দীপ শেখর চক্রবর্তী

 


তৃষ্ণা বেড়ে চলে

কোপাইয়ের এই তীরের কথা অনেকেই জানে না। পর্যটক আসে না এখানে। বালি ও কাঁটাঝোপের এক অদ্ভুত পথ অতিক্রম করে এই এখানে এসেছি। শরীর ক্লান্ত, দু'দিন জ্বরে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি। একা একা পড়ে ছিলাম ঘরে, মুখের সামনে জল এগিয়ে দেওয়ার মতো একটা মানুষ ছিল না। এখন সামনে কোপাইয়ের সূক্ষ্ম জলের শরীর। তৃষ্ণা অসম্ভব আমার অথচ হাতদুটো অসার হয়ে গেছে। এখানে এই নির্জনে যদি মৃত্যু আসে তাহলে কে জানতে পারবে?কীভাবে আসবে মৃত্যু? নদীর ওপার থেকে একজন শাদা কাপড় পড়ে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে যাবে দূরে? কতদূর সে পথ? জানি না। শুধুই তৃষ্ণা বেড়ে চলে। কিছু দূরে একজন সাঁওতাল মেয়েকে সেই প্রথম দেখলাম। হাতে গরু তাড়ানোর একটি ছড়ি হাতে সে দাঁড়িয়ে আছে সূর্যের বিপরীত দিকে মুখ করে। তার চোখ আমার অন্তরাত্মাকে যেন দেখতে পাচ্ছে।তার চোখ প্রখর সূর্যের বীরভূমে তালপাতার ছায়ার মতো। আমার গলা শুকিয়ে আসছে ক্রমাগত অথচ এই প্রথম মনে হল এই মেয়েটির সঙ্গে আমার কথা বলার মতো কোনো ভাষা নেই। ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে আশ্চর্য এক ভাষা আমাকে শিখে নিতে হবে।
মেয়েটি কখন সূর্যের সামনে থেকে সরে গেল বুঝলাম না। এখন সমস্তটাই মনে হচ্ছে মায়া।মায়ার দেবী আমাকে এভাবে এখানে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছেন। নইলে এমন শরীরে এতটা পথ অতিক্রম করে এখানে এসে পড়ে রইলাম কেন। সামনে কোপাই। তার সূক্ষ্ম জলের শরীর স্পর্শ করার অধিকার অব্ধি পাইনি। এদিকে, তৃষ্ণা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে আমার। মাথার ওপর বেড়ে চলেছে তাপ, এক সাঁওতাল দেবতা যেন অদৃশ্য মাদল বাজিয়ে বাজিয়ে দিনটাকে ক্ষেপিয়ে তুলছেন। আমি মাটির সামান্য শীতল সমস্ত শরীরে মেখে নেওয়ার চেষ্টা করছি আর হাত পেতে বলছি - একটু জল।
আজ নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি সেই তৃষ্ণার কথা। মাঝে কেটে গেছে তিনটি দিন, আড়াইশো দূরত্ব। আমাদের এদিকে তেমন নদী নেই। বাগানের আমগাছ থেকে বসন্তের পাখিরা ডেকে চলেছে। একটি মেয়ে আমার হাতে হাত রেখে বলেছিল, বসন্তকালেই নাকি সবথেকে মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আমি তাকে ভালো বেসেছিলাম। কেন? সে প্রশ্ন করার আগেই গলা অদ্ভুত শুকিয়ে এসেছিল আমার।
তৃষ্ণা, যেন আমার ভেতরে একজন কেউ একা বসে আছে ঘরে। একটি মোম তার মুখটিকে অর্ধেক আলো দিচ্ছে। ঘরের ভেতর একটি লোহার বড় দরজা, যা দু'দিকে সমানভাবে খোলে। এই একজনের সঙ্গে যত কথা বেড়ে চলে তত বাইরের কথা কমে আসে। মোম নিভে গেলে আমি সেই ঘরে গিয়ে আবার তা জ্বালিয়ে আসি। হাত দিয়ে প্রবল হাওয়ার সময় তা আড়াল করি, যাতে তা নিভে না যায়।
কথা বেড়ে চলে এদিকে গলা শুকিয়ে আসে আমার। মনে হয়, কতদিন জ্বরে শুয়ে আছি অথচ কেউ নেই যে হাত বাড়িয়ে মুখের সামনে জল এগিয়ে দিতে পারে। দু'টি নরম হাত, তার পাতায় তৃষ্ণা মেটানোর মতো জল। আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে যায়, তবু কেন জানি ফুরোয় না।
কোপাই নদীর এই তীরের কথা কেউ জানে না।কত গ্রাম, কত পথ, ধুলো, বন পার হয়ে আসতে হয় এই তীরে। মাথার ওপর দ্রিম দ্রিম করে বাজছে সাঁওতাল দেবতার মাদল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে আমার। সূর্যের বিপরীত দিকে মুখ করে সেই মেয়েটি, হাতে গোরু তাড়ানোর ছড়ি, গায়ে মলিন কাপড়। চোখ যেন তালপাতার ছায়া, আমার ভেতরের একলা মানুষটিকে দেখে নিচ্ছে। ওর মুখে হাসি, ধীরে ধীরে নেমে আসছে আর গিয়ে শুয়ে পড়ছে আমার সামনে। খুলে দিচ্ছে নিজের সমস্ত পোশাক।
কোপাই নদীর এই তীরের কথা কোনো পর্যটক জানেনি। আমি কোন এক মায়ার ঘোরে এখানে এসে পড়েছি, ফেরার পথ হয়ত মনে করতে পারব না। গলা শুকিয়ে আসছে আমার। বুকে হেঁটে হেঁটে আমি এগিয়ে চলেছি নদীর জলের দিকে।
জলে চুমুক দিই। পান করি বুক ভরে তবুও তৃষ্ণা মেটে না। ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছে কোপাইয়ের সমস্ত জলের শরীর। বেরিয়ে আসছে জলজ জীবেরা, বালি এমনকি মাঝিদের ফেলে আসা লগিগুলো। তবুও তৃষ্ণা মিটছে না আমার, গলা আরও শুকিয়ে আসছে।
মুখ তুলে আকাশের দিকে কোন উন্মাদের মতো আমি চিৎকার করে চলেছি।
কোপাইয়ের জল বেড়ে চলেছে সেই চিৎকারে। ভেসে যাচ্ছে সমস্ত পোশাক। তার স্তন ফুলে ফুলে উঠছে। নাভির পাত্রে মাছেরা গোপন করছে নিজেদের। জল ছুঁয়ে নিচ্ছে আমার শরীর, ভেতরের লোহার দরজাটি যেন খুলে যাচ্ছে ভেতরের দিকে।
মৃত্যু আর আসতে পারছে না শাদা পোশাকে এদিক। কোপাইয়ের জল এসে পা ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর। সরে যাচ্ছে পা।
একটি মেয়ে বলেছিল, বসন্তকালেই মানুষ সবথেকে বেশি আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কেন? তার উত্তর আজও জানি না।
শুধু চোখ বুজে দেখি কোপাইয়ের সেই পাড়, বালি, সাঁওতাল মেয়েটির দু'টি চোখ যেন তালপাতার ছায়া।
শুধুই তৃষ্ণা বেড়ে চলে, গলা কাঠ হয়ে আসে।







মন্তব্যসমূহ

  1. বড় মায়া, বড় তৃষ্ণা এ জীবনভর। তবে কেন বসন্তেই মৃত্যু হাতছানি দেয়। কেন? এ নিমগ্ন আত্মকথন যে শিল্পীই পারে এভাবে আঁকতে...

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য