অনুরাধা রায় ঘোষ
হিমালয়ের অন্দরমহলে
২০১৭ সাল। মার্চ মাস থেকেই মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে সেই প্ল্যানটা।এবার দুর্গাপুজো সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে অর্থাৎ কুনজুম পাস বরফমুক্ত । আসলে আমাদের মতো পাহাড়পাগল চাকুরিজীবি মানুষদের আশা ভরসা ঐ পুজোর ছুটির কয়েকটা দিন।হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম,কুনজুম খোলা মানে লাহুল-স্পীতি উপত্যকা ভ্রমণ সম্ভব। আমি হিমাচল প্রদেশের সেই অঞ্চলের কথা বলছি যে অঞ্চলকে হিমালয়ান ডেসার্ট রিজিয়ন বলা হয়ে থাকে। হিমাচল প্রদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য এমনিতেই অসাধারণ।সমগ্ৰ হিমাচল ভ্রমণ কোনো একটি একক ট্যুরে কখনোই সম্ভব নয়। হিমাচল ভ্রমণ বলতে বেশীরভাগ মানুষই সিমলা,কুলু, মানালি,ডালহৌসি অথবা সারাহান,সাংলা,কল্পা,ছিটকুল এই পর্যন্তই গিয়ে থাকেন।কিন্তু এরপরের অংশই হলো কোর হিমালয়ান রিজিয়ন অর্থাৎ টাবো,কাজা,কেলং।আর কিছুটা গেলেই আপনি তিব্বতের লে শহরে ঢুকে পড়বেন।
এখানে নিজের কথা একটু বলে রাখি।আমার চিরকালই টানাপোড়েনের কপাল।বিশেষত ভ্রমণ বিষয়ক যে কোনো সিদ্ধান্ত ,ট্যুর প্ল্যান থেকে শুরু করে ,গাড়ী, হোটেল বুকিং সব একক দায়িত্ব ও উৎসাহে পালন করে থাকি।আমার কর্তাটি এসব বিষয়ে অসম্ভব নিরাসক্ত। ভীষণ ব্যস্ত একটি পেশায় নিযুক্ত থাকায় সোনায় সোহাগা। কপালে বরাদ্দ শুধু সাতটি দিন , আমি এদিক থেকে ওদিক থেকে টেনেটুনে দশ দিনে নিয়ে গিয়ে টিকিট কেটে বলি ,ঐ সাতদিনই ,যেতে আসতে যেটুকু।যাইহোক এবার প্রসঙ্গে ফিরি।
কলকাতা-দিল্লী-চণ্ডীগড়-কুফরি
আমাদের এই ট্যুর শুরু হয়েছিল ২২ শে সেপ্টেম্ব,২০১৭ । সেদিন ছিল তৃতীয়া।হাওড়া থেকে রাতের রাজধানী এক্সপ্রেস যেটা পরদিন সকাল ১০ টার মধ্যে নিউদিল্লি পৌঁছোয় সেটা প্রায় ১ ঘন্টা লেট করে পৌছোলো বেলা ১১ টায়। দিল্লি থেকে চণ্ডীগড়ের ফ্লাইট ছিল দুপুর দেড়টায়।চণ্ডীগড় থেকে হিমাচল ট্যুরিজম এর গাড়ী বুক করা আছে।মাত্র ১ঘন্টা ৫ মিনিটের উড়ানসফর শেষে পৌঁছে যাব চণ্ডীগড়।আর সেখান থেকে গাড়ীতে কুফরি পৌঁছতে খুব বেশি হলে বিকেল হয়ে যাবে। সন্ধ্যের আগেই পাহাড়ি পথ পেরিয়ে পৌঁছে যাব গন্তব্যে।অর্থাৎ ২২ তারিখ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ২৩ তারিখ কুফরি। এখানে বলে রাখি কলকাতা থেকে সরাসরি চণ্ডীগড়ের উড়ান সেইসময় ছয় জনের (আমরা তিনজন ও আমার বান্ধবী ,তার হাজব্যান্ড,আর ছেলে) টিকিট পাওয়া না যাওয়ায় এই ব্যবস্থা।নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন সরাসরি এয়ারপোর্টের সাথে যুক্ত।অর্থাৎ মেট্রো রেলেই সরাসরি পৌঁছে যাব টার্মিনাস ২। এমনকি মেইন লাগেজ পর্যন্ত সেখান থেকে কনভেয়ার বেল্টে দিয়ে দেওয়া যায়।এতে বেশ খানিকটা সময়ও বাঁচে ।
দিল্লি মেট্রোয় এই প্রথমবার,তাই স্বভাবতঃই চক্ষু চড়কগাছ।পুরো মেট্রো স্টেশন গ্লাস দিয়ে ঢাকা।প্ল্যাটফর্ম থেকে রেললাইনের কিছুই দৃশ্যমান নয়।
ট্রেন এলে অটোমেটিক প্ল্যাটফর্মের গ্লাসডোর খুলে যাচ্ছে।যাইহোক্,মেট্রো স্টেশন থেকে কিন্তু আমাদের মেইন লাগেজ নিলো না। হাতঘড়ি দেখে একটু ভ্রূ কুঁচকে কর্তব্যরত অফিসারটি বললেন একটু দেরি হয়ে গেছে। আপনারা এয়ারপোর্টেই চলে যান্ ওখান থেকেই চেক্ ইন করবেন।তখনই বুঝলাম , শুরু হলো আমার টানাপোড়েনের কপালের কারসাজি।প্রায় সাইক্লোন স্পীডে দৌড়োচ্ছি। এয়ারপোর্টের পিচ্ছিল মেঝেয় হুমড়ি খেয়ে পড়ার উপক্রম।প্রত্যেকের হাতে ট্রলি পীঠে ব্যাকপ্যাক্।সেই অবস্থায় কোনোক্রমে কাউন্টারে পৌঁছে বোর্ডিং পাস নিতে গিয়ে শুনতে হলো কনভেয়ার বেল্টের সাথে প্লেনের সংযোগ ছিন্ন হওয়ার দরুন আর লাগেজ নেওয়া যাবে না।মেন লাগেজ কিছু না থাকলে চেক ইন্ করা যেত। অর্থাৎ সোজা ভাষায় ফ্লাইট মিস। অগত্যা সময় নষ্ট না করে চট্পট্ সিদ্ধান্ত। একটি বোলেরো বুক করে চন্ডীগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা। হিমাচল ট্যুরিজ্ম এর গাড়ীর ড্রাইভারের নাম নীতিশ। হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি দেখে রনবীর কাপুর বলে বিভ্রম হয়েছিল।নীতিশকে ফোন করে পুরোটা বলতেই আশ্বস্ত করল,"কোই বাত নেহি ম্যাডামজী।ম্যায় হুঁ না।"ও বল্লো আমি এগিয়ে যাচ্ছি আপনারাও আসুন।রাস্তায় মিট করে নেবো।প্রায় চার ঘন্টা পর দেখা হলো এই ট্যুর এর কাণ্ডারী নীতিশের সাথে। সত্যিই এতক্ষণ মনে হচ্ছিল এ যাত্রায় সব জলে গেল বুঝি।এবার একটু গরম চা সহযোগে হালকা স্ন্যাক্স খেয়ে নিয়ে আমরা নীতিশের সাথে হিমাচলের পথে।ক্রমশ বিকেলের আলো নিভে আসছে,বাইরে হিমেল হাওয়া আর বৃষ্টির দাপট বাড়ছে। পাহাড়ী পথের শুরু।গাড়ীর বাইরের তাপমাত্রা যত নীচে নামছে ভেতরের আবহাওয়া ততই উত্তপ্ত হচ্ছে। এতো রাতে এই পাহাড়ী রাস্তা,তার উপর প্রবল বৃষ্টি,এভাবে কুফরি পৌছোনোর সিদ্ধান্ত ঠিক অথবা বেঠিক , বিতর্ক চলতে থাকুক।রাত দুটোয় অবশেষে কুফরি। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমরা যেহেতু সারাহান হয়ে ট্রাইবাল হিমাচলের দিকে চলে যাবো তাই সিমলায় না থেকে খানিকটা এগিয়ে কুফরিতেই বুকিং করা হয়েছিল। পরদিন কুফরি থেকে সারাহানের পথে।
নাকো-টাবো
আমার এই ভ্রমনকাহিনীর বিষয়বস্তু যেহেতু লাহুল -স্পীতি উপত্যকা তাই সারাহান থেকে সাংলা,ছিট্কুল ,কল্পা,নাকো হয়ে টাবো পর্যন্ত প্রকৃতির যে অপার সৌন্দর্যের সাক্ষী হয়েছি প্রতি মুহুর্তে,বসপার সবুজাভ নীল জলে,মেঘ পাহাড়ের ভালোবাসাবাসি,বরফের মুকুটে রামধনু রঙের মণিমাণিক্য শোভিত পাহাড়চূড়া,কিন্নর কৈলাস, কল্পার আপেল বাগান আর চারপাশে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ ঘেরা ছিটকুল পেরিয়ে যে পথে চলেছি সেখান থেকেই এই ভ্রমনকাহিনীর শুরু।
কল্পা থেকে সকাল ৭ টায় ব্রেকফাস্ট প্যাক্ করে গাড়ীতে নিয়ে রওনা দিলাম।এখান থেকে ১০৯ কিমি দূরে নাকো গ্ৰাম।কিন্নরের প্রায় শেষ প্রান্তে উইলো আর পপলার গাছে ছাওয়া নাকো হ্রদে তুষারশৃঙ্গের প্রতিচ্ছবি এক অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য রচনা করেছে।নাকো গুম্ফাও একটি দ্রষ্টব্য স্থান। এখানে বৌদ্ধ গুরু পদ্মসম্ভবের পদচিহ্ন আর কিছু ম্যুরাল পেন্টিং আছে।নাকোর কিছুটা পরেই কিন্নর শেষ স্পীতি শুরু। নীতিশ বলল টাবো পৌছতে বিকেল হয়ে যাবে।যাঁরা কল্পা অবধি গেছেন তাঁরা জানেন রাস্তা কতটা দুর্গম।কিন্তু এরপর যে অভিজ্ঞতা হলো তা 'এ জীবনে ভুলিবার নহে'।রাস্তার দু'ধারের দৃশ্যে অসম্ভব দ্রুততায় পরিবর্তন ঘটছিল।মেঘমাখা সবুজ পাহাড় ধীরে ধীরে ধূসর রুক্ষ রূপ নিচ্ছে।ঘন্টা পাঁচেক পর সবুজের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও।মাথার উপর অসম্ভব গাঢ় নীল আকাশ মেঘগুলোকে যেন ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়েছে।দু'পাশের ধূসর পাহাড়ের মাথায় মাথায় বরফের মুকুট।ক্রমশ বরফের আচ্ছাদন বাড়ছে,কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া,আমরা এগোচ্ছি কোল্ড ডেসার্ট কাজার দিকে।টাবোর একটু আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চল।সারা বছর বৃষ্টিপাত প্রায় নেই বললেই চলে। কোথাও কোথাও বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে পাহাড়ের গায়ে অপরূপ প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের রূপ নিয়েছে।ঘন্টার পর ঘন্টা এমন ধূসর সবুজহীন,জনপ্রাণীহীন ভূমিরূপ দেখতে দেখতে বিভ্রম জন্মায় ,এ কি পৃথিবী!নাকি গ্ৰহান্তরে কোথাও। শুধু পাশ দিয়ে বয়ে চলা সবুজাভ নীল জলধারা জানান দেয় প্রাণের স্পন্দন।প্রায় দুপুর ৩ টে নাগাদ টাবো পৌছোলাম।টাবো তে হিমাচল ট্যুরিজ্ম এর কোনো হোটেল বা গেস্টহাউস নেই।ওই একটি বা দুটি প্রাইভেট হোটেল অথবা গেস্টহাউস ,কি বলবো জানি না, সেগুলোই একমাত্র রাতে মাথা গোঁজার ঠাঁই।যাই হোক্ মোটামোটী দ্বিশয্যার দুটি ঘর বুক করা ছিল।হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডাটা বেড়েই চলেছে। হোটেলে দুপুরের খাবার শেষ।গরম জলও পাওয়া যাবে না।টাবোতে যে এমন পরিস্থিতি হয় সেটা আগে থেকেই জানা থাকার দরুন সঙ্গে আনা কেক, বিস্কুট আর স্যান্ডউইচ দিয়েই ক্ষুধা নিবারণ এবং গরম জল অথবা মোবাইল চার্জ করার পাওয়ার পয়েন্ট নিয়ে অযথা চিন্তা না করে বেড়িয়ে পড়লাম পড়ন্ত বিকেলের রোদে পাহাড়ি পথে হাঁটবো বলে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম টাবো মনাস্ট্রি। বিকেল ৫ টায় বন্ধ হয়ে যায়।মনাস্ট্রি বলতে পেলিং,রাবাংলা,গ্যাংটক , দার্জিলিং এর মতো মহার্ঘ চোখ ধাঁধানো মনাস্ট্রি তা একেবারেই নয়।কি এক অসম্ভব বৈরাগ্য,আতিশয্যহীন ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো রুক্ষ পাহাড়ের কোলে শান্ত সে আরাধনাস্থল। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের সম্মান পেয়েছে এই মনাস্ট্রি।তিব্বতীয় শৈলীতে ফ্রেস্কো চিত্র,স্টাকো শৈলীর বুদ্ধমূর্তি এইসব অভিনব সংগ্ৰহ রয়েছে সেখানে।ভেষজ রং দিয়ে জাতক কাহিনী আঁকা মাটির দেওয়ালে। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকা হলো না।মনাস্ট্রি বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে গেছে। এখানে পাহাড়ের মাথায় মাথায় হলুদ হলুদ ক্যাকটাস জাতীয় কিছু ফুলের গাছ দেখলাম। বিকেলের আলো মেখে সেই হিমসৌন্দর্যে কেমন একলা যেন ওরা।সন্ধ্যে নামছে রুক্ষ পাহাড়ের বুকে,বাড়ছে হিমেল হাওয়ার দাপট।অগত্যা হোটেলে ফেরা। কয়েকটি ফ্যামিলি মাত্র ট্যুরিস্ট এই হোটেলে।তাই নিয়েই পেরে উঠছে না ওরা।পরিষেবা তেমন পাবেন না ঠিকই তবে আন্তরিকতায় ভরিয়ে দেবে আপনাকে।ঘি মাখিয়ে রুটি আর চিকেন সঙ্গে শুধু পেঁয়াজের স্যালাড্ দিয়ে গেলো সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ।এর মধ্যেই ডিনার সেরে ফেলতে হয়।ওরা কেউ কেউ দূরে গ্ৰামে রাতে বাড়ি ফিরে যায়। পরদিন খুব ভোরে উঠতে হবে।এবার পথ আরো কঠিন।গন্তব্যস্থল কাজা।ইয়াকের দুধের মোটা সরপড়া গরম চা ,আলুর পরোটা আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে প্রাতঃরাশ সেরে লাগেজ নিয়ে ঝটপট আবার গাড়ীতে আমরা।
টাবো-কাজা
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২৫০০ ফুট/৩৮০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত কাজা হলো স্পীতি উপত্যকার কোলে অবস্থিত এক শীতল মরুভূমি।স্পীতি ভ্যালির সদর শহর হলো কাজা।টাবো থেকে কাজা যাওয়ার পথ শুধু দুর্গমই নয় ট্রান্স হিমালয়ান জোনে যে ঢুকে পড়েছি তাও বেশ অনুভব করতে পারা যায়।। ধীরে ধীরে দৃশ্যপটে রুক্ষতা অতিক্রম করে হিমবাহের কিছু অংশ যেন চোখে পড়ছে।বেশ রোদেলা সকাল। হঠাৎ হঠাৎ পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকা।তার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে ছোটো ছোটো ঝোরা।গাড়ী থামিয়ে ফোটো শ্যুট্।দূরে বরফে ঢাকা পাহাড় ,ইয়াক চড়ে বেড়াচ্ছে তারই পাদদেশে যেন।আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাতেই নিঃসীম নীলে ডুবে যাচ্ছি।এ আকাশ বড়ই অচেনা আমাদের।কেমন যেন ভয় ভয় করে ।ঘোর লাগে চোখে।
কুনজুম মাতার মন্দির
ধাঙ্কার মনাস্ট্রি।
টাবো থেকে কাজা যাওয়ার এই পথেই সিচলিংয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে ৭ কিমি বেশ চড়াই পথে ১২৭৭৪ ফুট উচ্চতায় রয়েছে ধাঙ্কার মনাস্ট্রি।দূর থেকে মনে হয় পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে একটা উইয়ের ঢিবি। গাড়ি থেকে নেমে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি সেই হাজার বছরের প্রাচীন গুম্ফার সামনে।মাটির তৈরী এই গুম্ফাটি অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে পাহাড়ের খাদ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ। অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য এখানে। শুধু মাঝে মাঝে পাথর খসে পড়ার প্রতিধ্বনি। দূরে পাহাড়ের গায়ে ধস নেমেছে।সেই শব্দই নীরবতা ভেঙে বারবার শিহরণ জাগায়।গুম্ফার ভেতরে জুতো খুলে প্রবেশ করতে হয়। প্রচন্ড ঠাণ্ডায় খালি পায়ে হাঁটা অত্যন্ত কষ্টকর।গুম্ফার ভেতরে ছোটো ছোটো মাটির ঘর। হঠাৎ অদ্ভুত এক দৃশ্যের মুখোমুখি আমি। একটি প্রায়ান্ধকার গুহার মতো কক্ষ। সেখানে তেলের কুপি মতো কিছু একটা জ্বলছে। পাশে একটি বই রাখা।বৌদ্ধ ধর্মগ্ৰন্থ হয়তো বা। সামনে ধ্যানমগ্ন নিমীলিত চক্ষু এক শ্বেতমূর্তি।নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রইলাম।কুপির সামান্য আলোয় সেই ধ্যানস্থ সৌম্যদর্শন ইউরোপিয়ানকে দেখে কেমন যেন হাজার বছর পার হয়ে যাই অনায়াসে।একি সন্ন্যাসী উপগুপ্ত অথবা পরিব্রাজক আনন্দ!ঘোর কাটতেই মনে হলো আমার এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ অনৈতিক।ভদ্রলোক মেডিটেশন করছিলেন। লক্ষ্য করলাম কক্ষটি আসলে একটি গুহা।মাথার ওপর খুব নীচু পাথরের ছাদ।ওখান থেকে বেরিয়ে আরেকটি ঘরে ঢুকবো কিনা ভাবছি একটি লাল পোশাক পড়া লামা কিশোর আমাকে একটি খুপরি মতো জানলা দেখিয়ে দিয়ে ইঙ্গিতে সেখানে বসতে বলল। আমি জানলার পাশে বসতেই বিস্ময়ে হতবাক্। দূরে হিমালয়ের বুকে তিন তিনটে বরফের গ্লেসিয়ার দৃশ্যমান।নীচে পিন্ উপত্যকার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে সবুজাভ নীল রঙের স্পীতি নদী। জীবনে প্রথমবার হিমবাহ দেখছি তাও শতাব্দী প্রাচীন কোনো এক মাটির গুম্ফার জানলার ধারে কনকনে ঠাণ্ডা পাথুরে মেঝেয় বসে।সঙ্গের ডি.এস.এল.আর টির লেন্স চেঞ্জ করে জুম করতেই যেন হাজার টন রূপোর পাতে মোড়ানো হিমবাহ চোখের সামনে ঝলসে উঠল। শুধুই নির্নিমেষ চেয়ে থাকা। অপার্থিব ভালোলাগায় আশিরনখ রোমাঞ্চিত আমি।কতক্ষন বসে আছি জানি না।নীতিশের ডাকাডাকিতে বুঝলাম খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে।এই হাজার বছরের প্রাচীন মাটির গুম্ফা ,ঐ কিশোর বালকের হাসিমাখা মুখ,ধ্যানমগ্ন জীবন্ত বুদ্ধ,দূরে বরফের গ্লেসিয়ার ,সমস্ত ধূসরতা মেনে নিয়ে বয়ে চলা নদী ,এসব নিষ্কলুষ ভালোলাগা নিয়ে অনন্তকাল বসে থাকা যায়। জীবনের সমস্ত আড়ম্বর মিথ্যে মনে হয়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে।
নীচে গাড়ীর সামনে সবাই অপেক্ষমান।ঐ কিশোর বালক সম্ভবত আমার হাতের ক্যামেরাটি দেখে আমাকে ঐ ঘরে নিয়ে যায়।তাই আর কেউ খুঁজে পায়নি আমায়।জানতে পারলাম ধাঙ্কার মনাস্ট্রি থেকে ২কিমি পায়ে হেঁটে পৌছোনো যাবে ধাঙ্কার লেকে।এই রাস্তায় যানবাহন চলে না।প্রায় দেড়ঘন্টা সময় লাগে লেকে পৌঁছতে।একটু কষ্ট হলেও পথের শেষে যা প্রাপ্তি হবে তার বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। এখানে প্রকৃতি যেন নীরবে উপচে দিয়েছে তার অফুরান সৌন্দর্য্য।
বায়ুর ক্ষয়কার্যের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ
কাজা
প্রায় দুপুর গড়িয়ে পৌছোলাম হিমাচল ট্যুরিজিমের হোটেল দ্য স্পীতি।। অনবদ্য লোকেশান আর এককথায় ভীষণই লাক্সারিয়াস দ্য স্পীতি।লাঞ্চ সেরে হোটেলের ম্যানেজারের সাথে কথা বলতেই জানতে পারলাম পানীয় জলের একটু ক্রাইসিস আছে।স্থানীয় বাজার থেকে ৫লিটারের জার ড্রাইভারকে নিয়ে আসতে বললে ভালো হয়। কিন্তু এ সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। আমি ও আমার বান্ধবী নীতিশের সাথে বাজারে যাব ঠিক করে ফেললাম।বাকি চারজন পুরুষ সদস্য (দুই ছেলে ও তাদের বাবা রা)পথের ক্লান্তি দূর করতে শয্যা গ্ৰহণ করেছেন।বাজারটা ছোটো হলেও মোটামুটী অনেক কিছুই পাওয়া যায়। আমরা টুকটাক দু'একটা জিনিস দেখতে দেখতে হাঁটছি। কিন্তু বেশ ক্লান্ত বোধ করছি।কাজাতে অক্সিজেনের মাত্রা একটু কম একথা আগেই জানা ছিল। আশেপাশের ১৫০ কিমি এর মধ্যে কোনো জঙ্গল নেই। এখানে অল্টিটিউড সিকনেসে হ্যালুসিনেসান পর্যন্ত হতে পারে।তাই আর বেশি ঘোরাঘুরি না করে গাড়ি তে উঠে হোটেলে ফিরে এলাম।কাজাতে আমরা দু'রাত ছিলাম।পরেরদিন ব্রেকফাস্ট করেই বেরোতে হবে।সারাদিন কাজা ভ্রমণ আর ফিরে এসে হোটেলেই লাঞ্চ ।
কিব্বের
১৪২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কিব্বের ভিলেজের জনসংখ্যা মাত্র ৩৫০।এমন রুক্ষ ভূমিরূপ কৃষিকাজেরও অন্তরায়।সারা উপত্যকা জুড়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নীচু নীচু ছাদের ঘর।গাড়ীর দরজা খুলে নামতেই কারোর কারোর একটু একটু শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। অগত্যা তারা গাড়ীতেই বসে রইল।খুব ইচ্ছে হলো উপত্যকা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ওদের বাড়ীগুলোর কাছাকাছি চলে যাই কিন্তু বুঝলাম অক্সিজেনের যথেষ্ট অভাব এবং বেশিদূর গেলে ফিরতে অসুবিধা হতে পারে।ভাবতে অবাক লাগে ডিসেম্বর -জানুয়ারী মাসে প্রায় ৫ ফুট বরফের নীচে চলে যায় এই গ্ৰাম।
কিই মনাস্ট্রি
কিব্বের থেকে প্রায় ১৩ কিমি দূরে ১৩,৬৬৮ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কিই মনাস্ট্রি । দূর থেকে দেখলে মনে হয় পাহাড়ের গায়ে আটকে থাকা মৌচাক। একাদশ শতকে এই মনাস্ট্রি নির্মাণ করা হয়।এটি মূলত বৌদ্ধ লামা সন্ন্যাসীদের ট্রেনিং সেন্টার।সারা মনাস্ট্রির দেওয়াল জুড়ে অসাধারণ সব পেন্টিং, বিচিত্র তিব্বতীয় দেবমূর্তি,ম্যুরাল ও বৌদ্ধলিপি।মনাস্ট্রির একদম শেষ ধাপে পৌছোনো বেশ কষ্টকর। কিন্তু সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে চারপাশের দৃশ্য অসম্ভব মনোমুগ্ধকর।নীচের উপত্যকার দিকে তাকালে দেখা যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে স্পীতি নদী কি অসাধারণ জালিকা তৈরি করেছে।গাঢ় নীল রঙের সেই সব জলধারা দুধসাদা নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে কি এক ম্যাজিক্যাল ভঙ্গিতে বয়ে চলেছে যেন।
ল্যাংজা
কিই মনাস্ট্রি দেখে চললাম ১৪৫০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ফসিলস ভিলেজ ল্যাংজা। এখানে রয়েছে আকাশছোঁয়া এক প্রশান্ত বুদ্ধমূর্তি (২০-২৫ ফুট)। চারপাশে রুক্ষ উঁচু পাহাড়ের দেওয়াল । মাঝে খানিকটা উপত্যকা জুড়ে খুব স্বল্প মানুষের বাস।গ্ৰামের রাস্তায় একটু ঘোরাঘুরি করছি কিন্তু কিছুক্ষণ পরপরই যেন একটা শব্দ পাচ্ছি।ইট বা ঢিল ছুঁড়লে যেমন শব্দ হয়।কৌতুহল দমন করতে না পেরে নিতীশকে জিঙ্গাসা করতেই বললো,ম্যাডাম,শুটিং স্টোন।পাথর পড়ছে পাহাড় থেকে ।সারাক্ষণ এমন পড়তেই থাকে।জোরে হাওয়া দিলে যে কোনো মুহূর্তে এই টুপটাপ করে খসে পড়া পাথর ধস নামিয়ে ফেলবে আর রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। সমগ্ৰ স্পীতি ভ্যালি জুড়ে আমি বিভিন্ন রাস্তায় খুব বিপজ্জনক অবস্থায় বি.আর.ও.(B .R.O) দের কাজ করতে দেখেছি।এমন আকাশছোঁয়া প্রশান্ত বুদ্ধমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল ,এই অপার হিমশূণ্যতা,সবুজের চিহ্নমাত্র বিলীন ,প্রতি মুহূর্তে ধস নামার আশঙ্কা এসব নিয়ে যখন রাত নেমে আসে উপত্যকার বুকে সে তখন এক আদিম পৃথিবী হয়তোবা।
কোমিক
ল্যাংজা থেকে খুব কাছেই কোমিক ।১৫০২৭ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত কোমিক এশিয়ার উচ্চতম গ্ৰাম। এখানকার মনাস্ট্রি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মনাস্ট্রিগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু বেশিক্ষণ হাঁটাচলা করলেই অক্সিজেনের বেশ অভাব বোধ হয়।
হিক্কিম
প্রায় ১৪৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত হিক্কিম ভিলেজ ।এখানে রয়েছে এশিয়ার উচ্চতম পোস্ট অফিস। ভালোবাসার মানুষকে চিঠি লিখে অনেকেই এই পোস্ট বক্সে ফেলে দিয়ে যান।
এইসব অপার্থিব সৌন্দর্য্য সত্যিই বাক্ রুদ্ধ করে দেয়। জীবনের পরম প্রাপ্তি হয়ে থাক সবটুকু।এবার হোটেলে ফিরতেই হবে।লাঞ্চ সেরে বেরিয়ে পড়বো পিন ভ্যালির উদ্দেশ্যে।
পিন ভ্যালি
পিন ভ্যালির রাস্তা মূলত ভীষণ ভাবেই ধসপ্রবণ । পুরোটাই রক্ ফল জোন।যত যাচ্ছি ততই স্পীতি কাছে আরো কাছে ,যেন ছূঁয়ে ফেলব এবার।প্রচণ্ড হাওয়া চলছে। চারপাশের ক্ষয়প্রাপ্ত পাহাড়গুলোর এক একটায় এক এক রকমের ভাস্কর্য ফুটে উঠেছে। কোথাও মনে হয় বিরাট কোনো দানবের থাবা,আবার কোথাও মিশরীয় স্ফিংস্ অথবা যেন সারিবদ্ধ কিছু প্রানী।এক জায়গায় গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হলো। সামনে ধস পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।বি.আর.ও লোকজন রাস্তা ক্লিয়ার করছে। সামনে এগোনো যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই বললো"আপলোগ তো পিন ভ্যালি মেহি হো।আগে যানে সে রিস্ক হো যায়েগা।"অগত্যা আমরা আর এগোতে পারলাম না।
৩৫০০ মিটার থেকে ৬০০০ মিটার পর্যন্ত এই পিন্ ভ্যালির বিস্তার। এমনিতেই নাকি প্রায় রোজ ধস নামছে।রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলে এই হিমালয়ান ডেসার্টে খোলা আকাশের নীচে গাড়ীতেই রাত্রিযাপন ব্যতীত উপায়ান্তর থাকবে না।সুতরাং আর অ্যাডভেঞ্চারাস হয়ে লাভ নেই।তাই নেমে পড়লাম স্পীতির জলধারায় নিজেকে ভিজিয়ে নেবো বলে।এখান কিছুটা তুঁত্ রঙা সে।সেই কোন্ সুদূর হিমবাহ থেকে নেমে এসে অবিরাম জলধারায় ভিজিয়ে দিচ্ছে ভালোবাসার রুক্ষ পাহাড়টাকে।কি অপূর্ব তার বয়ে চলার শব্দ।স্বচ্ছ স্ফটিক নীল জলের নীচে , চারপাশে ধবধবে সাদা নুড়ি পাথর।দূরে বরফের গ্লেসিয়ার ।মনে হয় অনন্তকাল চেয়ে থাকি।তবু সময় শেষ হয়।তবু চলে যেতে হয়।
হোটেলে ফিরে কফি ,হট্ চকোলেট,কেক আর কুকিস্ খেয়ে নিজেদের একটু চাঙ্গা করতে হলো কারণ ঠাণ্ডার প্রকোপ উত্তরোত্তর বাড়ছিল।ডিনার টেবিলে কয়েকজন পর্যটকদের মুখে শুনলাম আমাদের পরেরদিনের যাত্রাপথ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। সারারাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারিনি। পরেরদিন বিজয়া দশমী।
কুনজুম পাস
কুনজুম পাস
কাজা থেকে খুব সকালে হালকা ব্রেকফাস্ট করে, গাড়ীতে বেশ কিছু ড্রাই ফুড,জল,আর কল্পা থেকে আনা প্রচুর আপেল, নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম লাহুল উপত্যকার উদ্দেশ্যে।কাজা থেকে লাহুল উপত্যকা যেতে হয় কুনজুম দিয়ে। বছরের বেশীরভাগ সময় তুষারপাতের ফলে এই পাস বন্ধ থাকে। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত পাস বন্ধ থাকে।কুনজুম স্পীতির উচ্চতম স্থান।প্রায় ১৪,৯৩১ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই পাস থেকে পরপর তিনটি হিমবাহ খুব কাছ থেকে দেখা যায়।দেখা যাচ্ছে চন্দ্রভাগা শৃঙ্গসহ আরো অসংখ্য তুষারাবৃত শৃঙ্গ। মনে হয় যেন গলানো রূপো কেউ ঢেলে দিয়েছে পাহাড়ের চূড়ো থেকে।কুনজুম পাসে রয়েছে কুনজুম মাতার মন্দির ও একটি চোর্তেন। হাওয়ার গতিবেগ এখানে এতটাই প্রবল যে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। এখানে বলে রাখি কুনজুম থেকে ৬কিমি দূরে হাঁটাপথে চন্দ্রনদীর উৎস চন্দ্রতাল।চন্দ্রতালে অনেকেই টেন্ট করে রাত্রিবাস করেন।হাতে সময় থাকলে অবশ্যই ঘুরে দেখে আসবেন। আমাদের পক্ষে সময়ের অভাবে সম্ভব হয়নি। কিছু মুহূর্ত, কিছু কথা ব্যাখ্যাতীত হয়।স্পীতি উপত্যকা কে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চললাম লাহুল উপত্যকার দিকে।
সম্পূর্ণ ট্যুরের এই অংশটি আমার সবচেয়ে বিপদসংকুল মনে হয়েছে।কুনজুমের পর থেকে ভীষণ রকমের খারাপ রাস্তা শুরু হয়ে গেলো।প্রায় পনেরো ষোলোটা ঝোরা বা নালা পার হওয়ার সময় প্রত্যকবার গাড়ি থেকে নামতে হয়েছে।জুতো মোজা খুলে হাতে নিয়ে পার হচ্ছি সেইসব হীমশীতল জলের ঝোরা। কোথাও কোথাও রাস্তা বলে প্রায় কিছুই নেই। সামনের পাথর সরিয়ে রাস্তা তৈরি করে নিতে হচ্ছে।এপাশে খাঁড়া পাহাড় ওপাশে অতলান্ত খাদ।রাস্তা দিয়েই নদী বইছে। মুহূর্তের অসাবধানতায় সব শেষ হয়ে যেতে পারে। হঠাৎ হঠাৎ গাড়ীর ছাদে পাথর পড়ার শব্দ। দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছে এখনো অনেক পথ বাকি।এপথে পর্যটক খুব কম আসে।তাই ওই একটি দুটি গাড়ি। মাঝে মাঝে দেখা মেলে বাইক রাইডার । দু'জন ইউরোপিয়ানকে সাইক্লিং করতেও দেখেছি। হঠাৎ কিছুদূরে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো।পরে শুনেছিলাম পাথরের ধাক্বায় গাড়িটি বিকল হয়ে যায়।এই পাহাড়ী পথে সকলেই সকলকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায়। তাছাড়া রাস্তা এতোটাই সরু যে সামনের গাড়িকে অতিক্রম করাও সম্ভব নয়। নীতিশ সাহায্যের জন্য এগিয়ে গেলো।আমরা গাড়ীর ভেতরে, দরজা লক্ করা এবং গাড়ির উইন্ডো গ্লাস তোলা। হঠাৎই কেমন যেন মনে হলো গাড়ি টা পেছনের দিকে একটু গড়িয়ে গেলো।আবার এবং আবারও
একই অনুভূতি হওয়াতে অন্যদের জিঙ্গাসা করেও কোনো সদুত্তর পেলাম না।সকলেই ক্লান্ত। ভাবলাম আমারই বিভ্রম। হয়তোবা মাউন্টেন সিকনেস।কিছুক্ষণের মধ্যেই নীতিশ ফিরে আসতে কথাটা বলতেই ও কেমন যেন চুপ করে গেল।লাহুলের সদর শহর কেলং এর দূরত্ব কাজা থেকে ১৮৭ কিমি। সন্ধ্যে পার করে হিমাচল ট্যুরিজমের হোটেল চন্দ্রভাগায় পৌঁছে মনে হয়েছিল দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটল বুঝি।আমাকে একটু আলাদা ডেকে নীতিশ যা বলল তার অর্থ হলো খুব হাই অল্টিটিউড এ অক্সিজেনের মাত্রা কম থাকায় নাকি গাড়িও কখনো কখনো দুলতে থাকে।তবে আমার ধারনা বায়ুর চাপ কম থাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। অর্থাৎ আমার সঠিক অনুভবই হয়েছিল। গাড়িটা একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছিল। গাড়ির দরজা লক্ করা তার যে উচিত হয়নি এ কথাও বলল নীতিশ।।আর ভাবার শক্তি ছিল না। বিজয়া দশমীর রাতে নিজেদের যে বিসর্জন হয়ে যায়নি এই তখন অনেক ছিল।
কেলং
রুক্ষ শীতল মরুভূমির দেশ লাহুল উপত্যকায় পপলার আর উইলো গাছে ঘেরা কেলং যেন এক লাবণ্যময়ী মরূদ্যান।পর্বতের ভূমিরূপ এখানে অনেকটা লাডাকের মতো। রুক্ষতারও কত রূপ।এখান থেকে দেখা যায় লেডি অফ্ কেলং শৃঙ্গ। শ্বেতশুভ্র হিমমুকুটে রাজেন্দ্রানী সে। পরদিন সকালে একেবারে ব্রেকফাস্ট করে লাগেজ নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি।৩কিমি দূরে তায়ুল গ্ৰামে রয়েছে পদ্মসম্ভবের বিশাল মূর্তি।হাতে সময় থাকলে কেলং থেকে লাডাকের রাস্তায় কিছুটা ঘুরে আসা যায়।এরপরে উদেপুরে মৃকুলাদেবীর মন্দির দর্শন সেরে রোটাং এর পথে আমরা।
রোটাং পাস-- মানালি
অসম্ভব সুন্দর মেঘমুক্ত আকাশ দেখতে দেখতে রোটাং পার হচ্ছি। ফিরে আসছে সবুজের ছোঁয়া । হাতছানি দিয়ে ডাকছে মানালি। মুঠোফোনে নেটওয়ার্ক ফিরে আসছে।ভেসে আসছে বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা বার্তা।
আমরা চেনা পৃথিবীতে ফিরে এলাম।পেছনে ফেলে এলাম রোমাঞ্চকর এক অচেনা পৃথিবী। অবিশ্বাস্য সেই ভয়ঙ্কর সুন্দরের মাঝে বারে বারে হারিয়েছি নিজেকে।
জীবনের কিছু মুহূর্ত, কিছু কথা, কিছু ভালোলাগা মনের গহন গহীনে থেকে যায় আমৃত্যু।জন্মান্তরে বিশ্বাস করি নি কখনও। জানি,"একদিন এ দেখা হয়ে যাবে শেষ, পড়িবে নয়ন -'পরে অন্তিম নিমেষ"।
অসাধারন বললেও কম বলা হয়। এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি যা এই লেখনীর পড়তে পড়তে অনুভব করলাম। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য্য দর্শন করতে।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ মন ভরানো লেখা...
উত্তরমুছুনঅসাধারণ এক ভ্রমণের বর্ণনা।বেশ মনোগ্রাহী একটা লেখা।অনেক ভালোবাসা
উত্তরমুছুন