ভাবিনি এই কাজের খেসারত নিরীহ শিখাকে এভাবে দিতে হবে। পুরো জবানবন্দী রইল আমার, চাইলে এটা পুলিশে দিতে পারেন। যা শাস্তি হবে, মাথা পেতে নেব।"

রাত ঘনিয়ে আসছিল শহরের আকাশে। সুবীর একটু জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ব্যস্ত রাস্তাঘাট তখন বিশ্রামের  অবকাশ খুঁজছে। সুবীরও চিঠিটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে হওয়ায় মিলিয়ে দিল।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য