নন্দিতা মিত্র
আন্দামানের অন্দরমহলে
স্কুলের ইতিহাসের ক্লাস চলছে। ছোট্ট মেয়েটি
গম্ভীর স্বরের দিদিমণির কাছ থেকে পরাধীন ভারতবর্ষের গল্প শুনছে, আর বারবার শিহরিত
হয়ে উঠছে সেলুলার জেলের বন্দীদের ওপর হওয়া অকথ্য অত্যাচার হওয়ার কাহিনী শুনে। সেই
শুরু, এরপর বাড়ীতে বাবার কাছে শুনতে পেল এক অচেনা দ্বীপের রহস্য যেখানে মাঝে মাঝে জেগে
ওঠে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি, যেখানে থাকে সভ্য জগৎ থেকে বহুদূরে বাস করা এক আদিম
জনগোষ্টী। বিভীষিকাময় কালাপানির কথা শুনতে শুনতে মেয়েটির স্বপ্নে মাঝে মাঝেই হানা
দিত সেই দ্বীপ আর সেই অচেনা, অদেখা দ্বীপের অমোঘ টানে মেয়েটি শুধু ভাবতো – ইস্ বড়
হয়ে যদি একবার সেখানে যেতে পারতাম......
অবশেষে সেই সুযোগ একদিন এসে গেল। শরৎকালের এক
ভোরবেলায় সপরিবারে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে চড়ে বসলাম। গন্তব্য আন্দামান। এ সেই
আন্দামান যা এককালে কালাপানি নামে পরিচিত ছিল এবং সেই নামের কালিমা মোচন করতে
অনেকদিন সময় লেগেছিল। এ সেই কালাপানি যেখানে হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী মানুষ যারা
শাসকের চোখে বিদ্রোহী, অপরাধী তাঁদের জন্য ছিল অন্তিম গন্তব্যস্থল। আন্দামান
সম্পর্কে একটি তথ্য হল এখানকার বিমানের টিকিট ওপেন হয় ঠিক এগারো মাস আগে এবং সীমিত
সংখ্যক স্বল্পমূল্যের টিকিট পাওয়া যায়। কলকাতা থেকে মাত্র দুঘণ্টার দূরত্বে
পোর্টব্লেয়ারের কাছাকাছি প্লেন নিম্নগামী হতেই জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম
বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে ভেসে ওঠা সবুজে মোড়া দ্বীপপুঞ্জ ঠিক যেমন ভূগোলের মানচিত্রে
এতদিন দেখে এসেছি। বীরসাভারকার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে দেখি আমাদের নামে
প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন গাড়ীর ড্রাইভার। হাসিমুখে আমাদের মালপত্র গাড়ীতে
তুলে বললেন পরবর্তী দিনগুলোতে তিনিই হবেন আমাদের সফর সঙ্গী। ঝকঝকে রাস্তা ধরে
মিনিট দশেকর মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হোটেলে। হোটেলের ম্যানেজার সাদরে অভ্যর্থনা
জানালেন। আন্দামানের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট এখানে দিগন্তবিস্তৃত নীল সমুদ্রের
পাশাপাশি রয়েছে গভীর অরণ্য। আবার যারা পাহাড় ভালবাসে তাদেরও নিরাশ করবে না।
যেহেতু সকাল সকাল পৌঁছে গেছি, তাই হাতে
পর্যাপ্ত সময় ছিল। একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সাইটসিয়িং-এর উদ্দেশ্যে।
প্রথমেই গেলাম অ্যানথ্রোপলজিকাল মিউজিয়ামে। এখানে আন্দামান ও নিকোবরের জন-জাতিদের
জীবনকাহিনী ও তাঁদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, অস্ত্রশস্ত্র মডেল আকারে বর্ণিত আছে। এটি
প্রকৃতপক্ষে আদিবাসী সংস্কৃতির সংগ্রহশালা ও প্রদর্শনশালা। এরপর গেলাম ফিশারিজ
মিউজিয়ামে। এখানকার সামুদ্রিক সংগ্রহশালা দেখে চলে এলাম ভারতীয় নৌবাহিনীর মিউজিয়াম
‘সমুদ্রিকা’য়। টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল প্রায় ২৫ ফুট তিমির কঙ্কাল।
এখানে বিভিন্ন ধরনের কোরাল কাঁচের বাক্সে সুন্দরভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। এছাড়াও আছে
কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ এম্পোরিয়াম। এখান থেকে ঝিনুকের নানাবিধ জিনিস, গয়না, শাঁখ ও
কাঠের শোপিস-সহ বিভিন্ন ধরনের গিফট আইটেম কেনা যায়। মিউজিয়ামে আন্দামানের ইতিহাস ও
বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটের ভিডিও দেখানো হয় যার থেকে আন্দামান সম্পর্কে অনেক তথ্যই
সংগ্রহ করা যায়। সমুদ্রিকা থেকে বেরিয়ে চলে এলাম এশিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে পুরানো
(প্রায় ১২৫ বছরের) কাঠের কল চাথাম শ মিলে। এখানে বিশাল বিশাল গাছের গুঁড়ি থেকে কাঠ
চেরাইয়ের কাজ দেখার মতো। এর পাশেই রয়েছে মিউজিয়াম, মিউজিয়ামে কাঠের তৈরী হাতি,
জাহাজ বিশেষ দ্রষ্টব্য। এগুলির সূক্ষ্মকাজ পর্যটকদের নজর কাড়বেই। গাইডের মুখে
শুনলাম এখানকার কাঠের একটি বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা হল- এদের আলাদা করে পালিশ করতে হয়
না, রোদে, জলেও নষ্ট হয় না। মিউজিয়াম দেখে হোটেলে চলে এলাম লাঞ্চ করতে।
বিকেলে গেলাম ইতিহাস বিখ্যাত সেলুলার জেল
দেখতে। এই সেই জায়গা যার প্রতিটা ইটের মধ্যে রয়েছে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর
যন্ত্রণা, ত্যাগ আর আত্মবলিদানের হৃদয় বিদারক কাহিনী। এ সেই জায়গা যা ব্রিটিশ
শাসকদের অতীতের অত্যাচার ও উৎপীড়নের জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হয়ে বিরাজ করছে।
সেলুলার জেলের মোট সাতটি উইংসে আছে ৬৯৮ টি সেল। তার মধ্যে মাত্র ৩ টি উইংস অবশিষ্ট
আছে। বাকিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশাল বাড়ির প্রতিটি তলায় সারি সারি জানালাহীন ছোট
ছোট খুপরি। এখানেই রাখা হত বন্দীদের। তিনতলার একেবারে কোণে রয়েছে বীর সাভারকারের
সেল। প্রতিটি সেলের মাপ সাড়ে তেরো ফুট বাই সাড়ে সাত ফুট। সামনে মোটা গারদ। এই
জেলের বিশেষত্ব হল কোনো বন্দী কাউকে দেখতে পেত না। এইসব দেখতে দেখতে চোখে আপনিই জল
চলে আসে আর মাথা শ্রদ্ধায় অবনত হয়। এই ছোট্ট ছোট্ট ঘরেই ঝরে গেছে কত বিপ্লবীর
সারাজীবনের স্বপ্ন। জেলের সামনেই ফাঁসিমঞ্চ, যা অত্যাচারের চরম নিদর্শনরূপে
দৃশ্যমান। এখনও হয়তো খুঁজলে পাওয়া যাবে লোহার ত্রিকোণ ফ্রেমে চাবুকের দাগ। গাইডের
মুখে শুনলাম শুধু ব্রিটিশরা নয়, ১৯৪৪ সালের ৩০ শে জানুয়ারী জাপানিরা ৪৪ জনকে
সেলুলার জেল থেকে বের করে কিছুদূর নিয়ে তাঁদের দিয়ে গর্ত খোঁড়ায় এবং সবাইকে সেখানে
গুলি করে মেরে ফেলে মাটি চাপা দেয়। ঠিক পাঁচটায় শুরু হল লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো।
জীবন্ত হয়ে উঠল বটুকেশ্বর দত্ত, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, বীর সাভারকার
ও আরো অজস্র বিপ্লবীদের যন্ত্রণা-গাথা। জেলের ইতিহাস, বিপ্লবীদের কাহিনী এত সুন্দর
করে পরিবেশিত হচ্ছিল যেন মনে হচ্ছিল সেই ঘটনাবলী চোখের সামনেই ঘটছে। শো-এর শেষে
ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে চলে এলাম হোটেলে।
পরেরদিন আমাদের গন্তব্য রস আইল্যান্ড। জেটিতে
এসে রাজীব গান্ধী স্পোর্টস কমপ্লেক্স থেকে টিকিট কেটে লঞ্চে করে সমুদ্রের জলের উপর
ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেলাম রস আইল্যান্ডে। রস দ্বীপ ছিল ব্রিটিশ আন্দামানের
প্রশাসনিক দপ্তর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাত ধরে ব্রিটিশদের আগমন ঘটে এখানে। ধীরে
ধীরে তারা গড়ে তোলে চার্চ, স্কুল, হাসপাতাল। রস দ্বীপ ছিল আন্দামানের মধ্যমণি।
কিন্তু ১৯৪২ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্প ও জাপানী হানায় এই দ্বীপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে
জাপানী বাঙ্কারগুলো আজও জাপানী আগ্রাসনের সাক্ষী বহন করে চলেছে। দ্বীপের ভিতরে
প্রবেশ করতেই ঘিরে ধরল চিতল হরিণের দল। পথে যেতে যেতেই দেখা হল ময়ূর, খরগোশের সাথে।
এখানকার কুলপির অনন্য স্বাদ নিতেও ভুললাম না। ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম তৎকালীন
ব্রিটিশ চার্চ, হাসপাতাল, বেকারি, অফিসারদের নিবাস। তবে সবই ধ্বংসস্তুপ। তার ওপর
২০০৪ সালের সুনামিতে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ধ্বংসস্তুপের বুকেই বিরাট বিরাট বটগাছের ঝুরি আর
শিকড় জড়িয়ে ধরে যেন পুরানো স্মৃতি আষ্টেপৃষ্টে ধরে রাখতে চাইছে। সারাদিন পর্যটকদের
আনাগোনায় মুখর হয়ে থাকে এই দ্বীপ। কিন্তু দিগন্ত জুড়ে যখন সন্ধ্যে নেমে আসে তখন
ইতিহাসের রাজসাক্ষী এই ধ্বংসস্তুপ আলো-শব্দের ছায়াধ্বনিতে জেগে ওঠে। শাবানা আজমীর
মায়াবী কন্ঠ আর গুলজারের অনবদ্য রচনায় ঐতিহাসিক মুহূর্তরা জীবন্ত হয়ে ওঠে।
বিকেলবেলায় চলে গেলাম করবাইনস্ কোভ বিচে।
বিচে যাওয়ার রাস্তা ভীষণ সুন্দর। পুরো বিচ জুড়ে নারকেল গাছ। সমুদ্রপারে নারকেল
গাছের তলায় বেঞ্চে শুয়ে শুয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দারুন লাগছিল। সামনেই অতলান্ত
সমুদ্রের ঢেউ সগর্জনে তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। ধনুকের মতো বাঁকা নারকেলগাছ সুশোভিত
সমুদ্র সৈকতের আকর্ষণকে উপেক্ষা করা যায় না। একান্ত নির্জনে সমুদ্রকে উপভোগ করতে
চাইলে এই সৈকতটি প্রকৃতপক্ষেই আদর্শস্থান। সৈকতের জলে অনেকক্ষণ পা ভিজিয়ে চুপচাপ
বসে থাকি আর এই সমুদ্র সৈকতের সাথে নারকেলগাছ গুলির একান্ত নিভৃত প্রেমালাপ শুনতে
থাকি। সমুদ্র তার শীতল হাওয়ার মাধ্যমে প্রেম নিবেদন করছে নারকেলগাছকে আর
নারকেলগাছের পাতা তার শনশন আওয়াজে সম্মতি জানাচ্ছে। কখনও বা নিজে আত্মসমর্পণ করার
ভঙ্গীতে ঝুঁকে পড়ছে সমুদ্রের বুকে, সমুদ্রও তাকে আলিঙ্গন করে উপহার দিচ্ছে উষ্ণ
চুম্বন। এই অপার্থিব দৃশ্যের সাক্ষী রইলাম আমরা কয়েকজন।
সন্ধ্যেবেলায় হোটেলে ফিরে আসতেই রিসেপশন থেকে
জানানো হল আমাদের পরেরদিন গন্তব্য নীল ও হ্যাভলক দ্বীপ। সকাল সকাল বেরিয়ে পৌঁছে
গেলাম পেনিক্স বো জেটিতে। বিলাসবহুল শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ক্রজে প্রায় আড়াই ঘণ্টায়
পৌঁছে গেলাম নীল আইল্যান্ডে। আমাদের আস্তানা ভরতপুর বিচ সংলগ্ন একটি রিসোর্টে। বিশ্রাম
নিয়ে পৌঁছে গেলাম ভরতপুর সৈকতে। ভ্রমণপ্রেমী হওয়ার সুবাদে ভারতবর্ষের বেশ কিছু
সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। কিন্তু এখানে যা দেখলাম তা অকল্পনীয়।
অগভীর সমুদ্র, স্বচ্ছ নীলজলের সমুদ্রের মধ্যেই নানারঙের মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। জলে
জেটস্কি, স্নরকেলিং- এর মতো ওয়াটার স্পোর্টস চালু রয়েছে। জোয়ার এসে যাওয়ায় আর
কালবিলম্ব না করে কেটে ফেললাম গ্লাসবটম বোটের টিকিট। ইঞ্জিনচালিত বোটে লাইফজ্যাকেট
পরে আধঘণ্টার সফরে এগিয়ে চললাম অগভীর সমুদ্রের দিকে। বোটের কাঁচের পাটাতন যেটি আসলে
একটি শক্তিশালী আতসকাঁচ সেটা দিয়ে দেখলাম জলের তলার নানারকম রঙিন মাছ আর কোরালের
আশ্চর্যজগৎ। নিজের চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। এক অপরূপ রঙিনজগৎ পরিদর্শন
করে বিচে এসে আন্দামানের বিখ্যাত কিং কোকোনাট একা খাওয়ার চ্যালেঞ্জ নিয়ে
অবধারিতভাবে চ্যালেঞ্জ হেরে গেলাম।
জলের তলার এক অচেনা
জগতের সন্ধান নিয়ে ফিরে এলাম রিসোর্টে। লাঞ্চ করে আবার বেরিয়ে পড়লাম এই দ্বীপের
আরও দুই সমুদ্রসৈকতের উদ্যেশ্যে- সিতাপুর ১ ও ২ এবং লক্ষ্মণপুর। লক্ষ্মণপুর সৈকতে
যখন পৌঁছালাম তখন সূর্যদেব প্রায় পশ্চিমে হেলে পড়েছেন। সৈকতের অজস্র মৃত কোরাল
পাড়িয়ে এগিয়ে গিয়ে প্রত্যক্ষ করলাম এক আশ্চর্য প্রাকৃতিক রূপ যা নীলদ্বীপের সেরা
আকর্ষণ। বিরাট এক পাথরের ক্ষয়িষ্ণু রূপ এক অভিনব আর্চের জন্ম দিয়েছে যার নাম
ন্যাচারাল ব্রিজ। স্থানীয়রা ভালবেসে নাম দিয়েছেন হাওড়া ব্রিজ। এই ন্যাচারাল
ব্রিজের চারিদিকে সমুদ্রের কোলাজ সত্যিই দুর্দান্ত। এখানেই আমাদের গাইড হাতে নিয়ে
স্পর্শ করালেন জ্যান্ত কোরাল। হাতের তালুতে তুলে নিয়ে দেখালেন স্টারফিস। দোষীদের শাস্তি হিসেবে
কারাদণ্ড বা যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের কথা শুনেছি। কিন্তু সুন্দর এই প্রকৃতির মাঝে
বড় বড় ঝিনুকের বন্দীদশা দেখে মনখারাপ হয়ে গেল। সৈকতে পড়ে থাকা
ঝিনুকগুলোর চারপাশ পাথরের মতো শক্ত হয়ে
গেছে। মাঝে মাঝে যখন মুখ খুলছে তখন মুখের ভিতরের ময়ূরকণ্ঠী রঙের মাংসল অংশে
সূর্যের আলো পড়ে মুক্তোর দানার মতো ঝলমল করছে। হঠাৎ কখনও কখনও কাঁকড়া ও বিভিন্ন
সামুদ্রিক মাছ ঢেউয়ের ধাক্কায় ক্ষণিকের অতিথির মত পাথরের গর্তে এসে ঢুকে পড়ছে।
আবার হয়তো বা বড় কোনো ঢেউয়ের সাথে মিশে যাচ্ছে বৃহতের ঝাঁকে। অপূর্ব এই দৃশ্য শুধু
মনের ক্যামেরাতেই বন্দী করা সম্ভব।
নীল একটি ছোট্ট
ছিমছাম দ্বীপ। এখানে দোকানপাট, রেস্তোরা, এমনকি স্কুলও আছে। অধিকাংশ বাসিন্দাই বাঙালী। আসলে সমগ্র
আন্দামানেই বাঙালীদের সংখ্যা প্রচুর। দেশভাগের ক্ষত বুকে নিয়ে এঁরা এখানে স্থায়ী
বসতি গড়ে তুলেছেন। বাকি বাসিন্দাদের মধ্যে আছেন দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের
মানুষ। রিসোর্টে কর্মরত একটি ছেলের কাছে শুনতে পেলাম সুনামির ভয়াবহ স্মৃতি। গল্প
শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আপাত নিরিহ এই শান্ত নীলজলের সমুদ্র কি ভয়ঙ্কর! অনেক রাত
অবধি সমুদ্রের শব্দ শুনতে শুনতে কখন যেন ঘুমের রাজ্যে চলে গিয়েছিলাম।
পরদিন সকাল সকাল আবার বেরিয়ে পড়া। আজ আমাদের গন্তব্য
আন্দামানের আরেক সুন্দরী আইল্যান্ড হ্যাভলক। নীল দ্বীপ থেকে আসার সময়ই সফেদ ফেনিল
সমুদ্রের জল কেটে তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে ক্রুজ। যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর পর্যন্ত
দেখা যায় গাঢ় নীল শান্ত সমাহিত সমুদ্র। চারিদিকের নয়নভিরাম দৃশ্যপট দেখতে দেখতেই
পৌঁছে গেলাম হ্যাভলক দ্বীপে। হোটেলে পৌঁছে মালপত্র রেখে প্রথমেই গেলাম গোবিন্দপুর
বিচে। এই জায়গা প্রধানত স্কুবা ডাইভিং-এর জন্য বিখ্যাত। লাঞ্চের পরে গেলাম ২০০৪
সালের টাইমস্ পত্রিকার বিচারে এশিয়ার সুন্দরতম সমুদ্র সৈকতের শিরোপা পাওয়া
রাধানগর বিচে। চোখজুড়ানো বিস্তৃত সৈকত জুড়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আনাগোনা। জলে
বেশ ঢেউ থাকলেও সমুদ্র স্নানের পক্ষে উপযুক্ত সৈকত। সমুদ্রের ধারে গাছের ছায়ায়
বসার জন্য রয়েছে বেঞ্চ, কটেজ। এখানে বসেই বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। এখানকার স্বচ্ছ
শান্ত নীল জল আর দূরে সবুজে ঘেরা ছোট ছোট
পাহাড় দেখে মনে হল নীলের ক্যানভাসে যেন প্রকৃতির অপরূপ তুলির টান পড়েছে। কোনো
সন্দেহ নেই এটিই আন্দামানের সেরা সৈকত। হঠাৎ সূয্যিমামা পাটে যাওয়ার আগে তার ঝুলিতে
থাকা সমস্ত আবির মাখিয়ে দিলেন আকাশের গায়ে। সূর্যদেবের বেলাশেষের বিদায়ী চুম্বনে
লাজে রাঙা হয়ে উঠছে প্রেমিকা আকাশ। এ
দৃশ্য কখনোই ভোলার নয়। দৃশ্য দেখে মনে হল এক মায়াবী প্রেমের গল্প লেখা হয়ে গেল
এখানেই।
পরেরদিন
গেলাম হ্যাভলকেরই আরেক বিখ্যাত কালাপাত্থর সমুদ্রসৈকতে। সৈকতের প্রবেশমুখে দুটো
বিশালাকার কালো পাথরের জন্য এরূপ নামকরণ। সুন্দর ও নির্জন সৈকতের জল কখনও গভীর নীল
বা পান্না সবুজ বা ফিরোজা। সমগ্র আন্দামানেই যে সমুদ্রই দেখছি না কেন তাতে যেন
কোনো দক্ষ চিত্রকর তার প্যালেটে থাকা নীল আর সবুজ রঙ নিয়ে খেলা করেছে ইচ্ছেমতো।
চারিদিকে শুধু নীল আর সবুজের বৈচিত্র্য। রঙ নিয়ে খেলতে খেলতে একসময় যখন তার রঙ শেষ
হয়ে গেছে তখন সমুদ্রতটের বালির রঙ হয়ে গেছে সাদা। এই যুগ্ম বৈপরত্যই এক অতুলনীয়
ছবির সৃষ্টি করেছে যার আকর্ষণে পর্যটকগণ দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন বারবার। পুরো
আন্দামানই ছবির মতো সুন্দর। প্রতিটি জায়গা যেন ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে উঠে এসেছে।
সমগ্র আন্দামান যেন তার সব রঙ, রূপ, রস দিয়ে পর্যটকদের দুহাত বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে
আর বলতে চাইছে “তোমরা আমার অতীত কালিমা ঘুচিয়ে দিয়ে আমায় নিবিড়ভাবে গ্রহণ করো”।
সমুদ্রের রূপও এখানে একেক জায়গায় একেকরকম- কোথাও শান্ত স্নিগ্ধ আবার কোথাও বা
উত্তাল।
এখানে বেশ কিছুটা
সময় কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। লাঞ্চের পরে ফের ক্রুজে করে সমুদ্রভ্রমণ উপভোগ করতে
করতে ফিরে এলাম পোর্টব্লেয়ারের হোটেলে। এখানে এসে ম্যানেজারের কাছ থেকে দুঃসংবাদটা
পেয়েই গেলাম। ঘূর্ণিঝড় হুদহুদের আশঙ্কায় আমাদের পরেরদিনের ভ্রমণসূচী বাতিল করা
হয়েছে। এই সূচীতেই বারাতাং, লাইমস্টোন কেভ আর জারোয়াদের গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল।
আন্দামানের যেকোনো ঝড়ের প্রভাব এখানেই সবচেয়ে বেশী পড়ে বলে সরকারী নিষেধাজ্ঞা জারী
রাখা হয়েছে। একরাশ মনখারাপ নিয়ে বসে আছি। ইতিমধ্যে ম্যানেজার বললেন আমাদের জন্য আরেকটি
পরিবর্তিত ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জায়গাটির নাম চিড়িয়াটাপু। পোর্টব্লেয়ার
থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে দক্ষিণ আন্দামানের একেবারে দক্ষিণে এর অবস্থান। দুগ্ধসাদা
সাফারিতে চেপে আমরা চলেছি চিড়িয়াটাপু দর্শনে। তার আগে প্রথমে গেলাম সিপ্পীঘাটের
মশলাপাতির বাগানে। এই বাগানের চারিদিকে নৈঃশব্দ বিরাজমান। প্রায় ৮০ একর জুড়ে থাকা
বাগানের সাথে পরিচয় করাতে থাকেন মালী। মোরামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে থাকি। মালীর
স্মৃতিচারণায় জানতে পারি ১৯৭১ সালে শুরু করে একাধারে কৃষিজাত ফসল, অর্থকারী ফসল,
ফল ও মশলাপাতির উৎপাদনে নজীর সৃষ্টি করেছে এই বাগান। বাগানের উঁচুনিচু জমিতে গাছে
গাছে বিভিন্ন ফল ধরে আছে। চারিদিক জায়ফল, লবঙ্গ, দারচিনি, গোলমরিচ, এলাচ আর
তেজপাতার গন্ধে ভরে আছে। বাগান দেখে গাড়ীতে উঠি। গাড়ী ছুটতে থাকে মংলুটনের দিকে।
চারিদিকে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী। কাছে ও দূরে আদিম রেইনফরেস্ট আবৃত দ্বীপ।
পথের দুপাশে পান ও সুপারির দৃষ্টিনন্দন সারি সারি বাগান। মংলুটন বিখ্যাত লম্বা
লম্বা রাবারগাছের জন্য। এই গাছের ওপরের দিকের শাখা-প্রশাখা পুরু পাতায় আচ্ছাদিত
হওয়ায় দারুণ দেখতে লাগছিল। শ্রমিকরা রাবার গাছ থেকে ঘন দুধের মতো সাদা আঠা সংগ্রহ
করছে আর তা প্রেরণ করছে পার্শ্ববর্তী
কারখানায়। সেখানকার কর্মীরা আমাদের বিশদভাবে বুঝিয়ে দিলেন কিভাবে রাবারশিট তৈরি
হয়।
এবার আবার যাওয়ার
পালা। গন্তব্য চিড়িয়াটাপু। এখানে যাওয়ার রাস্তাটি অপূর্ব। পথের দুপাশে বড় বড়
বৃক্ষরাজি হাতছানি দিয়ে ডাকে। এটি পাখীদের সাম্রাজ্য। কিন্তু সুনামির বিধ্বংসীরূপ চতুর্দিকে
বর্তমান। বসতবাড়ি, হোটেল, বড় বড় মহীরুহের কঙ্কাল- সর্বত্রই সুনামির করালগ্রাস
সুস্পষ্ট। চিড়িয়াটাপুর মূণ্ডা পাহাড় সৈকতেও সুনামির ভয়াবহতা বিদ্যমান। সমুদ্র-তীরবর্তী চিরসবুজ ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সাম্রাজ্য, গভীর
অরণ্যের পাখিদের কলকাকলি, বালুকাবেলায় ঝিনুক-এই সবকিছুই মনে বয়ে আনে এক অনাবিল আনন্দ
যা বর্ণনাতীত। ছোট ছোট ঢেউ এসে পাড়ে ভাঙতে থাকে। বিচটি বেশ নিরিবিলি। চারিদিকে ছড়ানো আছে রঙ-বেরঙের শামুক, ঝিনুক।
সমুদ্রের বিশালতার সামনে কেমন যেন মন উদাস হয়ে যায়। এক বিশাল শূন্যতা গ্রাস করে মনকে।
পৃথিবীর চিরন্তন সত্য একাকীত্মকে অনায়াসে উপলব্ধি করা যায়। ঢেউ ভেঙে সামনের দিকে
এগোতে থাকি আর চারিপাশের সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্যের অমৃতসুধা পান করতে থাকি। এখানে
থাকতেই সূয্যিমামার পাটে যাওয়ার সময় হয়ে
এল। আবার শুরু হল রঙের সেই মায়াবী খেলা যে খেলা দেখে আরো একবার আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।
এই খেলা দেখতে দেখতে সব মন খারাপ মিলিয়ে যায় দিগন্ত রেখায়। সারাদিনের ক্লান্তি
শেষে নীলজলের অতল আহ্বানে সূর্য ডুব দেয় সোনার আগুন ছড়িয়ে। নীরব নৈঃশব্দ পাখীদের
ডাক দেয় ঘরে ফেরার জন্য। আবছায়া সমুদ্রতট, চিকচিকে সাদা বালিতে ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ
শব্দ রেখেই আমরাও অস্থায়ী আবাসে ফেরার টান অনুভব করি।
অবশেষে শেষের দিন সমাগত। এই কদিনে অনেক ধরনের অভিজ্ঞতাই হল। কিন্তু এযাত্রায় আন্দামানের অনেককিছু অদেখা রয়ে গেল। এখানে থাকাকালীনই ঠিক করে নিলাম এখানকার রূপসুধা পান করার জন্য আবার একবার আসব। বঙ্গোপসাগরের বুকে দিগন্ত প্রসারী মুক্ত আদিম দ্বীপপুঞ্জ, নীল আর সবুজাভ সমুদ্র, শুভ্র ও সোনালী সৈকত, শত সহস্র নারকেল গাছের সারি, লক্ষ কোটির প্রবাল দ্বীপ, জারোয়া, নিকোবরি, ওঙ্গে প্রভৃতি আদিমবাসীদের বাসভূমি – সবাইকে বিদায় জানিয়ে দমদম এয়ারপোর্টগামী এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে চেপে বসলাম।
খুব ভালো লাগল ভ্রমণ
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ।🙏🙏🙏
মুছুনসমুদ্র নীল, নারকেল সারি, নয়নাভিরাম দ্বীপপুঞ্জ, ঝিনুক প্রবাল, সেলুলার ইতিহাস বা মিউজিয়াম প্রাচীনতা অসাধারণ মুন্সীয়ানার সাথে ধরা পড়লো নন্দিতার লেখায়। ছবিগুলোও চিত্তাকর্ষক। এমন ভ্রমণকথা ঘরকুনোদের ও হাত ধরে টেনে বের করে ভ্রমণপথে।
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ।🙏🙏🙏
মুছুনকরভাইনস্ বিচের কথা কখনো কেউ বলেনি কি সুন্দর লিখলে।তেমন অপূর্ব ছবি।নীলের টান বড় সাংঘাতিক।এই বদ্ধ প্রাণ উড়তে চায় পাখা মেলে।যাবোই আমি যাবোই।
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ। খুব খুশি হলাম।
মুছুনসুন্দর বর্ণনা। মুহুর্তেই চিত্রকল্প তৈরি হয়ে যায় মনের কোণে। এক লহমায় ঘুরে এলাম আন্দামান।
উত্তরমুছুন