চন্দ্রাণী বসু


প্রত্যাবর্তন

 তুষারবাবু সরকারি অফিসের কেরানী। অকৃতদার। বয়স পঞ্চাশ। লোকে বলে এমন পিতৃ-মাতৃ ভক্ত ছেলে সচারচর দেখা যায় না। দেখতে মন্দ নয়, সরকারি চাকরি, বাড়িঘর নিজের এবং বেশ বড়সড়ই; তা সত্ত্বেও তিনি বিয়ে করলেন না এক অদ্ভুত ভীতি থেকে। স্ত্রী সংসারে এলে যদি বাবা-মায়ের সঙ্গ ত্যাগ করতে হয়, তা তিনি পারবেন না।  বাবা - মা অনেক চেষ্টা করেও রাজি করাতে পারেননি। দু - এক জায়গায় যদি বা জোর করে পাঠানো হয়েছে এমন সব শর্ত পাত্রীর সামনে রেখেছেন যে পাত্রী পক্ষ রাজী হয়নি এগোতে। পাত্রীকে বলে বসেছেন - আমার মা রোজ সকালে ভজন গান শোনেন - এখন রেকর্ড প্লেয়ারে  বাজে,  আপনাকে সেই গান নিজে গেয়ে শোনাতে হবে। এদিকে সে পাত্রী হারমোনিয়াম কখনও ধরে দেখেনি। 

আবার কখনও বলেছেন আমার বাবা প্রতিদিন খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়েন। এখন ভালো চোখে দেখেন না। কষ্ট হয়। আমি চাই না বাবা কষ্ট পান। গোটা খবরের কাগজ শুরু থেকে শেষ তাঁকে পড়ে শোনাতে হবে। কাগজওয়ালা যেমন প্রতিদিন কাগজ দেয় তেমনই প্রতিদিন পড়ে শোনাতে হবে, বাদ গেলে হবে না। পাত্রী করুণ স্বরে বলেছিল - আমি যদি কোথাও যাই ... তুষার স্পষ্ট জানিয়েছিল ওটি হবে না। ত্রিশ থেকে এভাবেই পঞ্চাশ পেরিয়ে গেলেন তিনি স্ত্রী বিষয়টি ব্যতিরেকেই। এবং তা নিয়ে বিন্দু আক্ষেপও তার মধ্যে কেউ কখনও দেখেনি।
মা যতদিন কর্মক্ষম ছিলেন ততদিন তাঁর যাবতীয় কাজে সাহায্য করে তুষার বাবু কলেজ ইউনিভার্সিটি ও পরে চাকুরিক্ষেত্র সামলেছেন। বিছানা তোলা, জামাকাপড় কাচা, তরকারি কোটা, আটা মাখা সবই তিনি দক্ষ হাতে করে দিতেন। পাড়ার মহিলারা প্রশংসা বা ঈর্ষায় তার মাকে বলতেন রত্নগর্ভা।
বাবা নিজে বেশ কর্মক্ষম ছিলেন। তাই তার জন্য কিছু সবিশেষ করতে হত না। তবে কোন ওষুধ কখন খেতে হবে তা তুষারের নখদর্পণে ছিল। ঘড়ির অ্যালার্ম ক্লক হার মেনে যেত তার নিত্য নিয়মে। কোন গাছ কখন এনে দিলে বাবা তার বাগান সাজিয়ে তুলবে, কোথাকার মাটি, কোথাকার সার - সবদিকেই ছিল তার পুঙ্খানুপুঙ্খ নজর। 
তাঁর  বয়স যখন ছেচল্লিশ বাবা হঠাৎই চলে গেলেন। তেমন কোনও অসুস্থতা তাঁর ছিল না। কিন্তু একদিন ঘুমোলেন আর উঠলেন না। ডাক্তার এসে বললেন কার্ডিয়াক অ্যারেষ্ট। ভেঙে পড়লেও তুষার বাবু মায়ের দিকে চেয়ে সামলালেন নিজেকে।
তারপর থেকেই বিছানা নিলেন মা। বাবার এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি আর কী ! শারীরিক অসুস্থতা যে ছিল খুব তা নয় কিছু, কিন্তু মানসিক জোর হারিয়ে ফেললেন এক্কেবারে।
অবশেষে কিছুদিন পর দেখা গেল তুষারই সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব সামলাচ্ছে হাসিমুখেই। 
কিন্তু অফিস বাড়ি থেকে দূরে হওয়ায় এবং মাকে কারও যত্নে রেখে যাওয়ার থেকে তিনি ঠিক করলেন বাড়িই অফিসের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়াই ভালো। কিন্তু সেখানে বাড়ি কেনার মতো বাড়ি খুঁজে পেলেন না। ফ্ল্যাটও মনোমত নয়।  অগত্যা অফিস থেকে হাঁটাপথে তিন - চার মিনিট দূরত্বে একটি বাসা ভাড়া নিলেন। নিজের বাড়ি বিক্রয়ের টাকায় এবং তার আয়ে দিব্য চলত সংসার। 
ভাড়া বাড়িটি একতলা। দুটি ঘর। দেওয়ালগুলো একটু নোনা ধরা বটে। কিন্তু মালিক থাকেন না। বাথরুম, রান্নাঘর এক ছাদেরই তলায়। দুটি ঘর হলেও তুষার বাবু দিনে ও রাতে মায়ের ঘরেই থাকতেন।
কিন্তু মা এর শরীরে ক্রমশ ভাঙন ধরল। আর ততটাই যত্ন বাড়তে লাগল তুষারের।
সকাল সাড়ে পাঁচটায় উঠে মায়ের বাসি কাপড় কাচা, মায়ের কাপড় বদলানো, মাকে খেতে দেওয়া, ওষুধ দেওয়া, দুপুরের রান্না করা তারপর অফিস যাওয়া। আবার দেড়টায় ফিরে মাকে স্নান করিয়ে খাইয়ে নিজে কোনোক্রমে মুখে দুটো দিয়ে অফিস যাওয়া। আবার সাড়ে তিনটেয় একবার এসে ফল কেটে দেওয়া। আর পাঁচটায় বাড়ি ফিরে মাকে ভজন শোনানো , চুল বেঁধে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। সকলে দেখত তুষার তার জীবনের সকল আনন্দ মাতৃসেবাতেই খুঁজে পায়। এবং সকলে ছেলেমেয়েকে সুসন্তানের উদাহরণ হিসেবে বা খোঁটা দিতে তুষার মুখার্জীর নামই মুখে আনে। 

তুষারেরও তাই মনে হত, মায়ের মধ্যেই জাগতিক সব আনন্দ লুকিয়ে আছে। প্রতিবার মায়ের জামাকাপড়  কাচতে দেওয়ার আগে জড়ো করে নাকের সামনে এনে ঘ্রাণ নিয়ে এক অদ্ভুত আরাম পেত সে। সে আরাম সে শরীর ও মন উভয়েরই। একথা কাউকে সে জানাতে পারত না বটে, কিন্তু এই গন্ধ না হলেও তার চলত না। রাতে ঘুম ভেঙে গেলেও সে জোরে নিশ্বাস টেনে এই গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করত। নাকে এলেই আরাম বোধ করে ঘুমিয়ে যেত ... এই গন্ধই তার একমাত্র নেশা।

তিনমাস হল  তুষার বাবুর মা গত হয়েছেন। বাড়িতে সে একা। প্রথম প্রথম তার মনে হত সে শূন্যে ভাসমান অস্তিত্বহীন এক প্রাণী। তার পা মাটিতে ঠেকে না, তার ক্ষিদে ঘুম  দুঃখ আনন্দ কিছুই নেই। তার চিন্তা শক্তি বিলুপ্ত।
শুধু সে একটা ক্ষীণ শব্দ শুনতে পায় মাঝে মাঝে। টিক টিক টিক ... কেউ যেন তাকে ডেকে বলে এই ঘরে আমি এখনও বেঁচে আছি, একা এঘরের দাবিদার তুমি নও। বিরক্ত লাগে তার।  এই ঘরে দ্বিতীয় প্রাণীর অস্তিত্ব সে মেনে নিতে পারে না।  এতদিন জানত সে আর তার মা একমাত্র এই ঘরের অধিকারী। তার মনে হতে লাগল, তার মানে এই ক্ষুদ্র প্রাণীটি তাকে না জানিয়েই এতদিন তার মায়ের গন্ধে ভাগ নিয়েছে। কিন্তু এতদিন তো একে দেখেনি। মাস খানেক হল এসে জুটেছে। অথবা আগেও ছিল লুকিয়ে। অদ্ভুত খেয়াল আসে তার - প্রাণীটি কি পুরুষ না নারী !
যদি পুরুষ হয় তবে মা এর কাপড় বদলের সময় তার শরীর কি সে দেখেছে ? ছিঃ ছিঃ এটা তার আগেই খেয়াল করা উচিত ছিল। এতটা কান্ডজ্ঞানহীন সে কী করে হতে পারল ? অসম্ভব দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। প্রাণীটিকে দেখবার জন্য তার মন চঞ্চল হয়ে উঠল। পরদিনই সন্ধেবেলা নজরে এল দেওয়ালে টানানো  মা বাবার একটা পুরোনো ফটোর পিছন থেকে উঁকি মারছে। চোখদুটি জ্বলজ্বল করছে, বেশ ফর্সা মনে হল। ঠিক মায়ের মতোই গায়ের রঙ, হলদেটে। নাহ্ ! এ কিছুতেই পুরুষ হতে পারে না, তুষারবাবু নিশ্চিত হল মনেমনে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশ্চিন্তির। 
টিকটিকিটাও ফটোর পিছন থেকে আরও একটু বেরিয়ে এল। দুটি প্রাণী দুজনের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল অনেকক্ষণ। টিকটিকিটা আর একটু সামনে আসতে চাইল, কিন্তু তার ধাক্কায় ফটোর থেকে মালাটা নীচে পড়ে গেল, টিকিটিকিটাও উধাও হল সঙ্গে সঙ্গেই। 
মনটা খারাপ হয়ে গেল, যদি বা একজন ছিল সামনে, তাও পালিয়ে গেল‌। মালাটা মাটি থেকে কুড়োতে গিয়ে আবার সেই পুরোনো মায়ের গন্ধটা পেল। টিকটিকির গন্ধ কেমন হয় তুষারবাবু জানেন না। কিন্তু মনের দৃঢ় ধারণা হল ওইরকমই হবে। 
টিকটিকি আর সে - এখন আর কেউ কাউকে অপছন্দ করে না। দেওয়াল থেকে টিকটিকিটা টেবিলে নেমে এসে ঘোরাফেরা করে। তুষার বাবুর রেখে দেওয়া প্লেটে ভাত চাটে। পুজোর নকুলদানাও চাটে। তার চলাফেরার শব্দ পায়। টিকটিকি ডাকেও একটা নিজের মানুষের খোঁজের সাড়া পায়। মা যেমন বলত - দুগ্গা দুগ্গা। ঠিক তেমনই।  তুষার বাবু মায়ের গন্ধটাও পায় ওর গা থেকে। 
মালা পরালেই সে ফেলে দেয়। ফেলে দেওয়া মালা আর ফটোতে দেয় না, তুষারবাবু নতুন মালা কিনে আনেন।  এ এক আজব খেলা তাদের দুজনকার‌। মালাটা না পড়ে গেলেই তুষার বাবুর অস্বস্তি করে আজকাল। মনে হয় দিনটা খারাপ যাবে। অনেক ভেবে দেখেছে দিনটা খারাপই যায় তার। 

গত চারদিন ধরে ফটোর মালাটা পড়েনি মাটিতে। মালাটা শুকিয়েও আসছে। বদল দরকার। কিন্তু তুষার বাবুর মন চাইছে না। এ তো তার ফেলার কাজ। তাকেও দেখা যাচ্ছে না। তুষার বাবু এদিক ওদিক খুঁজল।  হুস হুস করে ডাকলও। নাহ। সাড়া নেই। আজ মায়ের সেই গন্ধটাও কেমন পাচ্ছে না মনে হল। 
অফিস থেকে ফিরেও দেখা গেল না। মালাটা শুকিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তুষার বাবুরও শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। খাবার ইচ্ছে নেই। অফিসে মাথাটাও ঘুরছিল বেশ। মায়ের গন্ধটা একেবারে নেই - বরং একটা পচা গন্ধ আসছে নাকে।  চেয়ারটা নিয়ে একবার দেখবে নাকি ছবির পিছনে ? ভাবতে ভাবতে উঠে পড়ল চেয়ারে ...

দুদিন পর পাড়ার লোক দরজা ভেঙে দেখল মেঝেতে পড়ে আছে উল্টানো চেয়ার, তুষার বাবুর দেহ, শুকনো মালা ঝোলানো ফটোফ্রেম, মরা টিকটিকি ... আর ঘরময় লাশের গন্ধ।





মন্তব্যসমূহ

  1. ভীষণ ভালো একটা গল্প পড়লাম

    উত্তরমুছুন
  2. দুর্দান্ত একটি গল্প পড়লাম দিদিভাই

    উত্তরমুছুন
  3. খুব ভাল, কিন্তু আমি তুষার বাবু বলতে একজনকে চিনি। তুমিও তাকে চেনো। কিন্তু গল্পের তুষার বাবুর সাথে তার কোনো মিল নেই।

    উত্তরমুছুন
  4. ভালো লাগলো। গল্পের শেষটুকু চমৎকার নির্মাণ। অনেক শুভেচ্ছা।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

সব্যসাচী মজুমদার

সৌম্যজিৎ আচার্য