শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

 

প্রতিবেশী


দুপুর বেলা, খেয়ে দেয়ে নিজের ঘরে একটু বিশ্রাম নিতে যাবো, এমন সময় বাইরে থেকে কে ডাকলো, 'বিমল বাবু আছেন?'
 এই ভর দুপুরে কে আবার এলো! সপ্তাহান্তে এই একটা ছুটির দিনেও আরাম করে যে ঘুমাবো সে উপায় নেই। এখনই আসতে হয়! 
খানিকটা বিরক্তি সহকারে বেরিয়ে এসে খিড়কি দরজা খুলে যাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম সে
আমার অচেনা নয়,আবার পরিচিতও নয়। আমার বাড়ির ঠিক পাশেই গুহ বাবুদের বাড়িতে বেশ কিছুদিন ধরেই এনাকে দেখে আসছি। রবিন গুহর মুদিখানার দোকানে, যাতায়াতের পথে হামেশাই দেখতে পাই বসে থাকতে। যদিও এর বেশি বৃত্তান্ত জানার আগ্রহ বা সময় কোনোটাই আমার নেই। 
মাথায় কোঁকড়া চুল বিশিষ্ট, হালকা দাড়িওলা, বেশ ফরসা, লম্বা, পুরু লেন্সের চশমা পরিহিত, রোগাসোগা চেহারার বছর ছত্রিশেক বয়সী ছেলেটি খানিকটা লাজুক ভঙ্গিতে হেসে নমস্কার জানিয়ে আমায় বললো,' আমি বিভাস। বিভাস সেনগুপ্ত । প্রতিবেশী হলেও আলাপ নেই যদিও... আমি অবশ্য আপনার কথা শুনেছি মামার বাড়িতে।  আর শোনার পর থেকেই ভেবেছিলাম একদিন এসে পরিচয় করে যাবো। সরি হুট করে এই সময়টাতে আসাটা বোধহয় আমার উচিত হয় নি...আসলে অন্যদিন তো সময় সুযোগ বড় কম...আপনিও থাকেন না...দেখি অফিসে চলে যান...আমারো সকাল বিকেল দোকানে বসে থাকতে হয়...তাই ভাবলাম...ডিসটার্ব করলাম না তো?'
সলজ্জ চোখে তাকিয়ে থাকে ছেলেটি আমার দিকে। কথার মধ্যে একটা পোলাইটনেস। উচ্চারণে সফিসটিকেশনের ছোঁয়া। 
' ইটস ওকে। তুমি বলেই সম্বোধন করছি...এসো ভেতরে এসো।'
বেশ বুঝতে পারলাম, দুপুরের ঘুমটা আজ মাঠেই মারা গেল। পাশের বাড়ির বাসিন্দা...আগ বাড়িয়ে এসেছে পরিচয় করতে...ভেতরে আসার কথা না বলে চৌকাঠ পেরিয়ে তাকে তো আর বিদায় জানানো যায় না। পাড়াঘর বলে কথা। 
আমার ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে ঘরের এদিক ওদিক তাকিয়ে কি যেন অবলোকন করতে থাকে সে।
' অনেক দিনের পুরোনো বাড়ি তাই না? ঠিক আমাদের   বাগবাজারের বাড়িটাও এরকমই। কড়ি বরগার ছাদ, বড় বড় থাম, হুবহু এরকম লাল শান বাঁধানো মেঝে, সেকালের গরাদের জানলা,জানলার খড়খড়ি, পালিশের ওপর অবিকল একই রকম নকশা করা সেই আঁকাবাঁকা কাঠের রেলিং, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার পথে ঐ যে দেখছি দেওয়ালের গায়ে গায়ে সব চোরকুঠুরি... এত মিল হয় কি করে! মামাবাড়ির ছাদ থেকে যখন এ বাড়িটাকে দেখি, সত্যিই যেন পার্থক্য খুঁজে পাই না! বাইরের সে দেখা এক জিনিস, আর এই  যে এখন বৈঠক খানা ঘরে বসে আছি, এখান থেকে যেটুকু দেখতে পাচ্ছি বারবারই কি এক বিস্ময় যেন..! এমনকি ঢোকার ঠিক মুখে লোহার সিংহ দরজার গায়ে পাঁচিলের মাথায় যে দুটো হাঁ করা বাঘের মূর্তি বসানো রয়েছে...বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না,এ যেন অবিকল আমাদের বাগবাজারের বাড়ির সিংহ দরজার মাথায় বসানো সেই ব্যাঘ্র মূর্তি...লোহার দরজার গায়ে গায়ে সেই অবিকল এক ছাঁচে গড়া দাদামশাইয়ের আমলের তৈরি কল্কা,হাতির শুঁড়,গোলাপ আর পদ্মফুলের কারুকার্যময় নকশা....সবচেয়ে আশ্চর্যের কি জানেন...এ বাড়িতে পা না দিলে কোনোদিন জানতেই পারতাম না বোধহয়, আমার বাড়ির বৈঠক খানা ঘরের সিলিং এ সত্তর বছর আগেকার পিতলের তৈরি ঝালর শোভিত, ময়ূরের মূর্তি আঁকা,স্ফটিকের মতো কাঁচ বসানো ঝাড় লন্ঠন পৃথিবীতে আরো একটা কখনো দেখতে পাবো! সবটাই যেন কিরকম অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে জানেন...কোথায় বাগবাজার আর কোথায় এই কাঁচরাপাড়া...দুই প্রান্তের দুটো বনেদি বাড়ি...স্ট্রাকচার, গঠন প্রনালী, প্ল্যানিং, নকশা...যত কাছে আসছি এ বাড়ির...আই অ্যাম জাস্ট স্পেল বাউন্ড! শুধু মানুষ গুলোই আলাদা...এছাড়া কোথাও কোনো...!'
বাইরের জানলাটা খোলা ছিল। চৈত্রের হাওয়ায় ঝাড়লন্ঠনটা হালকা দুলে উঠছিল বারবার। একটা রিনরিনে শব্দ বেজে উঠছিল ঝালরগুলোর দুলে ওঠা ছন্দে। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে অন্যমনস্কভাবে ছেলেটি বললো,' বিশ্বাস করুন, একটা কথাও আমি বাড়িয়ে বলছি না! রবিন মামাও বলতেন," তোদের বাড়ির মতো আরো একটা বাড়ি আমাদের কাঁচরাপাড়ায় রয়েছে।"
যদিও এর বেশি কিছু মামা আমাকে বলেন নি। কেন বলেন নি তা আমি জানি না। দেখার চোখ, ভাবনার চোখ সকলের তো সমান হয় না...মামার কাছে মুদির দোকানের মালপত্রের হিসেব, কত মোট চাল নামলো, ডাল এলো,তেল এলো...গদি আঁটা সিন্দুকটাতে বসে খরিদ্দারের সঙ্গে দরকষাকষির খেলা...আর তেলকাষ্ঠা চুলে আরো বেশি করে তেল মাখানো...এর বাইরে জীবন বোধহয় আর বিশেষ কিছু দেখে না...। বিশ্বাস করুন, আজ শুধু আপনার সঙ্গে আলাপ করবো বলেই নয়...ছাদ থেকে দেখা, আসা যাওয়ার পথে দেখা, খিড়কি দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দেখা এই বাড়িটাকে একটু কাছ থেকে দেখবো বলেই ছুটে চলে এলাম...সময় বড় কম...আবার গিয়ে বসতে হবে ঐ ভ্যানভেনে মাছি, খোল,রেড়ির তেল, ভেলি গুড় আর হিঙের গন্ধের মধ্যে...কেজো লোক, অসার কিছু কথা, কত এলো,কত গেলো, দিনশেষে মামার সামনে পাই পয়সা হিসেবের খেড়ো খাতা নিয়ে বসা...জমা আর হাসিলের মাঝে গরমিল হয়েছে কি ভাগ্যে...! সবই কপাল! আজ যদি বাবা আমার বেঁচে থাকতেন, এই বন্দী জীবনে ঢুকতে দিতেন কখনো আমায়..! দুপুরে খেয়ে দেয়ে শুতে যাবো, এমন সময় হঠাৎই ঢংঢং করে দুটো বাজার আওয়াজে আমার চোখ দুটো চলে যায় ঘরের জানলা দিয়ে আপনার এই বৈঠক খানার দেওয়ালে টাঙানো বড় ঘড়িটার দিকে! রীতিমতো হতবাক হয়ে যাই! এ যেন আমাদের বাড়ির দেওয়াল ঘড়িটাকেই কেউ ওখানে এনে বসিয়ে দিয়েছে! অবিকল সেই একই ছাঁচে গড়া! মনের টানেই বলতে পারেন, কে যেন আমায় ছুটে নিয়ে চলে এলো...এসে বুঝতে পারছি আমার অনুভূতি ঠিক কতখানি মিলে যেতে পারে! সেই হুবহু একই রকম কালো কাঠের বার্ণিশ করা ফ্রেম, ডায়ালের গায়ে ইটালিক্স হরফে লেখা সেই একই কোম্পানির নাম, রূপোলি পেন্ডুলাম, এমনকি সোনালী কাঁটাদুটো পর্যন্ত...কোথাও এতটুকু অমিল নেই! যতক্ষন এখানে রয়েছি,বললে বিশ্বাস করবেন না...এই বাড়ি, এইসব পুরোনো আসবাবপত্রগুলো যেন ফিসফিস করে কথা বলে চলেছে আমার সঙ্গে... খালি বলছে, আরো অনেক কিছু বিস্ময়ের জিনিস দেখতে পাবি, একটু অপেক্ষা কর! জানি, এই বারবেলায় এসে ব্যাস্ততার মধ্যে ফেলে দিলাম আপনাকে...পরিচয় নেই, আলাপ নেই...তবু কি এক আপনত্ত্বের টানে কিছু না ভেবে ছুটে চলে এলাম...এ ঘড়িটা আগে অবশ্য চোখে পড়েনি, মানে মামার বাড়ির ঐ জানলাটা দিয়ে আপনার এ ঘরের ভেতরটা মোটামুটি পরিষ্কার দেখা যায়...যদি দেখতে না পেতাম, তাহলে হয়তো দুটো বাজার শব্দটা এমন করে কানে এসে বাজতো না...আর আমার এখানে আসাও হত না।'

কথাগুলো শুনছিলাম চুপ করে। ঘড়ির পেন্ডুলামের টিক টিক শব্দ টুকু বারবেলার নিস্তব্ধতাকে যেন আরো বাড়িয়ে তুলেছে এই মূহুর্তে। নিরবতা ভেঙে বললাম,' ঠিকই ধরেছ, ঘড়িটাকে কালই এ ঘরে শিফ্ট করা হয়েছে। ওয়েস্ট অ্যান্ড ওয়াচ কোম্পানির ব্রিটিশ  ক্লক। বহু পুরোনো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার জিনিস। কলকাতার এক ব্রিটিশ এম্ব্যাসি থেকে পাওয়া গিয়েছিল। সেখান থেকে অকশন মার্কেট হয়ে আমার দাদামশাইয়ের হাতে আসে; মাই গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার। এটুকুই শুনেছি। আর শুনেছি তিনি ছিলেন তখনকার দিনের এক সফল ব্যাবসায়ী। দু দুটো টমটম গাড়ি ছিল ওনার। তাতে চড়ে যাতায়াত করতেন। ভারি শৌখিন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। ব্যাস এটুকুই। বাবার মুখে শুনেছিলাম, এ ঘড়িটার বয়স আশি বছরেরও বেশি। এখনো সমান ভাবে সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সমসাময়িক কালের এই ঝাড় লন্ঠন...যা আজও সচল। এ বাড়ির গঠনশৈলী থেকে শুরু করে পুরোনো আসবাব যা যেটুকু রয়ে গেছে সবই ঐ দাদামশাইয়ের আমলের কিংবা হয়তো তারও আগের। আমরা শুধু ছোটোবেলা থেকে দেখেই আসছি...চেনা পরিচিত অনেকেই যারা এসেছেন এ বাড়িতে...তারিফ করেছেন জিনিস গুলো দেখে...কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি,তোমার মতো এমন আপনত্ত্বের দরজায় সচরাচর বোধহয় সবাই পৌঁছাতে পারে না...। '' বলছেন?' 
ছেলেটির চোখে মুখে একরাশ হাসি খেলে যায়। 
' অবশ্যই। '
' তাহলে তো আরো একটা মিল বেরিয়ে গেল! দাদামশাই। গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার। একই পথের দুজন শরিক...অথচ দুই প্রান্তসীমার দুজন মানুষ...একজন ডাক্তার, একজন ব্যাবসায়ী...কেউ কাউকে চেনে না...কোনোকালে দেখাও হয় নি...কিন্তু কি আশ্চর্য মানসিক মিল! আমার না সবটাই কিরকম যেন সিনেমার মতো মনে হচ্ছে...এমনও হয় জীবনে...! '
ড্রয়িং রুম, সিঁড়ি, সেকেলে রেলিং, চোর কুঠুরী, জানলার পাথরের জাফরি,খড়খড়ি...চার দেওয়ালের আনাচে কানাচে জুড়ে ঘুরে বেড়ায় ছেলেটির বিস্ময় ভরা দু চোখ।  
কেন জানি না, আমারো মনে হচ্ছিল, এও কি সম্ভব? দুটো একই রকমের দেখতে বাড়ি পৃথিবীতে কি থাকতে পারে না? হয়তো পারে। কিন্তু ছেলেটির কথা অনুসারে যদি এই সূক্ষ্ম মিলগুলো সত্যি প্রমানিত হয়, এমন ঘটনাকে সেক্ষেত্রে কী ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়? আদৌ কি ব্যাখ্যা করা যায়! আগে কথা প্রসঙ্গে রবিন দা আমায় বলেওছিলেন,' আপনার বাড়িটা ঠিক যেন আমার দিদির শ্বশুর বাড়ির মতো...মানে ঐ একই ঘরানা, একই ডিজাইনে তৈরি...।'
' তাই নাকি?'
'হ্যাঁ মশাই। একেবারে তাই।'
' অনেক পুরোনো তাহলে!'
'পুরোনো বলতে! বহুকালের! আপনাদের বাড়িও তো নিশ্চই অনেক কালের? মানে আমি তো জন্ম থেকেই দেখে আসছি...।'
'আমার প্রপিতামহের হাতে গড়া...শুধু বাড়িই নয়...বাড়ির অনেক আসবাবপত্রই ওঁর আমলের। '
' ভারি অদ্ভুত! '
' একদিন আসবেন।'
আসবো বলেও ভদ্রলোক আর আসেন নি। 
আমি আমার বাড়ি আসার ব্যাপারে আর কখনো আগ্রহ দেখাই নি তাঁর কাছে। অবশ্য প্রতিবেশী হয়ে আমি নিজেও বা কোনকালে কতবার গেছি ওঁর বাড়িতে...এটাও ঠিক। এক পাড়া, পাশের বাড়ি,আসাযাওয়া...এই ধারণা গুলো এভাবেই হয়তো বদলে যাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে। 
সেই জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে বিভাস সেনগুপ্তের মনের এই অন্তরঙ্গ অনুভূতিটুকু আমার ভেতরকার কৌতুহলী মানুষটাকে যেন এক ধাক্কায় আপনা থেকেই অনেকখানি কাছে এনে দিল ছেলেটির। 
জিজ্ঞেস করলাম, ' তোমার গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার ডাক্তার ছিলেন বুঝি?'
' হ্যাঁ। তখনকার সময়ের এল এম এফ ডাক্তার। লোকে বলতো ধন্বন্তরি। আমিও বাবার মুখেই যেটুকু শুনেছি। বাবাকে আমি বেশিদিন পাই নি। একদমই কম।'
যেরকম উৎসাহের সুরে ছেলেটি তার ঠাকুর্দার কথা বলতে শুরু করেছিল,আস্তে আস্তে মুখটা কিরকম ম্লান হয়ে যায় তার।
তার নিজের জীবনের আরো অনেক কথা সে আমাকে শোনায়। বারো বছর বয়সে বাবাকে হারানো, ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে মায়ের উৎকন্ঠা, অবশেষে মাস কয়েক আগে রবিন মামার সঙ্গে বাধ্য হয়ে এখানে এসে মামার দোকানে কাজ নেওয়া...এই বন্দী জীবনের বাইরে একটা জীবন আজও তাকে থেকে থেকে টানে...সে হলো আমাদের এই বাড়িটা...যে বাড়ি দেখে ছোটোবেলায় মামাবাড়ি এলেই তার মনে হতো বুঝি তাদের বাগবাজারের বাড়িটাকেই কেউ এখানে এনে বসিয়ে দিয়েছে..সেই অনুভূতি আজও যে..! চলে যাবার প্রাকমুহূর্তে সে তার মোবাইল ক্যামেরায় সযত্নে সঞ্চিত খানকয়েক ছবি আমার সামনে মেলে ধরে। একটা ফ্যাকাশে হয়ে আসা অ্যালামাটি রঙের বাড়ি...সামনেকার সিংহদরজা...নেমপ্লেটে লেখা ' প্রতীক্ষা' নাম...আর একটা তার প্রপিতামহের সময়কার আবলুস কাঠের আরামকেদারা...ছেলেটির কথায়, " এ জিনিস অকশন মার্কেটেও মিলবে কিনা সন্দেহ..."
আমি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম শুধু! এ যেন আমাদেরই বাড়ির প্রতিরূপ...যা এতক্ষণ কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখায় নি..এবার দেখাল! 

বেশ কিছুক্ষণ হলো ছেলেটি চলে গেছে। কাল তাকে একটা বিশেষ কারণে এ বাড়িতে আসতে বলেছি। কথা প্রসঙ্গে সেই আরামকেদারাটা দেখাবো বলেছি, যেটা আজ আর দেখানোর সুযোগ পাই নি। 
ছেলেটি নাছোড়বান্দা। সে একদিন তার বাড়িতে আমায় নিয়ে যাবেই। যাবো বলেছি। যেতে যে একবার সেখানে আমাকে হবেই। দুই বাড়ির মাঝে এ যেন কি এক অদ্ভুত প্রতীক্ষা!

বিকেল পড়তে এখনো অনেকটা দেরী।  কি মনে করে মান্ধাতা আমলের খাড়াই পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে এগিয়ে চললাম। মেহগনি কাঠের কারুকার্যময় রেলিঙের একপাশে দেওয়ালের গায়ে গায়ে অন্ধকার গুহার মতো চোরকুঠুরী...খুব ছেলেবেলায় ওর ভেতরে ঢুকে কতই না খেলাবাটি খেলেছি, লুকোচুরি খেলেছি, রঙ পেন্সিলের কত কাটাকুটির দাগ বহুবছর ধরে রয়ে গিয়েছিল দেওয়ালের গা জুড়ে....! 
সময় এগোয়। নতুন রঙ আর হোয়াইট ওয়াশের আস্তরণে মুছে যায় সেসব দাগ। বয়স বাড়ে নীরব চোরকুঠুরীর। বাড়ে না সে শৈশবের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত বয়সগুলো। যে গহ্বর শুধু খেলার স্বাদ টুকুকেই বয়ে আনে নি...এনে দিয়েছে এরকম কত নিস্তব্ধ দুপুরে কত দিনের কত রোমাঞ্চকর মুহূর্তের অনাস্বাদিত স্পর্শ। 
লোহার দরজাটা খুলে আস্তে আস্তে ছাদে গিয়ে উঠলাম প্রতিদিনের অভ্যস্ত চোখের বাইরে অন্য এক গন্তব্যের স্বাদ পেতে। প্লাস্টার বিহীন ছাদের রেলিঙ। পলাশির যুদ্ধের সময়কার ছোট ছোট চারকোনা শ্যাওলা ধরা লাল ইঁটগুলো যেন একদৃষ্টে তাকিয়ে লক্ষ্য করে চলেছে আমার গতিবিধি। রেলিঙের ফাঁকে ফাঁকে লাল পাথরে খোদাই করা কলকা যুক্ত ফুলদানির নকশার স্তরে স্তরে ফাটলের সুস্পষ্ট চিহ্ন... বাবা বলতেন, ' এ বাড়ি নবাবী আমলে তৈরি। ঐ ইঁট...যার ওপরে বাড়ির তিনশো বছর আগেকার ভিত গাঁথা... বড় দুষ্প্রাপ্য এসব ইঁট! বাবার মুখে শুনেছি, ছাদের রেলিঙের ঐ পাথরের জালি দেওয়া নকশা করা দেওয়ালগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বেলজিয়াম থেকে আনানো সব রঙিন কাঁচ বসানো ছিল...খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন কিনা তোর প্রপিতামহ ...তখনকার দিনের বড় বড় নামডাকওয়ালা গুজরাটি, মারওয়ারি, কোম্পানির অধীনে কর্মরত ফিরিঙ্গি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দাদুর  ছিল দিন রাতের ওঠাবসা। ওদের ওসব বাড়ির আসবাবপত্র, নকশাগুলো দেখে এসে নিজের মনের মতো করে সাজিয়েছিলেন এ বাড়ি...আজ আর কি আছে...কিছুই নেই... হাড় কঙ্কাল মাত্র...আমিও কি আর দেখেছি সেসব...শুধু শুনেছি...'
দিনে দিনে ফাটল হয়তো আর বিস্তৃত হবে...আগাছা, লতানো গাছের শিকড়ে ভরে যাবে ছাদের আনাচে-কানাচে চত্বর...আমি লোক, মিস্ত্রি দিয়েও হয়তো বিশেষ কিছু করতে পারবো না...যে ফাটল বাড়ির অন্দরমহলকে একবার চেপে ধরে তাকে রোধ করার ক্ষমতা কার? রবিন দার ভাগনে কি এই অন্দরমহলের ছবির সঙ্গে আদৌ পরিচিত? বহির্মহলকে ধরা গেলেও অন্দরমহলকে ধরা... সত্যিই কি এতটাই সহজ? সেই সন্দেহের নিরসন করতেই যেন আজ এই মূহুর্তে  ছাদের চিলেকোঠার  গুদাম ঘরের দিকে আমার এগিয়ে চলা। কতকালের না দেখা আরাম কেদারাটা একবার যে অন্তত মিলিয়ে দেখতেই হবে আমায়! সে যেভাবেই হোক। 
 দ্বিপ্রাহরিক নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে পুরোনো বাড়ির কোথায় কোন ঘুলঘুলির ফাঁকে একটা ঘুঘু ডেকে যাচ্ছিল একটানা। 
দরজার মরচে ভরা তালাটা একটা চাবি দিয়ে খুলতে যাবো...অবাক হয়ে গেলাম! তালাটা ভেঙে খুলে পড়লো কবে? জানি না তো! আর কিছু না ভেবে পঞ্চাশ বছর আগেকার রঙ চটা হতশ্রী হয়ে পড়া দরজাটা খুলতে যেতেই ছোটবেলায় রেডিওতে শোনা শনিবারের বারবেলার মতো যেভাবে ক্যাচ ক্যাঁচ শব্দ করে পাল্লা দুটো হাট হয়ে গেল... সেই শব্দ ময় স্মৃতি যেন চৈত্রের এই পাতা ঝরা নিঃসঙ্গ হাওয়ায় আর একবার শুনিয়ে  দিয়ে চলে গেল দুপুরমাখা রোমাঞ্চের সুরটুকু...!
দরজার পাল্লাটা সরানো মাত্র একটা ভিজে শ্যাওলা ধরা সোঁদা গন্ধ অকস্মাৎ নাকে এসে লাগলো আমার।
বহুদিনের বদ্ধ ঘরে এ গন্ধ স্তরে স্তরে বিন্যস্ত হয়েছে, যা বুঝলাম। দরজা পেরিয়ে একটু ঝুঁকে ভেতরে ঢুকলাম। দেওয়ালের কোথাও কোনো জানলা নেই। শুধু খোলা দরজা দিয়ে সূর্য রশ্মি যতটুকু যেতে পারে ততটুকুই যেন আলো ফেলেছে। সেই আলো ছায়াময় পরিবেশে ঘরের ভেতরকার জিনিস পত্র গুলো যেন দেখা না দেখা ছবির মতো ভেসে ভেসে উঠছিল আমার চোখের সামনে। কবেকার কোন খাটের ভাঙা ব্যাটম, ভাঙা কাঠের চেয়ার, সোফাকাম বেডের তুলো বেরিয়ে আসা ছেঁড়া অংশ, একটা ভাঙা সাইকেল... যেটা বাবাকে আমি খুব ছোটোবেলায় চালাতে দেখেছি, একটা কাঠের নকশা করা সেন্টার টেবিল, যার ওপরকার কাঁচটা ভাঙা, একটা বেলজিয়াম গ্লাসের বড় আয়না... এখনো সে আয়না এতটাই স্বচ্ছ যে কাঁচের গায়ে আচমকা ভেসে ওঠা আমার মুখখানা 
আমাকেই যেন হতচকিত করে দিল, ঐ ওধারে প্রপিতামহের সেই শখের এসরাজখানা... ধূলিধূসরিত, ঝুল পরা বড় নিঃসঙ্গ অবস্থায় পড়ে রয়েছে, বাবার মুখে শুনেছিলাম এক বিখ্যাত মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ী বন্ধুর কাছে এসরাজ বাজানো রপ্ত করেছিলেন প্রপিতামহ...অনেক ছোটোবেলায় ঠাকুর্দাকেও এই এসরাজটা নিয়ে বাজাতে দেখেছি...বংশ পরম্পরায় সে বাদ্যযন্ত্র একসময় বাবাও বাজাতেন... খোলা ছাদে রাতের অন্ধকারে একমনে এসরাজে সুর তুলতেন বাবা, এসরাজের ঠিক গা ঘেঁষেই যেন মধ্যমণি হয়ে বিরাজ করছে সেই আবলুস কাঠের বিখ্যাত আরাম কেদারাখানা...ধূলো ছাড়া পালিসের গায়ে এখনো একটা দাগ পর্যন্ত পড়েনি, মুঘল গালিচার মতো বারিফ কায়দায় নকশা করা  সুন্দর আর আভিজাত্যপূর্ণ বসার কাপড়টাও যেন মনে হচ্ছে এই সেদিনকার...এতটাই সে চেয়ারের জাজ্বল্যমানতা! প্রপিতামহ থেকে শুরু করে ঠাকুর্দা..সেখান থেকে পিতা শরৎ কান্ত... তিন প্রজন্মের ব্যবহার করা, কত আরামের, কত আয়েশি জিনিসটা আজ শুধুই একা। পড়ে আছে বিরাট এক অমলিন স্মৃতি আঁকড়ে... যে অমলিনতা হয়তো একমাত্র আরাম কেদারার নিজস্ব সৌন্দর্যের অমলিতার সাথেই তুলনীয়....যার পাশে অন্য আসবাবপত্র তা সে যত দুষ্প্রাপ্যই হোক, ঠিক যেন ততটাই মৃয়মান, বিবর্ণ...!
 জিনিসটা ভালো করে দেখবো বলে আমি আরো কাছে এগিয়ে গেলাম... আর ঠিক তখুনি.... কে? কে ওটা কোণের দিকে দাঁড়িয়ে? ঝলকে বুকের ভেতরটা নিমেষেই যেন ছ্যাঁৎ করে উঠলো! 
আদ্যন্ত ধবধবে সাদা কাপড় জড়িয়ে কাউকে অথবা কোনো কিছুকে যেন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে একেবারে দেওয়ালের এমন একটা কোণ ঘেঁষে যেখানে হট করে চোখ চলে গেলে যেন মনে হবে কেউ বুঝি আড়াল থেকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে শুধু আমাকেই লক্ষ্য করছে...আর কাউকে নয়....! আবছায়া দৃষ্টিপথে ভেসে ওঠা সেই রহস্যময়তা যে অন্য কেউ নয় সেটা বুঝলাম এগিয়ে এসে নিজের হাতে কাপড়খানা সরাতেই....আচ্ছাদনের আড়াল থেকে যেটা বেরিয়ে এলো সেটা একটা সুবিশাল রামদা! প্রপিতামহের আমল থেকে আমাদের  এ বাড়িতে কালি পুজোর চল৷ আড়াই শো তিনশো বছর আগে শুনেছি  এই রামদাটাই নাকি ব্যবহার হতো যজ্ঞে উৎসর্গীকৃত পশু বলির কাজে....চকচকে ধারালো অস্ত্রটার দিকে তাকিয়ে কেন জানি না মনে হলো কতদিন যে রক্তের স্বাদ পায়নি ও....সে স্বাদ পাবার জন্য জিভ দুটো যেন লকলক করছে ওর....যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবে জিনিসটাকে সাদা কাপড়টা দিয়ে 
 ঢেকে আস্তে আস্তে এসে বসলাম আরাম কেদারাটায়।  যেই না বসেছি, টুং করে পায়ের কাছে কি যেন একটা লাগলো... তাকিয়ে দেখি একটা ছোটো শিশিতে আঠার মতো চটচটে কালচে কালচে  কি যেন লেগে রয়েছে...নাকের কাছে আনতে যে গন্ধটা অনুভব করলাম, তাতে বেশ স্পষ্ট বুঝলাম এ হলো বহুকালের পুরোনো ঘি...এতটাই পুরোনো যে আসল রঙটা উঠে কালচে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে....শিশির ঠিক পাশেই একটা রূপোর পান রাখার রেকাবি আর তার পাশে  পানের পিক ফেলার পিতলের গায়ে লতাপাতা আঁকা একটা বড়সড় মাপের ডাবর...একটা পিতলের লম্বা সরু পাইপ.... যেটাতে তামাক ভরে এখনো দিব্যি নেশার কাজ চালানো যায়....সাজানো জিনিস গুলোর মধ্যে কোনোটা প্রপিতামহের, কোনোটা আবার ঠাকুর্দার খুব প্রিয়, শুধুমাত্র ঘিয়ের শিশিটা বাবাকে উৎসর্গ করে রাখা হয়েছে এখানে....এই গুদামঘরে যা কিছু জিনিস চোখে ভাসছে তার সবই প্রপিতামহ, বাপ,ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর দোষ কাটাতে তাঁদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। 
চেয়ারে আরাম করে বসে প্রপিতামহ হেমচন্দ্রের ব্যবহার করা পাইপটা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, ঠিক ক বছর পর এলাম এ ঘরে? বাবা মারা যাবার পর দীর্ঘকাল এ দরজার তালা খোলা হয় নি। আমিই সাহস করে এই প্রথম....
"সাহস করে'... কথাটা কানে এসে যেন প্রতিধ্বনিত হলো সেই আধোছায়া ঘেরা নিস্তব্ধ ঘরে...!
বছর পঞ্চাশেক আগে এই চিলেকোঠার ঘরটা তৈরি করেছিলেন বাবা শরৎ কান্ত।  তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিনের মাথায় এ ঘর পরিণত হলো স্যান্নাল বাড়ির গুদামঘরে...যেখানে মৃত মানুষ কথা বলে তার মতো করে....কোনো জীবিত মানুষ নয়..! আমার দুচোখ ঘুরে বেড়ায় চার দেওয়ালের আনাচকানাচে জুড়ে... বছর কে বছর ধূলো ময়লার আস্তরন জমে ওঠা  দশ বাই দশ ফুটের ছোট্ট পৃথিবীটা  মৃত মানুষের মতোই যে স্মৃতি ভারে আঁচড়াতে শুরু করেছে এই মুহূর্তে বড়...! 
সে বহু বছর আগের কথা। বাবা তখন সদ্য মারা গেছেন। রাত-বিরেতে ছাদে উঠলে বন্ধ গুদামঘরের ভেতর থেকে এসরাজের মৃদু সুরেলা সেই আওয়াজ বাড়ির সকলেই প্রায় শুনেছিল। ঠিক যেন চাপা কান্নার মতো একটা আওয়াজ.... পৌঁছোয় নি শুধু আমারই কানে। দাদা বৌদিদের আদেশ নির্দেশ মতো অপদেবতা আর অমঙ্গলের দোষ কাটাতে শান্তি,সস্তয়ন করা হলো এ বাড়ির। পুরোহিত মশাইয়ের বিধান অক্ষরে অক্ষরে মেনে মৃত মানুষদের ব্যবহার্য জিনিস, তাদের প্রিয় খাবার দাবার সবই সাথে করে উৎসর্গ করে সাজিয়ে রেখে দেওয়া হলো এ ঘরে... বলা হলো আজ থেকে এ গুদামঘর এমনি পড়ে থাকবে.... আর যেন কখনো এ ঘর না খোলা হয়....'
পুরোহিত মশাইয়ের বিধি মেনেই কাজটা করা হয়েছিল। আর কখনো খোলা হয় নি। কয়েকদিন পর দাদা বললেন,' আত্মার সত্যি সত্যিই মুক্তি হলো মনে হয়... দ্বিপ্রাহরিক রাতে আর তো শোনা যায় না এসরাজের কান্নার শব্দ....'
সে কান্নার শব্দ আদৌ কখনো কোনোদিন শোনা গিয়েছিল কিনা তা আমি জানি না, দীর্ঘ বারো তেরো বছর ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা আলো বাতাসহীন স্যাঁতসেঁতে সোঁদা গন্ধ নিঃশ্বাসের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক, এই মূহুর্তে সেসব নিয়ে তলিয়ে ভাবার মতো পরিস্থিতিও আমার নেই...কিন্তু  এই প্রায়ান্ধকার পরিবেশে আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা যেন আঁচড়াচ্ছে আমায়....এতকাল পর কেন হঠাৎ মনে হলো ঘরটা খোলার কথা? আগামী কাল রবিন গুহর ভাগনে এলে তাকে এই আরাম কেদারাটা দেখাবো বলে কথা দিয়েছি সেই কারণে নাকি অন্য  কিছুর হদিস পাবার আকাঙ্খায়... যা এর আগে সত্যিই কখনো মনে হয়নি?
 আনমনে ভাবতে ভাবতে আরাম কেদারায় হেলান দেওয়া আমার হাতখানা যেন আপনা থেকে পাশের এসরাজটার দিকে চলে গেল। বাবা অনেকবার বলেছিলেন আমায়, নিজে বাজানো শিখিয়ে দেবেন। হয়তো আমারই গাফিলতি। সবার কি আর সব জিনিসে মন বসে। 
শেখা না হয় জীবনে না ই হলো... খোলা ছাদে এই আরামকেদারায় বসে বাবাকে যেভাবে সুর তুলতে দেখতাম ঠিক সেভাবে বাদ্যযন্ত্রটা ধীরে ধীরে কোলের ওপর রেখে কি মনে করে আন্দাজে একটা একটা করে তার বাজাতে লাগলাম। এলোমেলো হাতের আলতো আঙুলে যতবারই তারে টোকা দিচ্ছি, ততবারই  আমার মনে হতে লাগলো অতীত দিনের কোন এক বিস্মৃতপ্রায় সুর যেন বহুকালের চাপা কান্নার মতো সেই নিস্তব্ধ ঘরের আনাচে-কানাচে জুড়ে বেজে বেজে উঠছে বারবার....এই বদ্ধ চারিধারে যেন হাঁপিয়ে উঠছে তার প্রাণ...সে চায় মুক্তি....আকাশ বাতাস অন্তরীক্ষের মাঝে  মিলিয়ে দিতে চায় তার অস্তিত্ব...আমার অপটু হাতটুকুই যেন তার কাছে বহু আকাঙ্খিত সেই বদ্ধ দরজায় কড়া নাড়া! সুর উঠছে এলোমেলো.... মিলিয়ে যাচ্ছে ঢেউয়ের মতো... শুধু রেশটুকু রেখে যাচ্ছে ঘরময়.... বিনিয়ে বিনিয়ে চাপা কান্নার রেশ....
বাদ্যযন্ত্র থেকে হাতটা কে যেন থামিয়ে দিল আমার সহসা! বাবার মৃত্যুর পর এই চাপা কান্নার সুরটুকুই কি বন্ধ দরজার আড়ালে বেজে বেজে উঠতো রাতের অন্ধকারে? আমি শুনিনি। কিন্তু অনেকেই তো শুনেছে। সত্যিই কি  তাদের অস্বীকার করা যায়? যে প্রশ্নটা কোনোকালে আমার মনে স্থান পায় নি, আজ এই মূহুর্তে  সেই জিজ্ঞাসা টুকুই যেন একাকি নিরালা এই বদ্ধ চিলেকোঠার ঘরে ঢেউয়ের মতো অকস্মাৎ আমার মনে উদয় হল!  ভাবতে গিয়ে একই সাথে এক ভিন্ন অনুভূতিও যেন গ্রাস করলো আমার অন্তরাত্মাকে...
এসরাজটা হাতে নিয়ে আরাম কেদারায় বসে কেন জানি না হঠাৎই আমার মনে হলো কেউ যেন একটা পেছনে দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ চোখে একদৃষ্টে আমায় দেখছে। আমি বেশ অনুভব করছি যতবার আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি ততবারই একটা ছায়ার মতো কি যেন  আমার থেকে সরে আরো খানিকটা পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কোনো এক অশরীরী যেন লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছে ঘরময়... আমার সঙ্গে... আমি নিশ্চিত একটু আগে আমার বাজানো এসরাজ থেকে নির্গত ঐ চাপা কান্নার সুর আসলে তারই! আমার না জানা হাত সেই কথাই যেন বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমায়! আমি এও নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, সেই ছায়ামূর্তি নিথর হয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমার অন্তঃকরণকে যেন পড়ে নিচ্ছে ছবির মতো! তার প্রতিটি নিঃশ্বাস আমার গায়ে এসে তীরের মতো বিঁধছে! ঐ তো... ঐ তো... সত্যি সত্যি কে যেন দাঁড়িয়ে...! 
একটা চাদর জড়ানো কার হাত আলতো হাওয়ার মতো পিঠে এসে লাগলো মনে হলো!  ত্রস্ত পায়ে  উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পেতলের ডাবরটা পায়ে লেগে ঠং করে ছিটকে পড়লো এক পাশে। মন বলছে, 'আর এক মুহূর্তও এখানে নয়! দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে... চলে যা, তাড়াতাড়ি চলে যা... কেন এসেছিস এখানে... দ্যাখ ঠিক মতো বেরোতে পারিস কিনা...!'
এগোতে যাবো... এমন সময় আবার সেই চাপা কান্না! এবার আর এসরাজের সুরে নয়... একেবারে অন্তঃকরণ থেকে উঠে আসা কান্না...আওয়াজটা আসছে ঠিক যেদিকে সাদা কাপড়ে মোড়া রামদাটা ঝোলানো রয়েছে,তারই আড়াল থেকে... 
আমার সর্বশরীর ময় যেন বিদ্যুতের স্রোত বয়ে যেতে শুরু করেছে...একি প্রকৃতই মনের ভুল? নাকি শোনার ভুল? হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে নিজের কানকে এতটা অবিশ্বাস করবোই বা কি করে! 
আর কয়েক মুহূর্ত এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে কি ঘটতে পারে আমি কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না,শুধু মনে হলো একটা অশরীরী ছায়ামূর্তি যেন একটু একটু করে আমার সমস্ত অনুভব শক্তিকে গ্রাস করে ফেলতে শুরু করেছে....সে যে এখনো আমার অজানা....তাকে ধরা বা বোঝার মতো শক্তি আর আমার নেই....আছে শুধু হিসহিস করতে থাকা একটা নিঃশ্বাসের চোরা স্রোত আর ঐ চাপা কান্না....ফোঁপাতে ফোঁপাতে ক্রমশ যেন এগিয়ে আসছে কেউ...সাদা কাপড়ের আড়াল সরিয়ে... কাছে...একেবারে আমারই কাছে...ধোঁয়ার মতো একটা ঝাপসা ছায়ামূর্তি....কি যেন বলতে চাইছে হাত নেড়ে...ডাকছে আমায়..আর মোটে এক হাত.... আমি আর ভাবতে পারলাম না... দিগবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে এক দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে দরজাটা সপাটে টেনে মরচে পড়া লোহার ছিটকানিটা ত্রস্ত হাতে সজোরে বন্ধ করে দিলাম। দড়াম করে দরজা বন্ধের আওয়াজে রেলিঙে বসা কয়েকটা শালিখ নিমেষে কোথায় যে উড়ে গেল...!  আজকের পর থেকে হয়তো স্থায়ী ভাবেই বন্ধ হয়ে গেল এ দরজা।
হাঁপাতে হাঁপাতে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকি। নিজের ভেতর আছি কি আদৌ? জানি না। গুদামঘরের সে বহুকালের ঝোলানো তালা কবে, কি করে ভেঙে গেল তাও জানি না। শুধু এটুকু জানি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা তালা এনে ও ঘরে লাগানো দরকার, পারলে আজই...ওটাই আশু প্রয়োজন!
নামতে নামতে প্রায় শেষ সিঁড়ির কাছে পৌঁছে গেছি, হঠাৎই অনেক দূর থেকে বাতাসের মতো ভেসে আসা একটা এসরাজের করুন সুর আমার ভেতরকার মানুষটাকে যেন এক লহমায় স্তব্ধ করে দিল! ক্রমশই  এগিয়ে আসে সে শব্দ... দূর থেকে কাছে... প্রথমে ছাদ... সেখান থেকে ছাদের ওপরকার সিঁড়ির বন্ধ লোহার দরজার সামনে এক পা এক পা করে এগোতে থাকে... সুর নয়, সুরের হাত ধরে আসা কতদিনের একটা চাপা কান্না যেন...যেন গুদামঘরের বদ্ধতার ভেতর থেকে হঠাৎই খোলা আকাশের নীচে মুক্তির স্বাদ খুঁজে পেয়েছে কেউ... এ তারই আনন্দাশ্রু....! 
' কে?  কে ওখানে? '
তীরের শানিত ফলার মতো কথাগুলো আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে  দুপুরের ঘুমটাকে ঠিক সেই মুহূর্তে অকস্মাৎ ভাঙিয়ে দিয়ে চলে গেল...!
চারিপাশে কেমন একটা ঘোর লাগা ভাব... জড়ানো চোখের পাতা মেলে আস্তে আস্তে ফিরে তাকাই পাশের  প্রতিবেশী রবিন গুহর বাড়ির দোতলার খোলা ছাদে  তখনো একা একা এক মনে বসে এসরাজ বাজিয়ে চলা ছেলেটির দিকে। 
শুনেছি রবিন গুহর সম্পর্কিত ভাগ্নে। দিন কয়েক হলো এসেছে। জানতাম না এত ভালো এসরাজের হাত! আগে কখনো আলাপ হয় নি। তার আর দরকারও নেই। অপরিচয়ের অন্তরালে কখন, কি করে যে সে প্রতিবেশী হয়ে আমার অন্দরমহলে প্রবেশ করলো আমি জানি না... যে জীবনকে একটু আগে অবলোকন করলাম, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল ঠিক কোথায়, কতটুকু তাও সঠিক অর্থে জানা নেই... শুধু মন বলছে,কেউ একজন এসেছিল... অবশ্যই এসেছিল...!
চকিতে ফিরে তাকাই! বাড়ির পুরনো কাজের লোক হরিহর কখন এসে চায়ের পেয়ালা হাতে আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জানলার ফাঁক দিয়ে রবিন গুহর ছাদের  দিকে উদাস চোখে চেয়ে বলে,' কতদিন ছেলেটি এখানে থাকবে জানি না। বড় ভালো বাজায় গো! ঠিক যেন শরৎ দাদাবাবুর মতো..! একসময় দাদাবাবুও  ঠিক ঐভাবেই একা একা খোলা ছাদে বসে এসরাজে সুর তুলতেন... দিনগুলো কোথায় যে গেল...! ভেবেছিলাম শরৎ দাদাবাবুর পর ওসব জিনিসের কদর করার লোকও বুঝি হারিয়ে গিয়েছে গুদামঘরের অন্ধকারের ভেতর...চোখের সামনে ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে...দাদাবাবুর কত ভালোবাসার জিনিস ছিল ওটা...ঐ আরামকেদারাখানা...বিদেশ থেকে আনানো ঐ নেশার পাইপ....খুঁজলে পরে ঘরের ভেতর আরো কত কি যে রয়েছে.... আড়ালে আবডালে শুনছি আপনার বড়দা নাকি লোক দিয়ে এবার ওগুলো সব বিক্রি করে দেবে....ব্যবসার হাল ভালো না... দেখেছেন ছোট মুখে বড় কথা হয়ে গেল....! '
' আড়ালে আবডালে শুনছি বড়দা নাকি... 'কথাটা যেন চার দেওয়ালের গায়ে সজোরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো আমার কানে। চোখের সামনে এখনো স্পষ্ট ভেসে আসছে সে ছবি... হয়তো এভাবেই ভাসবে চিরটা কাল...।
আবছা অন্ধকারে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসা একটা ছায়ামূর্তি...নিষেধের অন্তরালে প্রবল অপত্য স্নেহের দুটো হাত....' আমায় চিনতে পারলি না বাবা? একবার দয়া করে বিশ্বাস কর... এগুলো নিয়ে যেতে দিস না...দিলে অনেকগুলো প্রাণ হাহাকার করে উঠবে... এই তো মোটে কটা জিনিস পড়ে আছে...ঐ টুকুকেও তছনছ করে ফেলবে আমার বড় ছেলে...মায়ের চরণে উৎসর্গীকৃত স্যান্নাল বাড়ির পূর্বপুরুষের সে তিনশো বছরের রামদা এখনো কথা বলে....অপগন্ডটা জানে না, কোনটা আশির্বাদ আর কোনটা অভিশম্পাত....ওকে রোধ করা যদি তোর সাধ্যে না  ই কুলোয়, এসরাজখানা অন্তত তুই নিজের কাছে রেখে দিস...ওকি চলে যাচ্ছিস কেন....একবার দয়া করে বিশ্বাস কর ....বাবা হয়ে তোদের কোনো ক্ষতি আমি করবো না...আচ্ছা, আমায় না হয় না ই বিশ্বাস করলি....এসরাজের তারে আজ তোর হাতের স্পর্শ টুকু পেলাম,.এই আমার কাছে মুক্তির...'
আর কিছু ভাবতে না পেরে তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম।
' ও কি বাবু... চললেন কোথায়? '
' তুই আমার সঙ্গে একটু চিলেকোঠার ঘরে যেতে পারবি হরিহর? এসরাজটা নিয়ে আসতে হবে... সাথে ইজিচেয়ারটাও... একটা একটা করে পরে অন্য গুলোও...আনার সময় একটু শুধু ধরবি..।'
' সত্যি নিয়ে আসবেন? রাখবেন কোথায়? '
' আমার কাছে। আমার ঘরে।'
' ছাদের ও ঘর যে কেউ খোলে না বাবু...!'
' আজ খোলা হবে।'
হরিহরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। একদিন বাবার হাত ধরে এ বাড়িতে কাজে ঢুকেছিল... সেই হরিহর।
অবসন্ন বিকেল ধীরে ধীরে ছায়া বিস্তার করেছে রবিন গুহর ছাদের আলসের বৃহদাংশ জুড়ে৷ সে ভাঙা আলোয় নিরবিচ্ছিন্ন সুরে বাজিয়ে চলা বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনা কোথায় যেন  বিষাদ বেদনার স্পর্শে মিশে তারই অতলে  নিমজ্জিত করে তুলেছে আমার অন্তঃকরন....!
ঘটনাচক্রে যদি কখনো ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়, একবার যে তাকে দেখাতেই হবে এসরাজটা আমায়...সাথে ইজিচেয়ারটাও।
 সিঁড়ির ধাপে সবে পা বাড়িয়েছি, এমন সময় দেখি আমার বড়দা সেই সিঁড়ি দিয়েই উদ্বীঘ্ন চিত্তে হন্তদন্ত হয়ে নীচে নেমে আসছেন....
' কান্ডটা কে ঘটালো বলতো?'
' কি হয়েছে? '
' চিলেকোঠার স্টোররুমের তালাটা ভেঙে পড়ে আছে!'

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

মঞ্জরী গোস্বামী