সোমা কুশারী
ক্লাসফ্রেন্ড
লাল রঙের আই- টেনটা হুশ করে দোকানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতেই আকাশ সসপ্যানে এক খাবল সি টি সি ছুঁড়ে দিলো। মেলা খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে, সন্তু বাবলা প্রকাশ বিশেদের গ্রুপটা সেই যে আটটা নাগাদ দোকানে সেঁধিয়েছে বেরোবার নামটি নেই। সেই কখন চার কাপ চা, চারটে বিস্কুট নিয়ে বসেছে! বেঞ্চ আগলে বেলা দশটা এগারোটা অবধি আড্ডা না দিলে শালাদের পেটের ভাত হজম হয় না! মনে মনে গাল দিতে দিতে গরম জলে কাঁচের কাপগুলো ধুতে থাকে আকাশ। এইসময় বড্ড চাপ থাকে, মিলের শিফটিং বদল হয়।আশপাশের দোকানদারেরাও এক ঢোক গরম পানি গলায় চালান করে। দু একটা কলোনির মেয়েলোক গ্লাস হাতে চা কিনে নিয়ে যায়, বাচ্চা কাচ্চাকেও পাঠায় কেউ কেউ। আকাশ লম্বা হাতা দিয়ে ফুটন্ত চা নাড়তে থাকে। উপরের পাতলা সাদা রঙের তরল ক্রমশ ঘন হয়ে ওঠে। এবার মাপমতো চিনি ঢেলে দিয়ে অপেক্ষা।
সকাল থেকে চার দফা সসপ্যানে চা ফুটছে। হেল্পার বাচ্চাটাও আজ গ্লাস ধুতে ধুতে এলিয়ে পড়েছে। ক্যাশবাক্স ভরে উঠতে অবশ্য অনেক বাকি। তবু, ভালো লাগছে না আজ। ও বেলা আর দোকান খুলবে না আকাশ, সাইকেল চালিয়ে লিলির ঘরে গিয়ে থামবে। বাচ্চাটাকেও ছুটি দিয়ে দেবে।
লাল আই - টেনটাই যত নষ্টের গোড়া! সপ্তাহে দুদিন লাল আই - টেনটা দোকান পেরোলেই কেমন সব এলোমেলো হয়ে যায়। কিছুতেই দোকানে মন টেকে না। আকাশ চা-ওলা কিছুর মধ্যে কিছু নয় ভবতারিনী প্রাইমারি স্কুলের বেঞ্চে গিয়ে বসে। বিভু স্যার মনোজ স্যার বন্দনা ম্যাডামের সব প্রশ্নের উত্তর চটপট দিয়ে ফেলে। রাকিব স্যার আদর করে দিয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
-দেখিস আকাশ একদিন আকাশ ছোঁবে।
আকাশের পাশে বসা মাজা মাজা রঙের বড় বড় চোখের ছেলেটা খুব খুশি হয়। বলে,
-তুই আমার হিরো...
এসব কখন যেন ঝুপ করে মিলিয়ে যায়, লিলির নরম মাংসে বোটকা গন্ধ পায় আকাশ! লাফিয়ে নেমে যায়। বাছা গালি দিয়ে লিলি বলে
-ঢ্যামনা!
অনেক রাতে সাইকেল বাইতে বাইতে আকাশ হলুদ গ্রিলের গেটের সামনে প্যাডেল আস্তে করে দেয় মাথা তুলে একবার দোতলা বাড়িটা দেখে। খুব ডাকতে ইচ্ছে করে গলা দিয়ে স্বর ফোটে না। আকাশ গলির হাতা ঘুরে নিজের দরজায় এসে থামে। মা আজকাল অপেক্ষা করে না, ভাত ঢাকা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
সাইকেলটা ভাঙা গোয়ালের একপাশে রেখে চৌবাচ্চা থেকে বালতি করে জল নিয়ে আকাশ চোখ মুখ ধোয়, প্যান্ট শার্ট খুলে অন্ধকারে উদোম হয়ে ঝর ঝর করে জল ঢালে গায়ে মাথায়। প্যান্ট জামা জল কাচা করে দেয়। গামছা দিয়ে গা মুছতে ইচ্ছে করে না। লুঙ্গিটা ভেজা শরীরে গলিয়ে নেয়। রান্নাঘর খুলে ঢাকা দেওয়া ভাত খেতে গিয়ে সেই বোটকা গন্ধটা নাকে লাগে, ভাত'কটা মুখে দিতে প্রবৃত্তি হয় না। খিড়কির দোরটা খুলে হাড় পাঁজর বের করা কালো কুত্তাটার মুখের সামনে ঢেলে দেয়।
মায়ের ঘরের দরজা সারারাত খোলাই থাকে, আকাশ একবার খোলা দরজার কাছে দাঁড়ায় চৌকির এককোনে পুটুলি পাকিয়ে মা ঘুমোচ্ছে, আকাশের ইচ্ছে করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, পারে না। মদ খেয়ে মাকে ছুঁতে কেমন যেন বাধে।
শশধর মিত্তিরের বড় ইচ্ছে ছেলেকে ডাক্তার করবে। ছেলেটার মাথা বরাবর খুব ভালো স্কুলের স্যারেরা বলেন,
-আমাদের আকাশের যা মাথা একটু চেষ্টা করলেই জয়েন্ট পাবে।
চা খেতে এসে কান্তিমোহন বয়েজের স্যারেরা যখন এসব বলেন শশধরের চোখদুটো খুশিতে চকচক করে ওঠে।
- আকাশ তুই আর আমি এবার থেকে আমাদের বাড়িতে একসাথে গ্রুপ স্টাডি করব বুঝলি!
-তোদের বাড়ি? না! না! তোর বাবা যা রাগী!
-দূর! তোকে আমার বাবাও খুব ভালোবাসে। আর মা? দেখিস গিয়ে।
নবারুণের মা সত্যিই খুব ভালো আকাশ বই খাতা গুছিয়ে ওদের বাড়ি থেকে বেরোতে বেরোতে ভাবে। আর নবারুণের বোন? সুজাতা কী যে মিষ্টি! অকারণে আকাশের লজ্জা করে। দিনগুলো কী যে সুন্দর! ... জয়েন্টের ডেট এগিয়ে আসে। নবারুণ মেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং দুটোতেই বসবে। আকাশ শুধু মেডিক্যালে।
- বিশ্বাস করুন কাকিমা আমি এসবের কিচ্ছু জানি না!
- জানিস না! পুলিশে দিলেই সব জেনে যাবি!নবারুণের বাবা গর্জে ওঠেন।
-তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে! আকাশ এমন ছেলে নয়! আমি বোধহয় নিজেই কোথাও হারটা...
-একদম চুপ! শাক দিয়ে মাছ ঢেকো না!ফুটপাতের চা দোকানীর ছেলে কত আর ভালো হবে? ঐ হারটা নিয়েছে...
জামিন পেতে আরো দেরী হতো বোধহয়। জুভেনাইল কোর্টে আবেদন করায় তাড়াতাড়ি হলো কিনা আকাশ এখনও জানে না! তবে ঐ যে তিনমাস হোমে ছিল, ঐ সময়টাই সব কেমন বদলে দিলো। পড়াশোনা আর হলো না, নাকি পড়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছিল ঠিক মনে নেই আকাশের। শশধর মিত্তির বেশিদিন এসব সহ্য করতে পারেননি একদিন ধানের পোকা মারা বিষ খেয়ে...
চোখদুটো খুব জ্বালা করছিলো। আকাশ বিছানা থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়াল। কত রাত কে জানে! ভাঙা গোয়ালের পাশে গুলঞ্চ গাছের তলায় চোখটা আটকে গেল। এখানেই বাবা সেদিন দোকান থেকে ফিরে ছটফট করছিল... উফ! কী যন্ত্রণা! হসপিটালে নেওয়ার সময় ও বেঁচে ছিলো লোকটা...
সকাল থেকেই আজ দোকানে বেশ ভিড় এর মধ্যেই খান ত্রিশেক কাপ চা উবে গেছে। আকাশের মন ভালো নেই বলে কারোর কথায় তেমন কান করছে না বাচ্চাটাকে দিয়েই চায়ের কাপগুলো হাতে হাতে তুলে দিচ্ছে। হঠাৎ একটা আলোচনা কানে আসতেই আকাশ কান খাড়া করে, বিশেরা কী বলছে?
-শালা! নবারুণ ঘোষ ভালো ঝুলেছে এবার!
-বেশ হয়েছে! পাপ বাপকে ছাড়ে না বুঝলি!
-ছেলেটা কিন্তু ভালো রে! গরীবের কথা ভেবে এখনও এখানে সপ্তাহে দু দিন চেম্বার করে!
-চুপ যা শালা! ওসব দরদ ইনকাম ট্যাক্স মারার ফিকির!
ঠিক কী হয়েছে বুঝতে পারে না আকাশ। কোনোদিন যা করে না আজ তাই করে বসে গলা তুলে জিজ্ঞেস করে,
-কী ব্যাপার বলোতো? কিসের এত আলোচনা?
বিশেরা থতমত খেয়ে যায়। আকাশের ঘটনাটা এলাকায় কারো অজানা নয়! বিশেষত শশধরের বিষ খেয়ে মৃত্যু অনেকের স্মৃতিতেই টাটকা। বাবলা তবু কী ভেবে উত্তর দেয়,
-আরে! নবারুণ ডাক্তার কাল হেব্বি ক্যালানি খেয়েছে!
আকাশের হাত থেমে যায়। উত্তেজনায় পাটাতন থেকে উঠে এসে দাঁড়ায় ওদের মাঝখানে...
-কে মারলো নবারুণকে? কেনই বা মারলো?
প্রকাশ গলা তোলে,
-মেরেছে বেশ করেছে! তোমার তো খুশি হওয়া উচিত আকাশদা! মনে রেখো তোমাদের সাথে হওয়া অন্যায়টা কেউ ভোলেনি!
-রুগীর বাড়ির লোক কাল নার্সিংহোম ভেঙেছে। নবারুণ ডাক্তারকেও খুব মেরেছে, শুনলাম বাইপাসের ধারে কোথায় যেন ভর্তি। মাথার খুলিতে জোর চোট! বাবলা এক নিঃশ্বাসে বলে চলে।
হতভম্ব আকাশ কতক্ষণ যে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো জানে না! বাচ্চাটার ডাকে সম্বিত ফেরে,
-কাকু খদ্দের রাগ করছে! চা ঢালো এবার!
দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রোজের মতো আজ ও দুপুর গড়িয়ে যায়। বলবো না বলবো না করেও মাকে খেতে বসে সব কথা বলেই ফেলে আকাশ। ছেলের পাতে পেঁপের তরকারি তুলে দিতে দিতে থমকে যান মালতি, তারপর নিজের থালায় ভাত বাড়তে বাড়তে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করেন,
- কী করবি ভেবেছিস?
- আ--মি? আমি আবার কী করবো?
- নবারুণ না তোর ছোটোবেলার বন্ধু?
- তুমি বলছো একথা? যার জন্য আমাদের সব গেছে...
- নবারুণের কী দোষ বাবু? মনে নেই? তোর বাবা চলে যেতে সেই অনেক রাতে ছেলেটা এসে দাঁড়িয়েছিল আমাদের দোর গোড়ায়... তোকে তো কত কী বলতে চেয়েছিল! তুই চিৎকার করে উঠতেই আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি !
- সব মনে আছে মা! সব! বাবার ছটফট করে মরে যাওয়া! পুলিশের গাড়ি... চোর বদনাম... আমার সব স্বপ্ন... কিচ্ছু ভুলিনি আমি...
- এসবে নবারুণের কী দোষ বল? অধীর ঘোষ তো আর বেঁচে নেই! আর যা হয়েছে তা বোধহয় আমাদের কপালে লেখা ছিলো রে বাবু...
- তোমার ঐ এক কপাল! সব কষ্ট কী আমাদের কপালেই লিখতে হলো? না!না! আমি কিছুতেই ওকে ক্ষমা করতে পারবো না!
সারারাত বিছানায় ছটফট করতে থাকে আকাশ। মাথার মধ্যে যেন টগবগ করে গরম তরল ফুটছে... বার বার একটা কিশোর মুখ সামনে চলে আসছে... পাশাপাশি সাইকেল চালিয়ে সেই যে বড় গোপালপুর বাজিরডাঙা ছাড়িয়ে বহুদূরে কালীরচড়ে সদ্য ধানকাটা মাঠে দুজনে হাজির হয়েছিল এক শীতের দুপুরে টলটলে পুকুরের জল আঁজলা ভরে খেয়ে পেট ভরিয়েছিল... পাশাপাশি সিটে বসে কুছ কুছ হোতা হ্যায় দেখেছিল হাঁ করে... মেলার মাঠে চ্যালেঞ্জ করে পঞ্চাশটা ফুচকা খেয়েছিল... স্মৃতির পাতায় বোধহয় ঝাল লঙ্কা গুঁড়ো মাখানো থাকে না হলে আকাশের এত চোখ জ্বালা করছে কেন? আহ্! কী জ্বলুনী! চোখ ফেটে অঝোর ধারায় ঝরে পড়ছে কেন এত জল? নবারুণকে এখনও এতো ভালোবাসে আকাশ!
আজ আর দোকান খোলা হয়নি। সক্কাল সক্কাল কলকাতা যাবে বলে বেরিয়ে পড়েছে আকাশ। বাইপাসের ধারে তো আর একটা হসপিটাল নয়! কোন হসপিটালে নবারুণ আছে আগে জেনে নিতে হবে। মা বলেছে, যাওয়ার আগে একবার নবারুণের মায়ের সাথে দেখা করে যেতে ছেলের এমন অবস্থায় একা মহিলা কেমন আছেন খোঁজ নেওয়া উচিত... আকাশ আজ আর হলুদ গ্রিলের সামনে থমকে দাঁড়ায় না! সোজা গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায়...
খুব ভালো লাগলো।এমন বন্ধুত্ব বেঁচে থাকুক
উত্তরমুছুনছেলেবেলা বা বন্ধুবেলা। বিশ্বাসের গল্প বা বিশ্বাসঘাতকতার। সোমার স্বচ্ছ, সরল জীবনবোধে বরাবরের মতই আশাভরসার জয়গান। ভালোলাগা অকৃত্রিম।
উত্তরমুছুনদারুণ দারুণ
উত্তরমুছুনগল্পের গঠনশৈলী খুব ভালো। অল্প কথায় দিগন্ত প্রকাশ। বিষয়ভাবনা ও গতিময়তায় দারুণ। ভালো লাগলো খুব।
উত্তরমুছুন