লুৎফর রহমান
অকাহন
মালোর এই যে বউমা, সত্যি বলতে এর আগে একে আমি দেখেছি ওদের বিয়ের রাতে...একবার!
সেদিন রাত তখন অনেক,দোকানে বসে আছি,এটা ওটা গোচাচ্ছি বাড়ি যাব বলে।
তখনি ঠেলা এক ভ্যান নিয়ে এই বউটা আমার দোকানে এল, সঙ্গে দামড়া গোছের একজন.ভ্যানচালক!
বউটাকে রেখে সে গিয়ে বসল পথের ওধারে। তার বসার ভাব দেখে মনে হল লোকটা সম্পর্কে বউটার ভাসুর গোছের কেউ হবে,আমি চিনিনে।
লোকটা বোধ ভাষ্যিতে বেশ কমা,তাও মনে হল। রাস্তার ওধার বলে নয়,পাড়া হিসাবে সম্পন্ন ও মান্যিপরিবারের একজন বৌকে যে এই রাতে ডাকতারখানায় আনতে পারে, তার কি আমাদের গোচরেই, কাপড় তুলে পাছাটা দুই হাতে আগলে, অমন করে বসে পড়া চলে!
.......আমার নাম পারুল।
বৌটা বলল, আমি হলাম গিয়ে
আপনি চেনবেন, বেচারাম মালো,তার ছেলের বউ!
সত্যি চিনলাম।
আর চিনবই বা না কেন,বেচারাম মালোর কাছে দান নিতে আর খয়রাত নিতে এই দুধরনের মানুষের খুব যাতায়াত।
আমি দ্বিতীয়ধারার মানুষ,কিন্তু সে ত আলাদা কথা।এখনের এই বেপারটা কি! শরীর এমন কার খারাপ হোল,যে এত রাতে ঘরের বৌকেই এভাবে ছুটে আসতে হল! বেচামালোর ছেলের নাম উত্তম,সে ত এখন কোথাকার কোন বিলে বা পুকুরে জাল ও জালুয়া নিয়ে বুকজলে মজে আছে, বেচামালোরও তো এখন এলাকায় থাকার কথাই না...
বলাগড়ে তার মহাজনীঘর,এই ভরা ভাদরে তার তো নাওয়া খাওয়ার সময় জোটে না
অসুস্থ যে হবে,সে সময় সে পাবে কোথায়!
রইল বাকি এই পারুল
বিয়ের আগেও সে ছিল হাত পা ঝাড়া মানুষ,এখনো তাই।
সন্তান আদি হয়েছে বলে তো শুনিনি,তাছাড়া বেচামালো নিজেও তো বৌ মরা এক গেরস্ত...
এ আমি আমার আধকাল থেকে দেখে আসছি!
বউটা বলল
....আপনার এখুনি একবার আমার সঙ্গে
যাওয়া লাগবে।
ধরেন একজনের খুব মার ধোইর হয়েছে,যাকে বলে রাম-বাটাম,ঐ যে ওনাকে দেখছেন...
উনিই বসিয়েছেন সেই ঘাই....!
এখন তার চিকিৎসা দরকার।
যা যা লাগে সঙ্গে নেন,কেননা,আবার এসে যে ওষুধ নেব,তার মানুষ আমি পাব না!
কথাগুলো এত স্পষ্ট, আর,এত সোজা সাপটা যে
শুনে শরীর মন আমার কেমন নাজেহাল ঠেকল!
যদিও দুয়ারবাসনী বলো শিয়ালডাঙা বলো,যেখানেই মুসলমান ও মালোরা ঘরগুনতিতে অধিক হয়ে আছে,সেখানেই
এসব ঘটনা দিন রাত বছরের মত সহজ সরল হয়ে আছে,ব্যাপার সেটা না! ব্যাপারটা আমিই!
কেননা গোটা দিন যায়... রাত যায়.... সামান্য এই দেহ আর আমার এই দোকানটার ওপর দিয়ে রোজ...
শরীর মন কোন কোন দিন এত এলিয়ে
যায় যে ভয় লাগে! বিশেষ করে রাতের ডাক আর মারধোরের ব্যাপার হলে..!
যা হোক,একে বেচামালোর ঘর,তাতে ডাকতে এসেছে ওবাড়ির বউ তাও এই করোনা মানে আকালের রাতে...
তব্ধ মনে রওয়ানা দিলাম।
আমাকে পিছনে আর বউটাকে সামনে বসিয়ে নিয়ে ভ্যানালা-বেটা থামল গিয়ে কুড়োন পুকুর পার করেই! যেন আমি কেউ না,পারুলের সঙ্গে
খানিকটা সলা সেরে নিয়েই যাওয়ার পথটা বদলে নিল লোকটা তাদেরই যৌথ মর্জিতে!
নিজের চোখে দেখিনি তবে শুনেছি উত্তম খুব মাতাল,রাত বিরেতে এবটতলায় ও পানাকুয়োর পাড়ে শিয়াল কুকুরের মত পড়ে থাকে হুশ হারিয়ে!
আর লোকজন গুছিয়ে নিয়ে গিয়ে এই পারুলই নাকি পাঁজাকোলা করে তাকে কুড়িয়ে এনে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয়....
মানে বউ হলে কিহবে,এলাকার আলো ও আল
ভাল ও মন্দ তার ভালই মুখস্ত রাখতে হয়...
এখনো যেন তারই নমুনা পেলাম একটু...!
বটতলা থেকে প্যাডেল ভ্যানটা চলল নওদাবিলের ডানকিনার ঘেঁষা একটা এঁদো পথ ধরে..!
আমি পড়লাম ধন্দে!
এদিকে তো বেচারামের বাড়ি নয়,বাগান!তারো ওধারে ডাকাতেবিল,মানে,মুড়ি মুড়কীর মত যারা মরে,তাদের শ্মশান...!
শোধলাম,এ পথে কেন?
বউটা বলল......রাস্তার মোড়ে লাইট জ্বলে সারারাত! ওপথে গেলে আপনাকে চিনে ফেলবে লোকজন!
ব্যাপার ও মানুষ দুইই গুরুতর,বুঝে, চুপ করে গেলাম।
জল ও জঙ্গলের সাপখোপ বাদে আমাকে
কেই বা অগ্রাহ্যি করে এলাকায়...,ডাকতার না ভাবুক,....হাতুড়ে হিসাবে আমার একটা দর ও সমীহ এলাকার লোকজন দেয়ই....
এই প্রবোধটুকু পেয়ে মনে মনে আরেকটু গুছিয়ে রসলাম,যাতে ভ্যান হড়কে পড়ে না যাই কোনমতে!
ভ্যান গিয়ে পৌঁছল মালোর বাগানেরই আরো একটু নাবালে।এদিকটায় বেচামালো বাগান করেছে অনেকটা জায়গাজুড়ে
চালা ঘরও আছে একটা।
এই চালা ঘরে কোথাকার এক গোঁসাই এসে আস্তানা গাড়ে ফি বছরের মাঘমাসে.... তাও জানি!
জানি বেশকদিন ধরে
কৃষ্ণনামের তখন বন্যা বয়ে যায় অষ্টপ্রহরজুড়ে!
ভ্যানটা বাগানের মাঝখানে রেখে আমাকে নিয়ে গেল ওরা ঘরটার কাছে।
একটা মোম ধরাল ভ্যানালা.... দেশলাই ঠুকে!
সেই অল্প কাঁপা কাঁপা রোগালা আলোয় দেখলাম পিঠ মোড়া দিয়ে বাঁধা একটা জোয়ান মত ছোকরা মেঝেতে আর্ধেক আর বারান্দায় বাকি আর্ধেক হয়ে পড়ে রয়েছে!
মারের চোটে লাল.. তপতপ.... করছে ছেলেটার চোখমুখ।দেখেই বুঝলাম ঐ ভ্যানালা বেটা একে একলাই রামধোনা ধুনেছে...
শক্ত মত কোন কাঠের চেলা দিয়ে,....!
নাহলে আলো জ্বালিয়েই মানুষটা অমন দুম করে আরেকটা লাথি কষাত না ছেলেটার পেটে,
সাহসই পেত না!
ফেটেছে চটেছে কম তবে ছিঁড়ে ছটকে গিয়েছে
পাছা ও পিঠের প্রায় সবটা।
দড়িদড়া খুলে দিল বউটার ঐ ভাসুরই
তখনই জানলাম ছেলেটার নাম অন্ত হালদার
মানেবিলের ওই পারে বাড়ি,বেচা-মালোর যেকজন মাল্লা.......
তাদের একজনের নাম দিবস হালদার।
সেই দিবসেরই ছোটভাই এই অন্ত হালদার!
বেচারামেরই হয়ে কাজ করে যে লোক,এ তার আপন ভাই। নামও বেশ মালোদেরই মত...অন্ত!
সবই ত চেনাজানা মানুষ,তাহলে অন্তকে এমনভাবে মারল কেন আর দরকারই বা পড়ল কেন!
আমি যতদূর জানি,বেচারাম বা তার ছেলে এসময় বিলটানা দেয়,অর্থাৎ আধামাইল লম্বা জাল দিয়ে বিলের একমাথা ঘিরে ঐ জাল লন্বালম্বি টানা হয়
দুদশটা নৌক লাগে এতে
আর খান পঞ্চাশেক লস্কর!
এতে জলে মাছ দৌড়ায়,নোনা কাটে আঁশের,মাছ বাড় বৃদ্ধি পায় দ্রুত!
আসল কথাটা হল এসময় মালোপাড়ার পুরুষ মেলা ভার,তাহলে এই অন্ত এল কোথা থেকে
আর তাকে ধরে মারলই বা আর কে...শুধু ঐ ভেনালা?! এরেই বা এতকাল দেখিনি কেন এলাকায় একদিনো!?
সবচে আশ্চর্য এমন মার যে খেয়েছে যে মানুষটা, তার ব্যথা যন্ত্রণা যাই থাক,মুখে কোন রা নেই এতটুকু!
দুহাঁটুর ভেতরে মাথাটা ঢুকিয়ে অন্ত হালদার,মাঝে মাঝে,কোৎ পাড়ছে খুব!
বোঝা যাচ্ছে কি যেন সে হারিয়ে ফেলেছে কোথাও...খুঁজে মরছে,আপনমনে!
পারুলের যেন আলো হাতে দাঁড়িয়ে থাকাই কাজ! দেহে তার হাত কোনটা মুখ কোনটা... বোঝার যেন কোনই উপায় নেই আলোর আড়ালে নিজেও যে আছে, সেটুকু বোঝানোর কোন গরজ বা দায়ও যেন তার নেই!
ঘরটা
থমথমা...!
এপাশে নওদার বিল ওপাশে ডাকাতেবিল আর শ্মশান....
রাতটুকু শুধু অন্ধকারে, ঝোপে ও ঝোড়ে, ছিঁড়ে পড়ছে বিরল হয়ে, বিঘ্ন হয়ে..!
সেলাই ফোড়াই যা করার করলাম,ওষুধও দিলাম।যেটুকু নৈলে নয়!
পারুলের আনা জামা প্যান্ট হাতঘড়ি গলায় রুপোর মোটা চেন সবই পরল ছেলেটা! এমনকি নতুন একজোড়া জুতোও!
দেখে,অবাক হয়ে,আমি আর মানুষই থাকলাম না যেন! পারুল,আমাকে ঐ ঘরেই আরেকটু দাঁড়াতে বলে অন্তকে তুলে দিল এবার সেই ভ্যানে!
আর মুখটা ঘোমটার ভেতরে সবটুকু সেঁধিয়ে
নিয়ে যাতে আমি কিছুই না শুনতে পারি এমন ভাবে অন্তেকে বলল
.....ও মানুষ,
বড় শোধ নিয়ে নিলাম, মনে রেখ!
জেনো তোমার সন্তান থাকল আমার পেটে!
যাও এখন....
আকাইপুর থেকে..... লাস্ট ট্রেন ধরে... চলে যেও....
যাতে
সকাল দশটার আগে... বেনাপোল টপকে.... চলে যেতে পার চুয়াডাঙা!
অন্ত হালদার বলে মানুষটা দেহে মার তো কম খায়নি। হাতে ও কপালে তো সেলাইই পড়ল দশটা করে...!
সেও দেখি কেমন একবারই মাত্র ফোঁস করল পারুলের কথা শুনে।এবং পারুলেরই কথা মত,আরেকবার দেখেও নিল কোমরে গোঁজা ছোট মত একটা টাকার বান্ডিল!
বোঝা গেল, এ হল পারুলেরই অনুদান, অন্ত হালদারের পথখরচ বা ওপারে গিয়ে জমাখরচ বাবদের টাকা..!
আর তখনি একবার মাত্র
অন্ত হালদার ফোঁপাতেও পারল কেমন যেন,
মাথাটা নিজের বুকে ঠাস ঠাস করে চেপে ধরে
চুল ছিঁড়ে....!
...... বাঁচিয়ে রাখলে যে?
অন্ত বলল, হাতে ওটুকু রাখলে কেন পারুল...?
হাতও ছিল সময়ও ছিল তাহলে
মিটিয়ে দিলে না কেন সবটুকু?!
আমি ত থ!
নওদা বিলের দখিণ দিয়ে অন্তকে নিয়ে
হেদিয়ে গেল পারুলের সেই ভাসুর!
বোঝা গেল,দুয়ারবাসনির বসাকবাড়ির বাগান দিয়ে উঠে ওরা আকাইপুর স্টেশন ধরা করতে চাইছে!
অগত্যা নওদার ঘাট পার করে আর মাদারতলার বাঁদিক দিয়ে আমাকে নিয়ে
ঐ রাতেই আবার বেচারাম মালোর দাওয়ায় এনে বসাল পারুল।
নওদাবিলের এই পশ্চিমে, বাঁকে,যেখানে বেচামালোর ঘর নৌকর মত লম্বা আর খুরুলে
হয়ে আছে তার কত পুবে মালোপাড়ার শেষ আর কত পশ্চিমে মুসলমানপাড়ার শুরু
বোঝা মুশ্কিল!
এবাড়ীর কলঘরটা বড়ঘর দুটো থেকে অত কেন দূরে তার হিসাব কেবল বেচামালোই জানে,আর জানত এই পারুলের পিসি,বোধয়!
বিয়ের আগে যখন পারুলের কিছু ছিল না
মানে শ্বশুর ছিল না মানে স্বামী ছিল না... তখন এখানে একটা ঘর ছিল সেই ঘরে পারুলের পিসি ছিল তার মরণ অবধি...
এখন সেটাও নেই..!
তবু পারুল ঘরে গেল ভেতর বাড়ির পিছন দরোজারও পিছন দিয়ে.!
অনেকক্ষণ বাদে
দুটো বাতাসা আর একগ্লাস জল এনে হাজির হল সে! আলোয় দেখলাম
পারুল কেমন ঝামরে গিয়েছে যেন!
বুঝলাম ঘরে গিয়ে বুক খুব হালকা করে এসেছে সে আর একচোট কেঁদে নিয়ে!
চোখ মুখ যেভাবে বসে গিয়েছে তাতে বুঝলাম কাঁদা কাটার অভ্যাস মানুষটার খুব কম... কিম্বা নেই বললেই হয়!
উত্তম, বেচামালোর একমাত্র ছেলে,স্কুল কলেজের ধার না ধেরেও সে সাজান গোছান যে জীবনটা পেয়েছে পারুলের মত,--শরীরে মনে খুব সচ্ছল--- একটা বউ পেয়েছে যে অনায়াসে
তাতে তার তো পেট কিম্বা চ্যাট,কোনটারই অসুখ থাকার কথা নয়..!
পয়সার ঝোঁকে নেশা করার আয়েস থাকলে আছে বাপের দোহায় দিয়ে.....
মুখ দিয়ে নুন চাটার মত দুপাঁচটা পরঘরে মেয়েমানুষ থাকলেও থাকতে পারে...!
এর কোনটাতেই তো পারুলের মহিমা হারিয়ে কষ্ট পাবার কথা নয়!
কেননা বেচামালোর কিম্বা উত্তমের....
মাছের সঙ্গে মেয়ে মানুষ বস্তুটার ওপরও ঝোঁক প্রায় একি দরের! এবং তা জানেও প্রায় সবাই,মেনেও নেয়, চোখ বুজিয়ে থেকে....!
পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দিল আমার!
উঠলামও।
পারুল দেখি কেমন যেন অবাক হয়ে দেখছে আমাকে এতক্ষণ পর। তাতেই মনটা ,বুকটাও কেমন নরম ঠেকল আমার!
শোধালাম,
......এ তুমি কেন করলে পারুল...?!
ও পারুল
যা শুনলাম,তা যদি সত্যির হয়
তবে অই মানুষটাকে ওভাবে মেরে পঙ্গু করে ছাড়লে কেন!?!তাড়িয়েই বা দিলে কেন জনমের মত?!
জানি পারুল বাংলাদেশী মেয়ে।তার এবাড়ির বিয়েতে বাজারী হাতুড়ে হিসাবে আমারও নিমন্ত্রণ হয়েছিল তাই জানি বেচারাম মালো পারুলকে বৌমা করে এবাড়িতে এনে কতটা
গরীব উদ্ধার করেছিলেন ! দেশ উদ্ধারও!
কেননা বিয়েতে যে আধার কার্ড লাগে চোরা পথে তা বানাতে কতই না খরচ গিয়েছিল.... তা বেচামালোই জানে!
আর জানে খেদাইতলার তপন কাঞ্জিলাল।
মানে এলাকার লোকে, যাকে,ডুপলিকেট তপন বলেও সেই তপন!
লাখোটাকার কারবার হলে কি হবে মালোর সংসার বড় কানা!
নিজের বউ কবে মরেছে, হবে একমাত্র ছেলে উত্তমের বয়স... তখন...দশ কি বারো...!
বেচা আর দ্বার ধরেনি তারপর...!
ছেলে বলো মেয়ে বলো সন্তান ঐ একটা।
তাহলে এমন মানুষের বউমা.. এমন বাড়ির বউ হয়ে পারুলের এ কেমন আশ্চর্য যজমানি!
ঘোর আমার কাটবার নয়!
বাপের ঘর বলে যার কিছু নেই। শুনেছি পারুল মালোদের মেয়েও না।
তার একপিসি থাকতেন এইগাঁয়, এবাড়িতেই!
তিনিই একে বাংলাদেশ থেকে আনিয়ে কদিন রেখে এবাড়ি বিয়ে দিয়েছেন!
পারুলের পিসি সম্পক্কে বেচামালোর কেউ না হোক কিন্তু লোকে বলে তার পিসির যুবতী বয়েস থেকে যতদিন বেঁচে ছিল তার চলা চলতির সবটুকু পারুলের শ্বশুরের কারবারে চলত।
সে তো অনেকেরই চলে,তারও চলত,নেহাত বউ হয়ে পড়ল পারুল.... এবাড়ির,
যা অন্য অনেক দুলে বাগদী মালোদের হওয়া হয়নি!
আবার শোধাতে যাব;
পারুল এবার দাওয়ায় বসে পড়ল,আর,উবজেই বলল
......জানো দাদা,আপনারেই বলি....এই অন্ত আমার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল!
ওর দাদা,....দিবস হালদার,..... জানেন আমাদেরই জালুয়া!
বলতে গেলে আমার শ্বশুর স্বামীর খোদ ডানহাত..!
কিন্তু
এই অন্ত এখনো থাকে ও-বাংলায়।
সেই ছোট কাল থেকে আলাপ! পাশাপাশি বাড়িও ছিল আমাদের।
বাপ মা সব মোরল,পিসি গিয়ে নিয়ে এল আমার!সব কেমন চুকেও গেল।
কিন্তু
বড় বিলাপের মানুষ এই অন্ত হালদার!
এদিকে আমি ত ভাসা শেলা
সারাজীবন জলের ঠেলা খেয়ে মরছি একবার ওপারে তো আরেকবার এপারে....!
ও দাদা, কপালে আছে
বেচামালোর বউমা হবার,তা খন্ডাবে কে,হলও তাই!
আমি ডুবলাম বেচামালোর বিলে।আজ তিনবছর!
আর শুনলাম অই অন্ত হালদার গেল বকে!
গাঁজাভাঙ খায়,মনের ব্যামোয় পড়ে লোকজন মানামানি করে না....কুকাজ করে বেড়ায়!
আবার দুম করেএসে হাজিরও হয়..... যখন তখন....
বর্ডারের চোখে ফাঁকি দিয়ে...!
এবারও এসেছে মাসখানেক হল।
আদর যতন করলাম রাত বিরেতে খুব.....,কিন্তু ভবি তার ভোলার নয়!
আর আমারই বা সাধ্য কি তাকে বাঁধব!
তাই .....
আপনি ডাকতার মানুষ,আপনাকে বলা যা ভগবানকে বলাও তা বলি
এবার ওকে জনমের মত বেঁধেছি.....
যাতে আর ফসকে না যায় আমার কপাল থেকে!
নিয়েছি ওর সন্তান এই পেটে...!
তাই ওকে পঙ্গু করে পাঠিয়ে দিলাম ওপার বাংলায় যাতে আর পা তুলে বর্ডারও টপকাতে না পারে আর বেচা মালোর সংসারে এসে উঁকিও আর না মারতে পারে!
মানুষের মুখ যে এত কালো হয়,কথা বলতে বলতে এতটা ছলছলা হয়...
সত্যি কথা বলতে পারুলকে না দেখলে হয়ত বোঝাই হত না আমার এজন্মে!
ভাল মন্দ রহিত হয়ে বসে আছি!
পারুল আবার বলল
....আমার কেউ নেই দাদা দুনিয়ায়।
সংসারে পড়ে স্বামী পেয়েছি একটা আর শ্বশুর
পেয়েছি একটা!
তারা না আমার হল,না আমি তাদের হতে
পারলাম! স্বামী থাকে জলে আর বিলে...
নেশা তার কাটবার নয়।ভগবান দুটো চোখ দিয়েছিল তাও সে বাপের কানায় পড়ে কানা করে রেখেছে!
বছরে পোষ ফাগুন হয় কিন্তু তার মনে না আছে চাঁদ না আছে সূর্য
উজোন কিম্বা জোয়ার দেহে তার বয় না
আমি শুধু পারুল তার বিছানা বয়েই মরলাম আজ এতগুলো বছর...
তাহলে আমি বাঁচবো কি নিয়ে দাদা?!
বলে খানিক থামল পারুল,একটুক্ষণ মাত্র!
তারপর কপাল বরাবর যে চাঁদ,তার দিকে গলা তুলে বলল
.......এতদিন পর বাঁচার একটা পথ পেয়েছি আমি দাদা!
আপনি তার একমাত্র সাক্ষী
আমি এবার মা হয়ে বাঁচতে পারব
বাকিটা কাল...!
উত্তমের ঘরে বউ হয়ে বাঁচতে কিম্বা বাদী হয়ে বাঁচতে আর আমার কোন জ্বালা কষ্ট থাকবে না!
বলে গলায় আঁচল দিয়ে গড় হয়ে একটা প্রণাম করল আমাকে হঠাৎই!
আমি চমকে লাফিয়ে সরে আসব...
হাসল!
বলল,
ভয় নেই দাদা,আপনার এই বোন কোনদিন
কোন ব্যাপারে দরবার চাইবে না আপনার কাছে গিয়ে!
তবে আশীর্বাদ করবেন,পেটে যাকে ধরেছি তাকে যেন আপন করে পাই!
আপন করে পাই..? মানে...?
সন্তান কখনো কি পরের হয় নাকি
না পর হয়..!!
.. আপন পাই ত মানুষ পাইনে দাদা
মানুষ পাই ত আপন পাইনে....
আমি বাঁচি তাহলি কেবা করে বলেন...!
পারুল যেন মনে মনেই বিড়বিড় করল
আরো খানিক..!
যা হোক
রাতের কথা বেচামালোর বাড়ির চৌহদ্দির কথা ভেবে আমি আর দঁড়ালাম না একটুও,চলে এলাম অন্ধকারে
এ গল্প পারুলের। তার বিছানা বয়ে মরার গল্প। তার বর্ডার পারাপারের গল্প। তার মায়ার গল্প, প্রেমের গল্প, ভ্রূণের গল্পও। এ গল্প কানাহোসেনের দরদী কলমেরও। বড় মায়া তাতে, বড় রহস্য, ঘোর।
উত্তরমুছুনলুৎফর দা'র মার্কামারা ভাষায় ঘোমটা টানা মেয়ের ধারালো জীবনের কথা। পাঠক একবার ঘাটে এসে পড়লে শেষঅবধি যেতে বাধ্য হয়।
উত্তরমুছুনকথার অন্তর থাকে, থাকে অন্তরা আর উৎসমুখ। এপার ওপার থাকে নদীর, জীবনেরও, মাঝামাঝি সমস্ত বোঝাপড়া উথলে উথলে ওঠে, ঢেউ হয়, রুদ্ধ হয়, সমৃদ্ধ হয়, ঋদ্ধ করে অপন পরে। পারুলের অন্তর ছেনে এক দৃশ্যযাত্রা, যা রাতের অন্ধকারে ফিকে হয় না, প্রদীপের মতো জ্বলে, পোড়ে ধিকধিক। যে পোড়া নিভৃতের, যে জ্বলে যাওয়া অন্ত আর পারুলের। মাঝখানে কাঁটাতার পাল্টায় না, পাল্টায় না বেচারামের জল স্থলের ক্ষমতা, মনের অমর্যাদা।
উত্তরমুছুনএক অসামান্য বুনোট, যার অক্ষরের আড়ালে ধুকপুক করে মানুষের কলজে, আদিম। আর নিজস্ব আকুলতায় অনাবিষ্কৃত ভাষায় সেখানে প্রাণসঞ্চার করে চলেন লুৎফর রহমান, রাত থেকে পারুল, ল্যাম্পপোস্ট খেকে ভ্যানওলা, জাল থেকে অন্ত জীবন্ত হয়ে ওঠে, স্মরণীয় রয়ে যায়।