সোমা কুশারী
জঞ্জাল
সকাল সকাল ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল নিলয়ের। কম্বলের তলা থেকে মুন্ডুটা অতি কষ্টে বার করে পাশে রাখা মোবাইলে চোখ রাখল, যাঃ! বাবা! সবে তো সাড়ে সাতটা! এখনো একঘন্টা আরামসে ঘুমিয়ে নেওয়া যেত। সাড়ে আটটায় উঠে ব্রাশ ফ্রাস করে দুটো টোস্ট আর সেদ্ধ ডিম গিলে রেডি হতে আর কতক্ষণ? নিউটাউনের এই ফ্লাটে আসার পর থেকে জীবন এখন বিন্দাস! নো হুটোপাটি নো ডেলিপাসন্ডগিরি! জাস্ট চিল! আবার ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দটা শুরু হলো..
এই সাত সকালে এমন শব্দবম্ভ্রের ঠেলায় তো আর শুয়ে থাকা যাচ্ছে না! বিরক্তির চোটে এক লাথিতে কম্বল ফম্বল মাটিতে ফেলে উঠে বসল নিলয়। দেখতে হচ্ছে তো কেসটা কী...
জানলার পর্দা সরাতেই করিডরের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। আরে! দু দুটো কাঠের আলমারি একটা আদ্যিকালের ছত্তিওলা খাটের ভগ্নাংশ দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। পাশের ফ্ল্যাটের দরজা হাট করে খোলা আর ওখান থেকেই শব্দটা আসছে... নিলয় মনে মনে ভাবলো, হবে হয়ত নতুন কোনো আবাসিক মালপত্র শিফট হচ্ছে! তারপরই মাথায় খেলে যায় এই ফ্লাটটা যেরকম পস এলাকায় সেখানে এমন পুরোনো পালিশ চটা আসবাবপত্র নিয়ে লোকজন ফ্লাটে থাকতে আসছে? কে জানে কী কেস! রেলকলোনীতে বড় হওয়া নিলয়ের ছত্তিওলা খাটটা দেখেই মিনুদিদিদের বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়,মিনুদিদির মা জেঠির ঝালরবোনা বালিশের ওয়াড় ফ্রেবিকের কাজ করা সাদা মার্কিনের বিছানার চাদর সব যেন ছবির মতো চোখে ভেসে ওঠে। বড্ড ভালোবাসতো জেঠি তাকে, নাড়ু মুড়ির মোয়া ইচামুড়া বানালেই নিলয়ের জন্য আগে বাটি করে তুলে রাখত তারপর পিঁড়ি পেতে বসে খাওয়াতো,
-খাও আমার মাণিক! পেটভরে খাও।
আচ্ছা জেঠি এখন কেমন আছে? জেঠু রিটায়ার করতে-ই সেই মদনপুরের দিকে বাড়ি করে চলে গেছিল মিনুদিরা। মিনুদিদির বিয়ের নেমন্তন্ন অবশ্য করে গেছিল জেঠু, নিলয়দের যাওয়া হয়নি। বাবার চোখের অপারেশনের ডেট পড়েছিল ঠিক ঐ সময়।
জানলার ধার থেকে সরে আসার আগে হঠাৎ চোখে পড়ল খোলা দরজা দিয়ে পুরোনো দিনের একটা ট্রাঙ্ক দুজন লোক টেনেটুনে বার করছে। তাহলে বোধহয় কোনো আবাসিক চলে যাচ্ছেন।
নিলয়ের মনে পড়ে যায়, সেই রেল কোয়ার্টারে যখন নতুন কোনো ফ্যামিলি পাড়ায় আসত তখন তাদের কোয়ার্টারে ঢোকার আগেই যাবতীয় ছানবিল সেরে ফেলত পাড়ার বাসিন্দারা। কোথা থেকে এলেন কোন শপে চাকরি করেন গৃহকর্তা বাড়িতে ক'জন আছে... এসব আর কী! তারপর মালপত্র টানাটানি থেকে গোছগাছ সবেই হাত লাগাতো পাড়ার লোক। এমনকি গোছগাছের সময় দুবেলা রান্নাবান্না করে নতুন প্রতিবেশীর কোয়ার্টারে পৌঁছে দেওয়াটাও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে মনে করত পাড়ার লোকজন।
বাবা, রিটায়ার্ড করার আগেই বাড়ি করে নিলয়রা চলে এসেছিল শহরের অন্যপ্রান্তে। সেখানেই প্রথম টের পাওয়া গেলো পাড়ার লোক মানে-ই নিজের লোক নয়। দোরগোড়ায় ভোরে জল দেওয়াকে কেন্দ্র করে যেদিন পাশের গলির লোকজনের সাথে ঝগড়ার মহড়া নিতে হলো সেদিন থেকেই বাবা মা কেমন যেন গুটিয়ে গেলেন। নিলয় তখন ভূবনেশ্বরে সিক্সথ্ সেমিস্টার চলছে, হঠাৎ মায়ের ফোন...
-গলির লোকেরা কাল তোর বাবাকে ভীষন অপমান করেছে নীলু!
-অপমান করেছে কেন?
-ঐ যে প্রদীপদাসের ছোটো ভাই রাজু যে পার্টি করে ও জানিস তোর বাবাকে মারতে পর্যন্ত এসেছিল!
-কী বলছ কী তুমি? এতবড় সাহস! বাবাকে বলো এফ আই আর করতে!
-পাগল! তুই বাইরে থাকিস এখানে আমরা দুটো প্রাণী একা! জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করবো?
-তাই বলে মেনে নেবে?
-মেনে না নিয়ে উপায় কী বল? বাড়ি করাটাই বোধহয় ভুল হলো রে আমাদের। কোয়ার্টারের লোক আমরা এসব বনেদি এলাকায় মানিয়ে নেওয়া তাও এই বয়সে সম্ভব নয় রে!
মাকে কিছু বলতে পারেনি নিলয়, ছুটিতে বাড়ি ফিরে দেখেছে পাড়াটা কেমন যেন অন্যরকম! কেউ কারো সাথে মেশে না সবাই যেন স্ট্যাটাস দেখাতে ব্যস্ত! চিরকাল পাড়ার ক্লাবে তাস পাশা খেলে সময় কাটানো বাবাও কেমন ঘরকুনো হয়ে পড়েছে। উপায়ও নেই! কবে যেন পাড়ার ক্লাব আর পার্টিঅফিস মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
নিলয়কে সেভাবে এ পাড়ার কেউ চেনে না। ছুটিতে দু দশদিন যা এসেছে তাতে সারাদিন ল্যাদ খেয়েছি দিন কেটে গেছে। টুকটাক বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া আড্ডা রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করতে করতেই দিনগুলো হুস করে কেটে গেছে। ক্যাম্পাস থেকে প্রথম যে চাকরিটা হয়েছিল সেটা সেই ব্যাঙ্গালোরে দুবছর ঘসার পর কলকাতায় যাও বা এই জবটা লাগলো তাতেও বাড়ি থেকে এতদূর রোজ সময়মতো যাতায়াত ইস কোয়াইট ইমপসিবল! অগত্যা নিউটাউনের এই আবাসন। নিজেকে মাঝে মাঝে নিলয়ের কেমন যেন ভারবাহী পশুর মতো মনে হয়! মর্নিং শিফট থাকলে সক্কাল সক্কাল মলিনামাসির দয়ায় ফ্লাটের ঝাড়পোছ তারপর রোজকার ব্রেড জ্যাম নয় বাটার টোস্ট গিলে দৌড় আর দৌড় নাইটশিফট চললে তো কথাই নেই সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুম আর সারারাত জেগে কাজ আর কাজ...
বাড়ি গিয়েও আজকাল পাতপেড়ে খেতে ইচ্ছে করেনা। মা বাবার সাথে বসে কথা বলার চেয়ে নেটফ্লিক্স ওয়েবসিরিজে ডুবে থাকতে-ই ভালো লাগে। স্বাভাবিক জীবনের প্যারামিটারগুলো কেমন যেন বদলে গেছে যাচ্ছে। প্রতিতীর সাথে সম্পর্কের বয়স ছ'বছরে পড়লেও বিয়ে ফিয়ের ইচ্ছে দুপক্ষের কারোর সেভাবে নেই। দরকার-ই বা কী? সেক্সলাইফ এনজয় করতে বিয়ের মতো ক্যাডাভেরাস একটা ইন্সটিটিউটে ঢোকায় প্রতিতীর তীব্র আপত্তি...
-বিয়ে ফিয়ে মানেই হেব্বি ঝামেলি! তোর বাড়ির লোক আমার বাড়ির লোক তাদের এ্যডজাস্টমেন্ট ফালতু সব সেন্টিমেন্ট দেখবি আমাদের বন্ধুত্বটাকেই মেরে ফেলবে!
-মা কিন্তু তোকে ভালোইবাসেরে !
-দূর ওসব বিয়ের আগেই ভালো শোনায় ! ছেলের বৌ আর ছেলের জি এফ মোটেই এক নয়!
নিলয়ের আজকাল বড্ড উল্টো মুখে দৌড়তে ভালো লাগে সেই যে বি-টাইপ কোয়ার্টারে এ্যসবেসটার্সের
ছাদ, চৌখুপি উঠোন, সব কোয়ার্টারেই আম কাঁঠাল বাতিলেবু পেঁপের মতো পাথুরে বোকা সার সার গাছ... নিলয়রা ইচ্ছেমতো যার তার গাছে চড়ে বসছে, ফল পড়েছে, হুটোপাটি করছে, সাইকেল চালিয়ে চলে যাচ্ছে গঙ্গার ধারে, ঝুপ্পুস চান করছে অরিত্র সোমনাথ বাদশা মলয়...
নিলয়দের কোয়ার্টারের সীমানার শেষেই ছিলো একটা বারোয়ারি জামগাছ। একবার গরমের ছুটিতে পলকা ডালে চড়ে জাম পাড়তে গিয়ে সটান নীচে পড়েছিল নিলয়। ভয়ের চোটে সোমনাথ রা কাউকে কিছু না বলেই পালিয়েছিল।শেষে সত্যেন জেঠু গাছতলায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা নিলয়কে আবিস্কার করেছিল, বাঁহাতের কনুই ভেঙে প্রায় মাস দুয়েক প্লাস্টার ঝুলিয়ে বেড়াতে হয়েছিল! সামনের কোয়ার্টারের ঘোষকাকিমা তো দেখতে এসে যা নয় তাই বলে বকেছিলেন...
-জাম খাসনি কোনদিন? শাখামৃগ কোথাকার! এখন নে পড়ালেখা বন্ধ করে প্লাস্টার ঝুলিয়ে ঘোর!
বাবাও তালে তাল দিয়েছিল,
-বৌদি আপনি কী ভাবছেন লেখাপড়ার কথা একফোঁটা ভাবে এ ছেলে? সারাদিন শুধু চড়কিবাজি! মাধ্যমিকে ঠিক গাড্ডু খাবে দেখবেন!
কবে থেকে যেন নিঃশব্দে সবকিছু পালটে যাচ্ছিল। বাবা অসীমজেঠু সমীরণকাকু সত্যেনকাকুর মতো জনা পনেরো প্রতিবেশী একসাথে একটা বিরাট প্লট কিনেছিলেন চৈতণ্যডোবার ঠিক পাশে, উদ্দেশ্য কোয়ার্টারের মতো পাশাপাশি সকলে থাকবেন। জমি রেজিস্ট্রির পর থেকে ছবিটা কিন্তু দ্রুত বদলে গেল। এক এক করে সকলেই প্রায় নানান অজুহাতে নিজের নিজের প্লট বেচে দিতে শুরু করল। বাবা বেশ ক'বছর অপেক্ষা করেছিলেন তারপর স্টেশনের কাছে ভালো একটা প্লট পেয়ে জমিটা একসময় বেচেই দিলেন। কেন যে সবাই ওভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে প্লট বেচতে গেলেন নিলয় আজও ঠিকঠাক জানে না। মনে আছে মা বাবাকে বলেছিল,
-পাড়াটা ভাঙছে, আর কেউ আগের মতো নেই। আমরা সব্বাই বদলে যাচ্ছি। ও জমিতে পাশাপাশি বাস করতে কেউই দেখো রাজি হবে না!
মা কীভাবে আগাম সবটা বুঝতে পেরেছিল কে জানে! নিজের মনে বকবক করা মাকে বাবা কোনোদিনও সেভাবে গুরুত্ব দিতো না, তবে নিলয় লক্ষ্য করেছে মা মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব কথা বলতো! দুঃখের দিনে যে তোমার সাথে পায়ে পা দিয়ে হেঁটেছে বুকে টেনে মুখে ভাত দিয়েছে সুসময় এলেই তাকে দূরে ঠেলে দেওয়াই দস্তুর! মা বলতো।
নিলয় একবার বলে ফেলেছিল, রোজ রোজ এমনটা কেন বলো বলোতো?
-তুই কান করে শুনিস নাকি? মা আশ্চর্য হয়েছিল।
-শুনবো না কেন? তোমার এই ড্রামস্টিক মনোলগ না শুনে উপায় আছে?
-তোর বাবার মতো কানে তুলো গুজলেই পারিস!
-এসব ছাড়ো তো! আগে বলো কেন বলছিলে এমন?
-আরে বাবা তুই যার থেকে শাকভাত চেয়ে খেয়েছিস এককালে তার সামনে মাংস ভাত খেলে যদি সে শাকভাতের স্মৃতি উস্কে দেয় কেমন লাগবে? আমরা কেউ নিজেকে অন্যের দাক্ষিন্যের প্রত্যাশি ভাবতে ভালোবাসি না!
এসব কথা ভাবতে ভাবতে গিজারের জলে কাকস্নান সারে নিলয়, তখনই হেল্পিং হ্যান্ড কাম ইনফর্মার মলিনামাসি ঢোকে। নিলয় টোস্টারে রুটি সেঁকছে দেখে ঘর ঝাড় দিতে দিতে মলিনামাসি বলে ওঠে,
- আজও পাউরুটি খাবা? গ্যাস হয়্যা যায় না তুমার? রোজ ঐ এক ডিম আর রুটি ভাল্লাগে?
-রোজ কই মাসি? কাল তো ওটস্ কলা খেলাম।
-ঐ একই হলো! বয়সের ছেলে কোথায় দুটো ভাতডাত ফুটায়ে খাবা তা না...
এককাপ ব্ল্যাক কফি আর টোস্ট ডিম নিয়ে খেতে খেতে নিলয় চোখ রাখে ল্যাপিতে। আজ সারাদিন ভীষন ব্যস্ততায় কাটবে... মাকে ফোন করার সময় হবে কী? এখনই একবার করবে নাকি? না থাক! মা আজকাল বড্ড বকবক করে। আর সেই তো একই কথা... বাবার সুগার রিপোর্ট ভালো না ওষুধ ইনসুলিনেও কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। নিজের আর্থারাইটিসের ব্যথা এই শীতে কেমন কষ্ট দিচ্ছে এইসব আর কী! সক্কাল সক্কাল অতো নেগেটিভিটি নেওয়া যায় না। নিলয় - ই বা কী করবে? দুজনকেই ভালো ডক্টর দেখানো হচ্ছে মেডিসিন ও চলছে নিয়মিত! আরে বাবা! বয়সটাকে তো মানতে হবে!
মাসি কাপড়জামা ধুতে ধুতে আবার গল্প শুরু করে,
-পাশের বাসার সব জিনিস আজ ওরা নিয়ে যাচ্ছে জানো?
-কারা? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে মাসি?
-আরে ঐ ফ্ল্যালাট তো দত্ত বাবুর। আমিই তো কাজ করতাম। বুড়ো আর বুড়ি দুজন ছেলো... ছেলে তো সেই আমিরিকায়!
-তারপর? শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে নিলয় জিজ্ঞেস করে।
-বুড়ি মরল আগে তারপর থেকে তো বুড়া একাই ছেল। আমারে কাজ ছাড়ায়ে দেলো। ছেলে নাকি রাতদিনের আয়া রাখব, সেই দেখা শুনা করব বুড়া রে! আয়াই রাখছিল, একখান শুটকোপানা মেয়ে লোককে রোজই দেখিচি ঢুকতি বেড়াতি... তারপর তো শুনি এক রাতে ঘুমের মধ্যি-ই বুড়া চলে গেল। তাও বছর দুয়েক হবে! ফ্লালাট তো সেই থিকা বন্ধ পড়ে আছে।
নিলয়ের হাতদুটো কী সামান্য কেঁপে গেল। টাইয়ের নটটা কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না কেন?
-এতদিনি ছেলে আইছে। মালপত্তর সব বিক্কিরি করবে। ঐ সব চটাওটা পুরান খাট পালং কী ওরা নেয়? সব নেবে ঐ ছিকিরুটি গার্ড সমিরুদ্দি আর পেলাম্বার জগন। আমিও একখান জিনিস নোবো জানো?
-তুমি? নিলয়ের গলাটা কেমন ফ্যাসফ্যেসে শোনায়,
-হ্যা একখা্য ছত্তিওলা খাট ! বড় সাধ আমার ঐরম খাটে মরনের আগে একবার শুই।
নিলয়ের কানে বাকি কথা কেন যে ঢোকে না। চোখের সামনে ঘুরতে থাকে কাঁচরাপাড়ার বাড়িটা... মায়ের পারাওঠা ড্রেসিংটেবিল... সানমাইকার চেয়ার কখানা... দাদুর আমলের চৌকিটা... পুরোনো সোফা কাম বেড... টবের ফুল গাছগুলো আর ঢাউস জাহাজ খাটখানা... আর কবছর? ঠিক কবছর লাগবে ওদের ঠাঁইনাড়া হতে?
খুব ভাল লাগল আপনার গল্প। যেন আগামী দিনগুলোর নিঃশব্দ পদচারণ। নমস্কার। ভাল থাকবেন।
উত্তরমুছুন