সজ্জ্বল দত্ত
" ধূসরতা অনিবার্য জেনেও "...
" শুধু কবিতার কাছে নতজানু আজ সকাল-দুপুর
শঙ্খমুখ কাঁকনের এই দেশে
সজীব মঙ্গলদীপ আর জাগ্রত সাপুড়ের বাঁশি
ছেয়ে থাকে দশদিক ....
কারো সাহায্য ছাড়াই
আমি স্বরলিপি-ছুট গুঁড়িয়ে ফেলেছি
এই নক্ষত্রপ্রহর ....
আর এক আশ্চর্য সংগীত শুনে
বেরিয়ে পড়েছি আজ অলৌকিক অক্ষরের খোঁজে "
---- সুমিতেশ সরকার
ছেলেটি হাঁটছে । হাজার পাকদণ্ডী সামনে । একটা ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে আশ্চর্য নীল বন্দর , সামুদ্রিক ঝিনুক , নোনাজলে কলম ডোবানো পুরুষ কবিতা । আবার আর একটা ধরে হাঁটলে আরণ্যক সুবর্ণরেখা , ফুলডুংরি , মহুয়ামাতাল । কোনো রাস্তা বৃষ্টি দিকশূণ্যপুরে শ্রাবণী চুপকথায় । আর এক পাকদণ্ডী পথে হয়ত নাগরিক মেট্রোজীবন , এসকালেটার , এসি-রেক , হোঁচট সুড়ঙ্গ নন্দন । ... ছেলেটি হাঁটছে । কিছুক্ষণ এপথে আবার অন্য পাকদণ্ডী পথে । রাস্তা জুড়ে অন্তর্লীন এক অলৌকিক নির্জনতাঘোর । ... হাঁটছে হাঁটছে হাঁটছে ... মাইলের পর মাইল ... " দিগন্তরেখার দূরত্ব... সূর্য ডুবে যাচ্ছে । গোধূলি । ফিরে আসছে । ঊষা " । ... ভ্রমণকাহিনী । ... ছেলেটি হাঁটছে । হাঁটতে হাঁটতে কুয়াশা জ্যোৎস্না .... কম্পাসডানায় আশ্চর্য টলটলে পুষ্করিণী জল । পাহাড়ি সবুজ ঘেরা আদিম গুহামুখ ..চতুর্দিক স্তব্ধ । রক্তাক্ত পৃথিবীক্ষত তখন বহুদূর ... । ... ছেলেটি বসল একা পুকুরের ধারে । টলটলে স্থির জলে হৃদয়প্রতিচ্ছবি ... অদৃশ্য মুভি ক্যামেরা , রিফ্লেক্টর । জলীয় পর্দায় বুদবুদ , প্রিয়শব্দ ... একটার পর এক অনুষঙ্গ লিপি । মাঝে ফাঁকে ফাঁকে গোটা আদিম পুকুর জুড়ে ভ্রূ আঁখি ওষ্ঠ চিবুক রূপমতী আয়না ওড়না বিভাজনরেখা ... ! ছেলেটি একমনে । ... পেছনে বহুদূরে মধ্যযাম ... সম্পর্কবিহীন কোনো শব্দমায়াজালে আপন রাতভোর সাজিয়ে রাখা ঋণ । ... তারপর একটা সময়ে সেই পিছুডাক চেনালোক । পরিচিত মফঃস্বল জুড়ে চাষাবাদ , লকারের চাবি রাখা দগ্ধবাড়ির ডাক , চিরকেলে মেঘমরশুমটুকু লুটেপুটে আরো কাছে । ... উঠে পড়ল । ঘুরে দাঁড়াল ছেলেটি । ...এবার " ... উদ্বৃত্ত আবেগ খুঁজে নেবে হাইবারনেশন / ফিরে এলে সোনালী ফসল / ফিরে এলে প্লাবনের ডাক / চোখ মুখ বৃষ্টি আদল রাখা থাক " ।
সত্যি বলতে কি এতক্ষণ ঘোরে ছিলাম । দিনমানে স্বপ্নঘোর । দূরে আলেয়ার দুলতে থাকা আলো দেখে জলাশয় হ্যালুশিনেশন্ । আসলে আমার হাতে একটি কবিতার বই । রঙিন হার্ডবাইণ্ড , স্ট্রিটলাইট উড়ন্ত পাখির মলাট , চৌষট্টি পাতার মধ্যে কালোকালো ছড়ানো অক্ষর ।
" বেশ কয়েকদিন ডাকবাক্সে পড়ে আছে চিঠিটা ... / আতঙ্ক বা অতিনৈতিকতা পেরিয়ে / বৃষ্টির ছাঁট , করুণ কুয়াশা বা কাশ এসে বলে যায় / লিখেছ ? লিখেছ তুমি ? " --- প্রবেশক প্রথম লাইনেই তৈরি হয় ঘোর । স্বাভাবিক অনিবার্যতায় কিভাবে যেন শব্দ জানান্ দেয় পাতা ওল্টালেই একের পর এক কুয়াশা বৃষ্টি কাশজড়ান সম্বোধন ও ইতি বিহীন কোন এক লৌকিক কিংবা অলৌকিক " তুমি " কে লেখা চিঠি , যা বেশ কয়েকদিনের আড়ালে আসলে বিস্তীর্ণ সময়প্রবাহ জুড়ে পড়ে আছে ডাকবাক্সে ! .... প্রকৃত শব্দমায়া এরপর শুরু । " আপাতত কবিতা বিছিয়ে বসে আছি । / তুমি আসবে গোটা একটা শ্রাবণ পেরিয়ে / শব্দগুলো নেড়েচেড়ে দেখবে । দু একটা তুলে গালে ঘষবে । / ..... এভাবেই শরীর জুড়ে কবিতার মহল্লা । তুমি দরদাম করো । / হাত তুলেও নামিয়ে রেখে যাও অনায়াস । / আমি পসরা সাজিয়ে বসে থাকি " । ... গোটা সত্ত্বা জুড়ে কবিতাপ্লাবনে এই অনন্ত অপেক্ষা আর বসে থাকার সঙ্গে একাত্ব হতে না হতেই হু হু করে পরপর আসতে থাকে তুমি জড়ান নৈসর্গিক ও নাগরিক শব্দশিল্পযাপন , সেই টলটলে পুষ্করিণীর জলে ভেসে উঠতে থাকা ছবির পর ছবি । .... একেকটা জনপদ পেরিয়ে চলেছে শব্দ - ঘুমোচ্ছে বা নির্ঘুম , ছন্দ গড়ে কিংবা গদ্যের ধুলো জমে , স্থির অনুষঙ্গে বা যেকোন লাইনে । " যে কোনো লাইনেই কবিতা শুরু হয়ে যেতে পারে / শেষও হয়ে যেতে পারে যে কোনো লাইনেই / শুধু ঠিকানা খুঁজে চলা মাঝে " । ... এই ঠিকানা " শ্রাবণ প্রিলিউড " এ , " চোখে চোখে পড়া হয় পরাবাস্তব ধাঁধা / আর লুটপাট যত দীর্ঘশ্বাস / বাকিটা কল্পকথা " য় , কিংবা ' ঈর্ষা 'য় ' বিনিময় 'এ কিংবা ' দৈনিক 'এ , মধ্যবিত্তের মাইটোকনড্রিয়া বা ইলেকট্রন বাহক খুঁজে বেড়ানোয় , মাসিক ডি.এ র শূণ্য ভাঁড়ের মধ্যে ।
কবিতায় শব্দপ্রয়োগ জনিত শিল্প ঠিক কাকে বলে ? কিভাবে হয় ? কি দেয় শব্দ ? ছবি ? আলো-আঁধারীর অসম্পূর্ণ অ্যাসথেটিক এফেক্ট? প্রায় নিশ্চিত ' অনৈতিকতা 'র প্রয়োগ কিভাবে ফট্ করে ' অতিনৈতিকতা ' হয়ে আসে ? বিলুপ্তির খুব কাছে যে প্রাণী পৌঁছে গেছে তার ইংরেজী বিশেষণ ' এনডেন্জারড্ ' কিভাবে অনায়াস হেঁটে এসে হৃৎশব্দ লাবডুপের আগে বসে পড়ে ? কি বোধ ভাসিয়ে দেয় ? কি সে অনুভূতি ? আপনমনে উত্তর খুঁজে খুঁজে উল্টে চলেছি পাতা । ..... যা লিখেছি এতক্ষণ , প্রবল সূক্ষ্ম কোনো ধারা বলে মনে হচ্ছে ? মনে হচ্ছে অতলান্ত গভীর কোনো নিঃসীম রোম্যান্টিকতায় সর্বক্ষণ ডুবে আছেন কবি ? বেশ , কিঞ্চিত হালকা হই তবে নস্টালজিক ম্যানিয়ায় । আকন্ঠ ছন্দে ডুবে যাই হঠাৎ ঘনঘোর শীতবৃষ্টিদিনে । " আজ যে ভীষণ বৃষ্টি নেমেছে হিয়াটুপটাপ মৌন / শ্রাবণ বইছে শীতের সড়কে পরাগমিলন যৌন / অবাধ্য জিনস ভিজে একশা অকালবৃষ্টি ছাঁটে / জনপ্লাবন ভিড় বাস ট্রেন কবি তো একাই হাঁটে / কবেকার সেই ফোল্ডিং ছাতা বন্ধ থাকাই ভালো / আসছিলো শীত , কবিকে দেখেই হঠাৎ বৃষ্টি এলো / হাওয়া উত্তুরে , উত্তর নেই প্রশ্ন বা অভিসন্ধির / কর্নেটো কফি কোনো একটাতে জিয়ানস্টাল মন দি' " ..।
হালকা থেকে মহাগভীর তীব্র অনুভূতি পথ ধরে " ঊষা ... গোধূলি ... গন্তব্য " ... " খাঁচায় আকাশ বাঁধো ... " ... " চোখ রাখো মোনালিসা ফ্রেমে "র গোটা জার্নিটাই " থোড় বড়ি খাড়া একঘেয়ে রুটিন মহড়া ... " যার মধ্যে বাইরে ছবি আঁকা চৈত্রে আশ্চর্য শব্দএফেক্ট - গুঁড়ো গুঁড়ো চশমার কাচে মিমিক মনখারাপ । আর এই মনখারাপী গন্তব্যপথ শেষবেলায় এসে অসাধারণ শিল্পকল্পময়তায় হাত ধরে চিরন্তন মানবযাত্রাপথের । আমি ও আমার ব্যক্তিগত তুমির ঊর্ধ্বে উঠে কবিতা মিশে যায় সমষ্টির গোড়ার কথায় । -- কচুরিপানায় সূর্য ডোবা আর সূর্যোদয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অযুত নিযুত বছরের পাখিজন্ম । " যারা পাখিজন্ম চায় আমি তাদের দলে পড়ি না " । তবে কোন্ জন্ম পাখিজন্ম ? " যারা আকাশের দিকে মুখ তুলে চলে ... / না । আমি না । / আমি চোখ রাখি পায়ের নখে " । আর নিম্নমুখী এই গরম শ্বাসে একটু একটু করে রচিত হতে থাকে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের গতিধারা । " দৌড়তে থাকে অস্ট্রিচ সঙ্গমের দিকে " । ডানাহীন অস্ট্রিচের মাটির বুকে এই দৌড়তে থাকার কোনো শুরু নেই শেষ নেই গন্তব্য নেই । আছে সঙ্গম তাড়না , আছে স্বপ্নের ঘোরে থাকা প্রাণের অভিশপ্ত জীবন কথা । পাখির রূপকে মানুষ চিত্রকল্পে গোটা জীবজগতের প্রবহমানতার সবটুকু কথা বলে এই দৌড় , একেবারে শেষে অন্ধকারের উপসংহার লিখতে গিয়ে যা হয়ত কবিকে ফের আলোর ভূমিকা লিখতে বাধ্য করায় ।
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই । নিমেষে অবলুপ্ত ফের সত্ত্বা চেতন । জাগরুক সমস্ত কিছু হঠাৎ আবার ফেলে আসা পাকদণ্ডী পথের সামনে । চশমার ঝাপসা কাচে বিভ্রাট বোধ'য় ! সেই ছেলেটি নয় , নতুন কেউ । স্পষ্ট হচ্ছে আগে দেখা জলাশয়ের টলটলে জল । সূর্যাস্তের নরম লালে লাল আভায় জলের ওপর আশ্চর্য এক জন্মের ছবি । যে জন্ম শব্দবুনোটে " মিলমিশ বা নিছক চিত্রকল্প " । " ছই , ছায়া , কটাক্ষ আর শরীরী ... / শরীর মিলমিশ । আলাপ ঝালা আর ... " - আর আতপ্ত কোনো এক ' তুমি ' । " মুখোশ না পোশাক না পরিচয় ! " " ভালোবাসা না বিকার না অবক্ষয় ! " .... এ তুমির কেমন আকার ? আদৌ কোনো আকার আছে ? নাকি রক্তমাংসের অলীক কল্পনায় আসলে নিরাকার ? ... ইয়েটসের মড গন ? নাকি সুনীলের মানসপ্রতিমারূপ নীরা ? কবিতার তুমি ? নাকি কাব্যিক গদ্যের ? ... " গন উইথ দ্য উইণ্ড " এর স্কারলেট ও'হারা ? হাজার পাতার উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথম লাইনে যাকে পাঠকের সঙ্গে এই বলে পরিচয় করাচ্ছেন লেখক " SCARLETT was not beautiful , but men seldom realized it when caught by her charm " ! ... নাকি " প্রাইড অ্যাণ্ড প্রেজুডিস " এর এলিজাবেথ বেনেট ? যার সম্পর্কে লেখকের নিজের মন্তব্য " as delightful a creature as ever appeared " ! ..... এইসব বিচিত্র ভাবনার একের পর এক প্রশ্নমালা পার করতে করতে নতুন মানুষটি দেখে যেতে থাকে ছবি । আদি মেসোপটেমীয় চাঁদ থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকা জ্যোৎস্না এক সময় মাত্রাহীন হয় । " শীতের সনেটগুচ্ছ আর উপোসী ঠোঁট " পার করে " গন্ধের নাম গোধূলি । স্বাদের নাম যৌনতা / আর সময় বসন্ত " । গুহাবেষ্টিত সেই পাহাড়ি আলতামিরার কোনো আদিম পুষ্করিণী জলে রঙিন ছায়াচিত্রে " গতজন্ম । পরজন্ম । আর ... " ! আর " বাসন্তিকা বাসস্টপ " । আবীরে রৌদ্রযাপনে , শিমুলে পলাশলালে , রিয়েলে ভার্চুয়ালে মাঝের ইহজন্ম " বাসন্তিকা বাসস্টপ " । যেখানে " শুরুর শেষ বা শেষের শুরু " । " ফোটন বিচ্ছুরণ " থেকে " সা রে গা মা " একের পর এক নিমগ্ন খণ্ডচিত্র যেখানে ফিকে হতে থাকে । কবির প্রিয় " তুমি " " যাওয়ার আগে বলে যায় , যাচ্ছি " । কবি লিখতে শুরু করে আলোর ভূমিকা । ঝুপ করে নেমে আসে অন্ধকার । ... আলো ? না অন্ধকার ? .... আলো ? না অন্ধকার ? ... আলো ? ...
বাসন্তিকা বাসস্টপ : নিলয় নন্দী : স্রোত পাবলিকেশন : মূল্য ১২০ টাকা : প্রচ্ছদ - অয়ন চৌধুরী
কি অপূর্ব পাঠ প্রতিক্রিয়া!
উত্তরমুছুনচমৎকার আলোচনা।
উত্তরমুছুনএ তো রিভিউ নয়। নিলয়ের অনবদ্য বাসন্তিকা বাসস্টপ পড়ে তার ইম্প্রেশনে আরেকটি সৃজন। সজ্জ্বল নিজেই নিজেকে বারবার ভাঙছে কবিতায়, গদ্যেও। অপূর্ব! অপূর্ব! রিভিউ একবার পড়লে পড়া হয়ে যায়। এই লেখা বারবার পড়ার। পড়বও তাই। তবে এমন লেখার আরেকটি বিপজ্জনক দিক আছে তা হল যে বইটি নিয়ে আলোচনা করা হয় সেটি একটু ব্যাকফুটে চলে যায়। লেখাটির সৌন্দর্য উপভোগে মন এত বেশি নিমগ্ন হয়ে যায় যে আলোচ্য বইটি মাঝে মাঝে নজরের বাইরে চলে যায়। এখানে একটু তেমন হয় নি তা নয়। তবু বলব এমন লেখা পড়তে চাই।
উত্তরমুছুনকবি নিলয় নন্দীর কলম অত্যন্ত প্রিয়। আর কবি ও আলোচক সজ্জ্বল দত্তের রিভিউ তো যেকোনো লেখকের উপরি পাওনা। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। রীতিমতো রসাস্বাদন করলাম। আর বইটি সংগ্রহ করার অভীপ্সা দ্বিগুণ হ'ল।
উত্তরমুছুনগ্রন্থটি অত্যন্ত প্রিয় কিন্তু তার এমন অসাধারণ সমালোচনা হতে পারে ভাবতে পারিনি।এই সমালোচনাটাই যেন একটা কবিতা।মগ্নতা দাবী করে।খুব সুন্দর।
উত্তরমুছুনভালো লাগল আলোচনাটি
উত্তরমুছুন