যুগান্তর মিত্র
শিউলি ফুল
একদৃষ্টে হাতের তালুতে থাকা ফুলগুলোর দিকে চুপ করে
তাকিয়ে থাকে অদ্রিজা। মায়ের বিছানায় বসে আছে সে। এখন অবশ্য একে ঠিক বিছানা বলা যায়
না। সিঙ্গেল খাটের মাপের একটা চৌকির ওপর মাদুর পাতা।
ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে এ বাড়িতে মায়ের প্রথমদিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল অদ্রিজার। শিউলি গাছটা নিজের হাতে লাগাতে চেয়েছিলেন মা। শ্বশুরমশাই বাধা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি রাখুন বেয়ান। আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি।’ মা আর না করতে পারেননি। শ্বশুরমশাই মায়ের কাজ হালকা করতেই কথাটা বলেছিলেন কিনা বুঝতে পারে না অদ্রিজা। নাকি নিজেদের বাড়িতে নিজেরাই গাছ লাগাবেন, ‘বাইরের লোকের’ সেই কাজে অধিকার নেই! আসলে শ্বশুরমশাইয়ের বলার ধরনটা ছিল অন্যরকম। খুব সহজ-সরল ভাবে বলা নয়। গাছটা প্রায় কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। মা এসব দেখেশুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। অদ্রিজাকে পরে বলেছিলেন, শত হলেও ওনাদের ঘরবাড়ি। ওনারাই কোথায় লাগাবেন, ঠিক করার মালিক। আমি তো বাইরের লোক!
প্রতিদিন সন্ধ্যায় মায়ের ছোট্ট ঘরটায় যেত অদ্রিজা। সারাদিনে আরও দু-তিনবার যেতেই হত। সকালের টিফিন আর দুপুর ও রাতের খাবার দিতে যেতে হত প্রতিদিন। এছাড়া সন্ধ্যায় চা-বিস্কুট দিতেও যেত সে। রাতে বিছানা পেতে, মশারি টাঙিয়ে দেওয়া বা সকালে বিছানা তোলা, এসবের জন্যও যেতে হত। কিন্তু সন্ধ্যার যাওয়াটা ছিল অন্যরকম আনন্দের। চা না-পেলে মাকে উসখুস করতেন দেখেছে অদ্রিজা। বাড়িতে থাকতে কোনওদিন এইরকম দেখেনি সে। মায়ের কি চায়ের নেশা ছিল? নাকি এই সময়টুকু মেয়ের সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাইতেন? বিস্কুট ছাড়া চা খেতে পারতেন না মা। অদ্রিজার বাঁ হাতে থাকত দুটো মেরি বিস্কুট। এমন ভাবে চায়ের কাপ নিয়ে ধীরে ধীরে নিয়ে যেত মায়ের কাছে, যেন আঙুলে জড়িয়ে রেখেছে কাপ।
সিঁড়ির পাশের এই ঘরটাতেই মাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখানে চৌকির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল সুদীপ্ত। মা চৌকিটাকে বলতেন তক্তাপোষ। তার পাশে রঙ-চটা একটা প্লাস্টিকের চেয়ার আর একটা কাঠের টুল। সেই টুলে চায়ের কাপ রেখে মায়ের হাতে বিস্কুট ধরিয়ে দিত সে। হাত বাড়িয়ে মা যখন কাপটা নিতেন, মুখে অদ্ভুত এক আনন্দ-আলো দেখতে পেত অদ্রিজা। তখনই মায়ের সঙ্গে কিছু কিছু কথা হত। তবে খুব বেশিক্ষণ নয়। চা-বিস্কুট খেতে যেটুকু সময় লাগত, ঐ সময়টুকুই ছিল মায়ের মনের কথা বলার ফুরসত। কিংবা ওটুকু সময়ই অদ্রিজা মাকে দিতে পারত সন্ধ্যায়। অন্য সময়গুলোতে বসে কথা বলার উপায় ছিল না। এ বাড়িতে আসার আগে নাকি রান্নার এক দিদি ছিল। শুনেছে অদ্রিজা। বিয়ের ঠিক আগেই তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। সে নাকি চাল, রান্না করা তরকারি বা মাছ চুরি করত। সুদীপ্ত বা শ্বশুর-শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে গল্পগুজব করা পছন্দ করতেন না। ফলে সন্ধ্যাতেও মায়ের কাছে বেশি সময় বসবার সুযোগ ছিল না তার। ঘরে কাজেরও তো শেষ নেই! সুদীপ্ত আসার আগেই ঘর পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখতে হয়। টানটান বিছানা না-থাকলে ভ্রূ কুঁচকে তাকায় সুদীপ্ত। মুখ ম্লান হয়ে থাকে। ওটুকুতেই ওর অসন্তোষ বুঝিয়ে দেয়। রাতে বিছানায় আসার সময়ও ভালো করে দেখে চাদরে কোথাও কোঁচকানো ভাব আছে কিনা। প্রথম থেকে এসব দেখে দেখে সুদীপ্তর ইচ্ছে-অনিচ্ছে বুঝে নিয়েছে অদ্রিজা। নিজে মুখে কিছুই বলে না সে!
যেদিন মাকে এখানে আনার কথা বলেছিল, সেদিন সুদীপ্ত সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিল, ইচ্ছে হলে আনবে! আমি কী বলব?
তোমাদের বাড়ি। তাই তোমাদের মতামতটা জানা থাকলে… আমতা আমতা করে এটুকু বলে অদ্রিজা একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সুদীপ্তর দিকে। তার দিকে ঘুরে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল সুদীপ্ত। তারপর খুব সংক্ষেপে জানিয়েছিল, ‘বেশ। আনতে পারো।’
এই সম্মতিটুকু কিছুটা হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল অদ্রিজার কাছে। রাজি হওয়াতে মনের ভেতরে একটা নদী কুলকুল করে বয়ে গিয়েছিল সেইসময়। তবু সামান্য সময় পরেই তার মনে হয়েছিল সুদীপ্ত হয়তো চায় না তার শাশুড়ি এখানে এসে থাকুন। শ্বশুর-শাশুড়িও চাইতেন কিনা বুঝতে পারেনি অদ্রিজা। কেমন যেন নিরাসক্ত থাকতেন দুজনেই। কিন্তু অদ্রিজার কোনও উপায় ছিল না। মা একা একা থাকতে পারছিলেন না আর। অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। নুয়ে পড়ছিল শরীর। দুদিন মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। অনেক পরে নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছেন। ফোনে এসব কথা শুনে অদ্রিজার বুকে হু হু হাওয়া ছোটাছুটি করত। এভাবে মাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না ভেবেই উতলা হয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে।
তাহলে তোমাদের বাড়িটার কী হবে? তালা মেরে রেখে দেবে? কেটে কেটে কথাগুলো ভাসিয়ে দিয়েছিল সুদীপ্ত।
ও কি জানতে চাইছিল মা আর ফিরে যাবেন কিনা বাড়িতে? হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। সংশয় নিয়েই অদ্রিজা জবাব দিয়েছিল, বাড়ি বলতে ঐ তো ছোট্ট একটা আস্তানা। ওটাকে রেখে আর কী হবে? আমাদের কোনও আত্মীয়স্বজন কি আছে তেমন? বাবা চলে যাওয়ার পরে সবাই তো সরে গেছে আমাদের থেকে! তেমন বুঝলে বাড়িটা বিক্রি করে দিতে হবে।
‘হুম।’ এইটুকু কথায় কিছুই বোঝা যায়নি। তবে সুদীপ্তই বাড়ি বিক্রির যাবতীয় বন্দোবস্ত করেছিল। দালাল ঠিক করা, তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, দরদস্তুর করা, উকিলের সঙ্গে কথা বলা, সব একাই করেছে। বাড়িঘর যেমনই হোক, জায়গা ছিল অনেকটাই। চার কাঠা। ফলে প্রোমোটার লুফে নিয়েছিল বলা যায়। অত দূরে আর ফ্ল্যাট নিতে চায়নি সুদীপ্ত। তাই টাকার অঙ্ক বেশিই ছিল। অবশ্য জায়গাজমি বিক্রির ব্যাপার ফাইনাল হওয়ার পরে জানিয়েছিল অদ্রিজাকে। তার আগে চুপচাপই ছিল।
মাকে নিয়ে আসার দিন কয়েক আগে, তিন-চারদিন মায়ের কাছে গিয়েছিল দুজনেই। বাড়ির প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সবকিছু দেখে নেওয়ার জন্য। অদ্রিজাদের ছিল একটা সুন্দর খাট। বাবার খুব শখের জিনিস। আর ছিল একটা কাঠের আলমারি, মিটসেফ, দুটো কাঠের চেয়ার আর একটা টেবিল। আসবাব বলতে এটুকুই। নিয়ে আসার অনেক হ্যাপা। তাছাড়া এ বাড়িতে ওসব রাখার মতো জায়গাও নেই। জানিয়েছিল সুদীপ্ত। অনেকগুলো গাছ ছিল বাড়িতে। আম, কাঁঠাল, সবেদা, চালতা, নারকেল, সুপারি ছাড়াও ছিল আরও নানা গাছ। বাবা গাছগুলোর খুব যত্ন নিতেন। সেইসব গাছপালা আর আসবাব সহই বিক্রি হয়েছিল। প্রোমোটারের থেকে অনেক টাকা পাওয়া গিয়েছিল। আর এর সব কৃতিত্ব সুদীপ্তর একার। টাকাটা সুদীপ্ত আর অদ্রিজার জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে রাখা আছে।
গাড়িভাড়া করে গিয়ে মাকে যেদিন নিয়ে এল শ্বশুরবাড়িতে, সেদিন সামান্য কিছু জিনিস গাড়িতে তুলে এনেছিল সুদীপ্ত। অদ্রিজাও হাত লাগিয়েছিল। মা আসার সময় ভেজা গামছায় জড়িয়ে একটা ছোট্ট শিউলির চারা সঙ্গে এনেছিলেন।
এটা নিচ্ছ কেন মা?
এই বাড়ির একটা কিছু থাক আমার সঙ্গে। জীবন্ত কিছু। কথাটা প্রায় ফিসফিস করে বলেছিলেন মা। অদ্রিজা জানে শিউলি গাছটাও ছিল বাবার প্রিয়। শরতে যখন ফুল ফুটত, তখন গাছের দিকে মুখ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেন বাবা।
মায়ের আনা চারাগাছটা যখন পরদিন সকালে ছোট্ট বাগানে নিজের হাতে লাগাতে গিয়েছিলেন, সেইসময় শ্বশুরমশাই মায়ের হাত থেকে গাছটা কেড়ে নিয়ে নিজেই পুঁতে দিয়েছিলেন বাগানের একধারে।
শিউলি ফুলগুলো হাতে নিয়ে নানা কথা ভেবে যাচ্ছে অদ্রিজা। সকালে দেখেছিল শ্বশুরমশাই সাদা ধুতি পরে গঙ্গায় গেলেন তর্পণ করতে। তখনই মনে হয়েছিল অদ্রিজার, মায়ের জন্য তর্পণ করা যায় না? এইরকম কোনও নিয়ম নেই বোধহয় শাস্ত্রে! এ বাড়িতে মহিলাদের বাৎসরিক কাজ করারও রীতি নেই। শাশুড়ি জানিয়ে দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে।
কোনও কোনও সন্ধ্যায় মায়ের কাছে একটু বেশি সময় থাকতে হত। সেই দিনে মা বলতেন, ‘আলোটা নিভিয়ে দে মুনু।’ প্রথমদিকে অবাক হত সে। পরের দিকে অদ্রিজা বুঝে গিয়েছিল, মা সেদিন বাবার কথা বলতে চাইতেন। কিংবা কোনও দুঃখযন্ত্রণার কথা। বাবার কথা বলার সময় মায়ের সারা গায়ে একটা আলোর প্রলেপ দেখত সে।
বাবা কিন্তু সবসময় উদাসীন ছিল। তাই না মা? কীভাবে তুমি সংসার চালাচ্ছ, সেদিকে খেয়াল রাখত না। শুধু নিজের বাগানের গাছগাছালির সঙ্গেই বাবার যত যোগাযোগ ছিল। আমি কোন ক্লাশে পড়ি, সেটাও কোনওদিন ঠিকঠাক বলতে পারেনি কাউকে।
ওমন করে বলিস না মুনু! তোর বাবা অন্য ধারার মানুষ ছিলেন। কোনওদিন লোকটা আমার বা তোর ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবতেন কিনা তার প্রকাশ ছিল না। নিশ্চয়ই ভাবতেন। না হলে সংসারের দরকারি সবই মজুত করতেন কেন? নীরবে করে যেতেন। মনে হত যেন কোনও তাপউত্তাপ নেই। উনি ছিলেন আমাদের আশ্রয়ের মতো।
সংসার করতে হলে এটুকু তো করতেই হয়! এর বাইরে কি তেমন কোনও আগ্রহ ছিল আমাদের নিয়ে?
মুনু রে, এইসব কথা বলতে নেই মরা মানুষকে নিয়ে। বেসরকারি চাকরি করতেন। মাইনে তো বেশি ছিল না। তবু চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। পেরে উঠতেন না সেভাবে। সেইজন্যই বোধহয় ছুটির দিনে গাছপালায় মুখ লুকোতেন!
মা কি অন্ধকারে কান্না লুকোতেন? অদ্রিজা বুঝতে পারত, মায়ের গলা ধরে আসত কখনো-কখনো। একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বাবা আর তুমি কোনওদিন দুজনে বসে গল্প করেছ মা?
ওমা! কী বলিস? কেন করব না?
আমি তো কোনওদিনই দেখিনি!
গল্প মানে সংসারের নানা কথা। কী লাগবে, না লাগবে, সেইসব। এর বাইরে আর কী কথা থাকে?
ভালোবাসার কথা বলত না বাবা?
এসব কি বলার কথা রে মুনু? বুঝে নিতে হয়।
আচ্ছা, তাহলে বলো, বাবা তোমাকে ভালোবাসত?
কী জানি! বাসত বোধহয়। না-হলে এতটা দিন একসাথে থাকা যায়?
অনেক সময় অভ্যেসে সব হয়ে যায় মা। তার জন্য ভালোবাসতে হয় না।
মা অনেকক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়েছিলেন, অন্ধকারেও ঠিক বুঝতে পেরেছিল অদ্রিজা। তারপর খুব আস্তে, নরম গলায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তুই এখানে খুব ভালো নেই, তাই না মুনু?
না না মা, আমি তো ভালোই আছি। খুব ভালো আছি।
মায়ের দীর্ঘনিঃশ্বাস টের পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিল অদ্রিজা। চায়ের কাপ তুলে, আলো জ্বালিয়ে চলে এসেছিল ঘরে।
মা এখানে আসতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। মধু কাকাও বলেছিলেন, এই বয়সে বউঠানরে নিয়া টানাটানি না-করলেই পারিস মা!
বাবার সঙ্গে এক অফিসে কাজ করতেন মধু কাকা। সেই সুবাদে অদ্রিজাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। মাকে মধু কাকা বউঠান ডাকতেন। এখান থেকে কিছুটা দূরে কাকার বাড়ি। কীভাবে যেন শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে মধু কাকার পরিচিতি ছিল। তাঁর যোগাযোগেই এখানে বউ হয়ে এসেছিল অদ্রিজা। মধু কাকা সবসময় বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। মাকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত পাকা হওয়ার পরে একদিন কাকা বলেছিলেন, এইখানে বউঠানরে আনা উচিত হয় নাই মা! এরা খুব উদ্ধত। আগে বুঝি নাই। তোর বিয়ার পরে বুজছি।
পুরো একটা বছরও মা এবাড়িতে কাটাননি। তার আগেই চলে গেছেন। ‘আমি না-থাকলেও এই গাছটা থাকবে। এর মধ্যেই আমাকে পাবি মুনু।’ একদিন সন্ধ্যার আলাপচারিতায় মা বলেছিলেন। অদ্রিজা কথাটা মনের অন্দরে সাজিয়ে রেখেছে। সে তাই শিউলি গাছটার কাছে নিজের সুখদুঃখের কথা বলে মাঝে মাঝে। যেন মাকেই বলছে।
আজ ভোরে কিছু শিউলি ফুল তুলে এনে মায়ের ঘরে রেখেছিল অদ্রিজা। রেডিওতে ভেসে আসছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ। মৃত্যুর ঠিক দু-দিন আগের দুপুরে শরীরটা খারাপ লাগছিল মায়ের। সেদিনই সন্ধ্যার পরে কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার দেখে কোনও ভরসা দিতে পারেননি। মাঝে একদিন ওভাবেই কেটে গিয়েছিল। তারপর তৃতীয় দিন ভোরে মা চলে গেলেন! সেইসময়ও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল মহিষাসুরমর্দিনীর গান।
মায়ের মৃত্যুর পরে শ্বশুরমশাইয়ের নির্দেশে ঘরটা বন্ধ করে রাখা ছিল। অদ্রিজার অনুরোধে গতকালই খুলে দিয়েছে সুদীপ্ত। ঘরটা সাফসুতরো করেছে অদ্রিজা। এই ইচ্ছেটুকু মেনে নেওয়ায় সুদীপ্তর প্রতি কৃতজ্ঞ সে।
সারাদিনই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মায়ের কথা ভেবেছে আজ। সন্ধ্যা নেমে আসার পরে মায়ের ঘরে এসে ঢুকেছে। সে যে এঘরে আছে, শ্বশুর-শাশুড়ি বা সুদীপ্তর অজানা নয়। শাশুড়িকে রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ হাতে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরের দিকে যেতে দেখেছে অদ্রিজা। চা করার জন্য তাকে ডাকেননি। আজ এটুকু তাঁরা কেন যেন মেনে নিয়েছেন। একদিকে ভালোই হয়েছে! ভাবে অদ্রিজা।
এই ঘরটায় আলো নেই অনেকদিন হল। তাই অদ্রিজা একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। মায়ের কোনও ছবি নেই। কোনওদিনই তোলা হয়নি। বাবা-মায়ের বিয়ের ছবিটা ওবাড়ি থেকে আসার সময় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছবি না থাকুক, মায়ের স্পর্শমাখা চৌকিটা তো আছে! তার এক কোণে শিউলি ফুলগুলো রেখেছিল।
প্রদীপের কাঁপা কাঁপা আলোয় মা কি তাকে দেখছিলেন এতক্ষণ? একবার মনে হয় ‘মুনু’ বলে ডেকেও উঠেছিলেন। অস্পষ্ট ডাক তার কানে ভেসে এসেছিল।
সময় বয়ে যাচ্ছে। আর বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক হবে না। হয়তো এর জন্য তির্যক মন্তব্য শুনতে হতে পারে। কথাটা ভেবেই উঠে পড়ে অদ্রিজা। দু-হাতের অঞ্জলিতে কিছু শিউলি ফুল নিয়ে মায়ের ঘর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে সে। তারপর গাছের গোড়ায় ফুলগুলো অতি যত্নে রেখে দেয়। অদ্রিজা ভাবে, তর্পণের জন্য কোনও মন্ত্রোচ্চারণ করা কি খুব জরুরি!
নিশ্চুপে ঘরে ফেরার সময় একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে গাছটাকে। মা নিশ্চয়ই গাছটার সঙ্গে মিশে আছেন! তার দেওয়া ফুলগুলো মাকে স্পর্শ করছে ভেবে খুশি হয় সে। শরতের মৃদু হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে দেয় অদ্রিজার সারা শরীর। হাওয়ায় ভেসে আসে মায়ের কণ্ঠস্বর, ‘মাঝে মাঝে নিজের দাবির কথাও জানাতে হয় মুনু! মনে রাখিস মা।’
নিজেদের ঘরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিছানায়। হু হু কান্না আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে তাকে। সেই সঙ্গে শিউলির গন্ধ তার শরীরে জড়িয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারে অদ্রিজা।
ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে এ বাড়িতে মায়ের প্রথমদিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল অদ্রিজার। শিউলি গাছটা নিজের হাতে লাগাতে চেয়েছিলেন মা। শ্বশুরমশাই বাধা দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি রাখুন বেয়ান। আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি।’ মা আর না করতে পারেননি। শ্বশুরমশাই মায়ের কাজ হালকা করতেই কথাটা বলেছিলেন কিনা বুঝতে পারে না অদ্রিজা। নাকি নিজেদের বাড়িতে নিজেরাই গাছ লাগাবেন, ‘বাইরের লোকের’ সেই কাজে অধিকার নেই! আসলে শ্বশুরমশাইয়ের বলার ধরনটা ছিল অন্যরকম। খুব সহজ-সরল ভাবে বলা নয়। গাছটা প্রায় কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি। মা এসব দেখেশুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। অদ্রিজাকে পরে বলেছিলেন, শত হলেও ওনাদের ঘরবাড়ি। ওনারাই কোথায় লাগাবেন, ঠিক করার মালিক। আমি তো বাইরের লোক!
প্রতিদিন সন্ধ্যায় মায়ের ছোট্ট ঘরটায় যেত অদ্রিজা। সারাদিনে আরও দু-তিনবার যেতেই হত। সকালের টিফিন আর দুপুর ও রাতের খাবার দিতে যেতে হত প্রতিদিন। এছাড়া সন্ধ্যায় চা-বিস্কুট দিতেও যেত সে। রাতে বিছানা পেতে, মশারি টাঙিয়ে দেওয়া বা সকালে বিছানা তোলা, এসবের জন্যও যেতে হত। কিন্তু সন্ধ্যার যাওয়াটা ছিল অন্যরকম আনন্দের। চা না-পেলে মাকে উসখুস করতেন দেখেছে অদ্রিজা। বাড়িতে থাকতে কোনওদিন এইরকম দেখেনি সে। মায়ের কি চায়ের নেশা ছিল? নাকি এই সময়টুকু মেয়ের সঙ্গে দুটো কথা বলতে চাইতেন? বিস্কুট ছাড়া চা খেতে পারতেন না মা। অদ্রিজার বাঁ হাতে থাকত দুটো মেরি বিস্কুট। এমন ভাবে চায়ের কাপ নিয়ে ধীরে ধীরে নিয়ে যেত মায়ের কাছে, যেন আঙুলে জড়িয়ে রেখেছে কাপ।
সিঁড়ির পাশের এই ঘরটাতেই মাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখানে চৌকির বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল সুদীপ্ত। মা চৌকিটাকে বলতেন তক্তাপোষ। তার পাশে রঙ-চটা একটা প্লাস্টিকের চেয়ার আর একটা কাঠের টুল। সেই টুলে চায়ের কাপ রেখে মায়ের হাতে বিস্কুট ধরিয়ে দিত সে। হাত বাড়িয়ে মা যখন কাপটা নিতেন, মুখে অদ্ভুত এক আনন্দ-আলো দেখতে পেত অদ্রিজা। তখনই মায়ের সঙ্গে কিছু কিছু কথা হত। তবে খুব বেশিক্ষণ নয়। চা-বিস্কুট খেতে যেটুকু সময় লাগত, ঐ সময়টুকুই ছিল মায়ের মনের কথা বলার ফুরসত। কিংবা ওটুকু সময়ই অদ্রিজা মাকে দিতে পারত সন্ধ্যায়। অন্য সময়গুলোতে বসে কথা বলার উপায় ছিল না। এ বাড়িতে আসার আগে নাকি রান্নার এক দিদি ছিল। শুনেছে অদ্রিজা। বিয়ের ঠিক আগেই তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। সে নাকি চাল, রান্না করা তরকারি বা মাছ চুরি করত। সুদীপ্ত বা শ্বশুর-শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে গল্পগুজব করা পছন্দ করতেন না। ফলে সন্ধ্যাতেও মায়ের কাছে বেশি সময় বসবার সুযোগ ছিল না তার। ঘরে কাজেরও তো শেষ নেই! সুদীপ্ত আসার আগেই ঘর পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখতে হয়। টানটান বিছানা না-থাকলে ভ্রূ কুঁচকে তাকায় সুদীপ্ত। মুখ ম্লান হয়ে থাকে। ওটুকুতেই ওর অসন্তোষ বুঝিয়ে দেয়। রাতে বিছানায় আসার সময়ও ভালো করে দেখে চাদরে কোথাও কোঁচকানো ভাব আছে কিনা। প্রথম থেকে এসব দেখে দেখে সুদীপ্তর ইচ্ছে-অনিচ্ছে বুঝে নিয়েছে অদ্রিজা। নিজে মুখে কিছুই বলে না সে!
যেদিন মাকে এখানে আনার কথা বলেছিল, সেদিন সুদীপ্ত সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়েছিল, ইচ্ছে হলে আনবে! আমি কী বলব?
তোমাদের বাড়ি। তাই তোমাদের মতামতটা জানা থাকলে… আমতা আমতা করে এটুকু বলে অদ্রিজা একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সুদীপ্তর দিকে। তার দিকে ঘুরে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল সুদীপ্ত। তারপর খুব সংক্ষেপে জানিয়েছিল, ‘বেশ। আনতে পারো।’
এই সম্মতিটুকু কিছুটা হলেও অপ্রত্যাশিত ছিল অদ্রিজার কাছে। রাজি হওয়াতে মনের ভেতরে একটা নদী কুলকুল করে বয়ে গিয়েছিল সেইসময়। তবু সামান্য সময় পরেই তার মনে হয়েছিল সুদীপ্ত হয়তো চায় না তার শাশুড়ি এখানে এসে থাকুন। শ্বশুর-শাশুড়িও চাইতেন কিনা বুঝতে পারেনি অদ্রিজা। কেমন যেন নিরাসক্ত থাকতেন দুজনেই। কিন্তু অদ্রিজার কোনও উপায় ছিল না। মা একা একা থাকতে পারছিলেন না আর। অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। নুয়ে পড়ছিল শরীর। দুদিন মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। অনেক পরে নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছেন। ফোনে এসব কথা শুনে অদ্রিজার বুকে হু হু হাওয়া ছোটাছুটি করত। এভাবে মাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখা যাবে না ভেবেই উতলা হয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে।
তাহলে তোমাদের বাড়িটার কী হবে? তালা মেরে রেখে দেবে? কেটে কেটে কথাগুলো ভাসিয়ে দিয়েছিল সুদীপ্ত।
ও কি জানতে চাইছিল মা আর ফিরে যাবেন কিনা বাড়িতে? হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। সংশয় নিয়েই অদ্রিজা জবাব দিয়েছিল, বাড়ি বলতে ঐ তো ছোট্ট একটা আস্তানা। ওটাকে রেখে আর কী হবে? আমাদের কোনও আত্মীয়স্বজন কি আছে তেমন? বাবা চলে যাওয়ার পরে সবাই তো সরে গেছে আমাদের থেকে! তেমন বুঝলে বাড়িটা বিক্রি করে দিতে হবে।
‘হুম।’ এইটুকু কথায় কিছুই বোঝা যায়নি। তবে সুদীপ্তই বাড়ি বিক্রির যাবতীয় বন্দোবস্ত করেছিল। দালাল ঠিক করা, তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, দরদস্তুর করা, উকিলের সঙ্গে কথা বলা, সব একাই করেছে। বাড়িঘর যেমনই হোক, জায়গা ছিল অনেকটাই। চার কাঠা। ফলে প্রোমোটার লুফে নিয়েছিল বলা যায়। অত দূরে আর ফ্ল্যাট নিতে চায়নি সুদীপ্ত। তাই টাকার অঙ্ক বেশিই ছিল। অবশ্য জায়গাজমি বিক্রির ব্যাপার ফাইনাল হওয়ার পরে জানিয়েছিল অদ্রিজাকে। তার আগে চুপচাপই ছিল।
মাকে নিয়ে আসার দিন কয়েক আগে, তিন-চারদিন মায়ের কাছে গিয়েছিল দুজনেই। বাড়ির প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় সবকিছু দেখে নেওয়ার জন্য। অদ্রিজাদের ছিল একটা সুন্দর খাট। বাবার খুব শখের জিনিস। আর ছিল একটা কাঠের আলমারি, মিটসেফ, দুটো কাঠের চেয়ার আর একটা টেবিল। আসবাব বলতে এটুকুই। নিয়ে আসার অনেক হ্যাপা। তাছাড়া এ বাড়িতে ওসব রাখার মতো জায়গাও নেই। জানিয়েছিল সুদীপ্ত। অনেকগুলো গাছ ছিল বাড়িতে। আম, কাঁঠাল, সবেদা, চালতা, নারকেল, সুপারি ছাড়াও ছিল আরও নানা গাছ। বাবা গাছগুলোর খুব যত্ন নিতেন। সেইসব গাছপালা আর আসবাব সহই বিক্রি হয়েছিল। প্রোমোটারের থেকে অনেক টাকা পাওয়া গিয়েছিল। আর এর সব কৃতিত্ব সুদীপ্তর একার। টাকাটা সুদীপ্ত আর অদ্রিজার জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে রাখা আছে।
গাড়িভাড়া করে গিয়ে মাকে যেদিন নিয়ে এল শ্বশুরবাড়িতে, সেদিন সামান্য কিছু জিনিস গাড়িতে তুলে এনেছিল সুদীপ্ত। অদ্রিজাও হাত লাগিয়েছিল। মা আসার সময় ভেজা গামছায় জড়িয়ে একটা ছোট্ট শিউলির চারা সঙ্গে এনেছিলেন।
এটা নিচ্ছ কেন মা?
এই বাড়ির একটা কিছু থাক আমার সঙ্গে। জীবন্ত কিছু। কথাটা প্রায় ফিসফিস করে বলেছিলেন মা। অদ্রিজা জানে শিউলি গাছটাও ছিল বাবার প্রিয়। শরতে যখন ফুল ফুটত, তখন গাছের দিকে মুখ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতেন বাবা।
মায়ের আনা চারাগাছটা যখন পরদিন সকালে ছোট্ট বাগানে নিজের হাতে লাগাতে গিয়েছিলেন, সেইসময় শ্বশুরমশাই মায়ের হাত থেকে গাছটা কেড়ে নিয়ে নিজেই পুঁতে দিয়েছিলেন বাগানের একধারে।
শিউলি ফুলগুলো হাতে নিয়ে নানা কথা ভেবে যাচ্ছে অদ্রিজা। সকালে দেখেছিল শ্বশুরমশাই সাদা ধুতি পরে গঙ্গায় গেলেন তর্পণ করতে। তখনই মনে হয়েছিল অদ্রিজার, মায়ের জন্য তর্পণ করা যায় না? এইরকম কোনও নিয়ম নেই বোধহয় শাস্ত্রে! এ বাড়িতে মহিলাদের বাৎসরিক কাজ করারও রীতি নেই। শাশুড়ি জানিয়ে দিয়েছিলেন কিছুদিন আগে।
কোনও কোনও সন্ধ্যায় মায়ের কাছে একটু বেশি সময় থাকতে হত। সেই দিনে মা বলতেন, ‘আলোটা নিভিয়ে দে মুনু।’ প্রথমদিকে অবাক হত সে। পরের দিকে অদ্রিজা বুঝে গিয়েছিল, মা সেদিন বাবার কথা বলতে চাইতেন। কিংবা কোনও দুঃখযন্ত্রণার কথা। বাবার কথা বলার সময় মায়ের সারা গায়ে একটা আলোর প্রলেপ দেখত সে।
বাবা কিন্তু সবসময় উদাসীন ছিল। তাই না মা? কীভাবে তুমি সংসার চালাচ্ছ, সেদিকে খেয়াল রাখত না। শুধু নিজের বাগানের গাছগাছালির সঙ্গেই বাবার যত যোগাযোগ ছিল। আমি কোন ক্লাশে পড়ি, সেটাও কোনওদিন ঠিকঠাক বলতে পারেনি কাউকে।
ওমন করে বলিস না মুনু! তোর বাবা অন্য ধারার মানুষ ছিলেন। কোনওদিন লোকটা আমার বা তোর ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবতেন কিনা তার প্রকাশ ছিল না। নিশ্চয়ই ভাবতেন। না হলে সংসারের দরকারি সবই মজুত করতেন কেন? নীরবে করে যেতেন। মনে হত যেন কোনও তাপউত্তাপ নেই। উনি ছিলেন আমাদের আশ্রয়ের মতো।
সংসার করতে হলে এটুকু তো করতেই হয়! এর বাইরে কি তেমন কোনও আগ্রহ ছিল আমাদের নিয়ে?
মুনু রে, এইসব কথা বলতে নেই মরা মানুষকে নিয়ে। বেসরকারি চাকরি করতেন। মাইনে তো বেশি ছিল না। তবু চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি। পেরে উঠতেন না সেভাবে। সেইজন্যই বোধহয় ছুটির দিনে গাছপালায় মুখ লুকোতেন!
মা কি অন্ধকারে কান্না লুকোতেন? অদ্রিজা বুঝতে পারত, মায়ের গলা ধরে আসত কখনো-কখনো। একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বাবা আর তুমি কোনওদিন দুজনে বসে গল্প করেছ মা?
ওমা! কী বলিস? কেন করব না?
আমি তো কোনওদিনই দেখিনি!
গল্প মানে সংসারের নানা কথা। কী লাগবে, না লাগবে, সেইসব। এর বাইরে আর কী কথা থাকে?
ভালোবাসার কথা বলত না বাবা?
এসব কি বলার কথা রে মুনু? বুঝে নিতে হয়।
আচ্ছা, তাহলে বলো, বাবা তোমাকে ভালোবাসত?
কী জানি! বাসত বোধহয়। না-হলে এতটা দিন একসাথে থাকা যায়?
অনেক সময় অভ্যেসে সব হয়ে যায় মা। তার জন্য ভালোবাসতে হয় না।
মা অনেকক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়েছিলেন, অন্ধকারেও ঠিক বুঝতে পেরেছিল অদ্রিজা। তারপর খুব আস্তে, নরম গলায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তুই এখানে খুব ভালো নেই, তাই না মুনু?
না না মা, আমি তো ভালোই আছি। খুব ভালো আছি।
মায়ের দীর্ঘনিঃশ্বাস টের পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিল অদ্রিজা। চায়ের কাপ তুলে, আলো জ্বালিয়ে চলে এসেছিল ঘরে।
মা এখানে আসতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। মধু কাকাও বলেছিলেন, এই বয়সে বউঠানরে নিয়া টানাটানি না-করলেই পারিস মা!
বাবার সঙ্গে এক অফিসে কাজ করতেন মধু কাকা। সেই সুবাদে অদ্রিজাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। মাকে মধু কাকা বউঠান ডাকতেন। এখান থেকে কিছুটা দূরে কাকার বাড়ি। কীভাবে যেন শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে মধু কাকার পরিচিতি ছিল। তাঁর যোগাযোগেই এখানে বউ হয়ে এসেছিল অদ্রিজা। মধু কাকা সবসময় বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। মাকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত পাকা হওয়ার পরে একদিন কাকা বলেছিলেন, এইখানে বউঠানরে আনা উচিত হয় নাই মা! এরা খুব উদ্ধত। আগে বুঝি নাই। তোর বিয়ার পরে বুজছি।
পুরো একটা বছরও মা এবাড়িতে কাটাননি। তার আগেই চলে গেছেন। ‘আমি না-থাকলেও এই গাছটা থাকবে। এর মধ্যেই আমাকে পাবি মুনু।’ একদিন সন্ধ্যার আলাপচারিতায় মা বলেছিলেন। অদ্রিজা কথাটা মনের অন্দরে সাজিয়ে রেখেছে। সে তাই শিউলি গাছটার কাছে নিজের সুখদুঃখের কথা বলে মাঝে মাঝে। যেন মাকেই বলছে।
আজ ভোরে কিছু শিউলি ফুল তুলে এনে মায়ের ঘরে রেখেছিল অদ্রিজা। রেডিওতে ভেসে আসছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ। মৃত্যুর ঠিক দু-দিন আগের দুপুরে শরীরটা খারাপ লাগছিল মায়ের। সেদিনই সন্ধ্যার পরে কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার দেখে কোনও ভরসা দিতে পারেননি। মাঝে একদিন ওভাবেই কেটে গিয়েছিল। তারপর তৃতীয় দিন ভোরে মা চলে গেলেন! সেইসময়ও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল মহিষাসুরমর্দিনীর গান।
মায়ের মৃত্যুর পরে শ্বশুরমশাইয়ের নির্দেশে ঘরটা বন্ধ করে রাখা ছিল। অদ্রিজার অনুরোধে গতকালই খুলে দিয়েছে সুদীপ্ত। ঘরটা সাফসুতরো করেছে অদ্রিজা। এই ইচ্ছেটুকু মেনে নেওয়ায় সুদীপ্তর প্রতি কৃতজ্ঞ সে।
সারাদিনই কাজের ফাঁকে ফাঁকে মায়ের কথা ভেবেছে আজ। সন্ধ্যা নেমে আসার পরে মায়ের ঘরে এসে ঢুকেছে। সে যে এঘরে আছে, শ্বশুর-শাশুড়ি বা সুদীপ্তর অজানা নয়। শাশুড়িকে রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ হাতে শ্বশুরমশাইয়ের ঘরের দিকে যেতে দেখেছে অদ্রিজা। চা করার জন্য তাকে ডাকেননি। আজ এটুকু তাঁরা কেন যেন মেনে নিয়েছেন। একদিকে ভালোই হয়েছে! ভাবে অদ্রিজা।
এই ঘরটায় আলো নেই অনেকদিন হল। তাই অদ্রিজা একটা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। মায়ের কোনও ছবি নেই। কোনওদিনই তোলা হয়নি। বাবা-মায়ের বিয়ের ছবিটা ওবাড়ি থেকে আসার সময় খুঁজে পাওয়া যায়নি। ছবি না থাকুক, মায়ের স্পর্শমাখা চৌকিটা তো আছে! তার এক কোণে শিউলি ফুলগুলো রেখেছিল।
প্রদীপের কাঁপা কাঁপা আলোয় মা কি তাকে দেখছিলেন এতক্ষণ? একবার মনে হয় ‘মুনু’ বলে ডেকেও উঠেছিলেন। অস্পষ্ট ডাক তার কানে ভেসে এসেছিল।
সময় বয়ে যাচ্ছে। আর বেশিক্ষণ বসে থাকা ঠিক হবে না। হয়তো এর জন্য তির্যক মন্তব্য শুনতে হতে পারে। কথাটা ভেবেই উঠে পড়ে অদ্রিজা। দু-হাতের অঞ্জলিতে কিছু শিউলি ফুল নিয়ে মায়ের ঘর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে সে। তারপর গাছের গোড়ায় ফুলগুলো অতি যত্নে রেখে দেয়। অদ্রিজা ভাবে, তর্পণের জন্য কোনও মন্ত্রোচ্চারণ করা কি খুব জরুরি!
নিশ্চুপে ঘরে ফেরার সময় একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে গাছটাকে। মা নিশ্চয়ই গাছটার সঙ্গে মিশে আছেন! তার দেওয়া ফুলগুলো মাকে স্পর্শ করছে ভেবে খুশি হয় সে। শরতের মৃদু হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে দেয় অদ্রিজার সারা শরীর। হাওয়ায় ভেসে আসে মায়ের কণ্ঠস্বর, ‘মাঝে মাঝে নিজের দাবির কথাও জানাতে হয় মুনু! মনে রাখিস মা।’
নিজেদের ঘরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিছানায়। হু হু কান্না আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরে তাকে। সেই সঙ্গে শিউলির গন্ধ তার শরীরে জড়িয়ে যাচ্ছে, বুঝতে পারে অদ্রিজা।
যুগান্তর বাবুর "শিউলি ফুল" পড়লাম। মানব চরিত্র সম্পর্কে অসাধারণ পর্যবেক্ষণ। খুব ভালো লাগলো। ধন্যবাদ🌹
উত্তরমুছুনঅনেক ধন্যবাদ মেঘনাথবাবু।
মুছুনখুবই ভালো লাগলো গো
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা অনেক।
মুছুনএমন লেখা পড়লে গভীর থেকে কান্না আসে। ভালো লেগেছে।
উত্তরমুছুনভালোবাসা।
মুছুনপড়ে খুব ভালো লাগলো দাদা ভাই। অদ্রিজার জন্য মনটা খারাপ হলো।
উত্তরমুছুনতবুও বলবো লেখাটা ভালো হয়েছে।
ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন দীর্ঘজীবী হোন।
ভালো থাকবেন।
মুছুনভালো লেখা। তবে কোনো নতুনত্ব নেই। মাঁয়ের কোনো ছবি না থাকার সাথে শিউলি ফুলের contrast টা খুব একটা ভালো লাগেনি। মন্তব্য একান্ত নিজস্ব।
উত্তরমুছুনবেশ। আপনি পড়ে মতামত দিয়েছেন, আমাকে ভাবার সুযোগ দিয়েছেন, এটাও এক প্রাপ্তি।
মুছুনযুগান্তর গল্পের আঙ্গিক প্রকরণ বিষয়ের অভিনবত্ব ভাষার কাঠামো এসব নিয়ে আমি এ গল্পের বিচার করবো না | পাঠক হিসেবে এ গল্পের যে শাশ্বত আবেগ তা আমাকে টেনেছে ও মনটাকে ভিজিয়েছে | এটা অস্বীকার করতে পারলাম না | ভালোবাসা জানাই
উত্তরমুছুনশুভেচ্ছা প্রদীপদা।
মুছুনভালো লাগলো। শিউলি ফুল - নরম, মায়া জড়ানো গল্প।
উত্তরমুছুনভালো লাগলো। শুভেচ্ছা একরাশ।
উত্তরমুছুনঅবস্থার দাসত্ব করতে বাধ্য হওয়া নারীর বেদনাদিগ্ধ মন ঘিরে ধরে নিরুপায় পাঠককে।
উত্তরমুছুন