সম্পাদকীয়
বাতিঘর অনলাইন পরাবাস্তব সংখ্যা
পরাবাস্তবতা (Surrealism) শিল্প ও সাহিত্য জগতের এক বিশেষ আন্দোলন, যা ১৯২০-এর দশকে ইউরোপে উদ্ভব হয়। এর প্রবর্তক ছিলেন ফরাসি কবি ও সমালোচক আন্দ্রে ব্রেঁতাঁ। পরাবাস্তবতাবাদ এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যা চেতনার গভীরে লুকিয়ে থাকা অবচেতন মনের প্রতিফলন ঘটাতে চায়। সাধারণ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, পরাবাস্তবতার শিল্পীরা স্বপ্ন, কল্পনা ও অবচেতন জগতের ভাবনাকে প্রাধান্য দেন।
বাংলা সাহিত্যে বিশেষত কবিতায় পরাবাস্তবতা প্রতিফলিত হয়েছে মূলত ১৯৪০-৫০ এর দশকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, বিশ্ব রাজনীতির পালাবদল, এবং বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলন সব মিলিয়ে কবিদের মনের গভীরে এক অস্থিরতা এবং মানসিক দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। সেই সময়ের কবিরা বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে নিজস্ব অবচেতন, দুঃস্বপ্ন এবং ভাবনার নানা রূপ তুলে ধরেন।
বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার ধারাটি প্রচলিত কবিতার বিন্যাস ও বিষয়বস্তুকে ভেঙে দেয়। প্রচলিত চিত্রকল্প, ছন্দ, এবং রূপকগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কবিরা নতুনভাবে বোধ ও ভাব প্রকাশের চেষ্টা করেন। বিশেষত জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পরাবাস্তবতার স্পষ্ট প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। তার কবিতা এক অদ্ভুত, স্বপ্নময়, প্রায় অলৌকিক রূপ ধারণ করে, যেখানে বাস্তবতা এবং কল্পনা মিলে একাকার হয়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ, জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কবিতা "বনলতা সেন"। এই কবিতায় বনলতা সেন এক বাস্তব নারী নয়; বরং কবির কল্পনার এক মূর্তি, যিনি সমস্ত যন্ত্রণার শেষে এক আশ্রয়ের প্রতীক হয়ে ওঠেন। এ কবিতার প্রতিটি পঙক্তি স্বপ্নের মতো ভাসমান এবং রহস্যময়, যা পরাবাস্তবতার মূল সত্তাকে ধারণ করে।
পরাবাস্তবতাবাদ বাংলা কবিতাকে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি দেয়। কবিরা চেতনার স্তর ভেদ করে অবচেতন ও কল্পনার গভীরে প্রবেশ করতে শুরু করেন। তারা প্রচলিত কাঠামো ভেঙে দিয়ে এক ভিন্ন মাত্রার চিন্তা ও অনুভূতির প্রকাশ ঘটান।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ভাস্কর চক্রবর্তী এবং এ সময়ের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য পরাবাস্তববাদী কবি, যাদের কবিতায় আমরা দুঃস্বপ্ন, বিভ্রান্তি, এবং অস্তিত্বের অন্বেষণ দেখতে পাই। তাদের কবিতায় স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মিশ্রণ ঘটে, যেখানে দৃশ্যমান জগতের বাইরের অদৃশ্য কোনো শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটে।
পরাবাস্তবতা বাংলা কবিতার জগতে নতুন একটি মাত্রা নিয়ে আসে, যা ভাবনার গভীর স্তরগুলোতে প্রবেশের পথ খুলে দেয়। এই ধারার কবিতায় চেতনা, অবচেতনা, স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মধ্যে এক অনন্য মিশ্রণ ঘটে। এভাবে বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতাবাদ নিজস্ব স্থান দখল করে নিয়ে এসেছে এবং বাংলা সাহিত্যের এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।
বাতিঘর অনলাইন এমনই কিছু পরাবাস্তবতার সন্ধান করেছে, এই সংখ্যায়। কোন কবিতা বাস্তবতার কোন স্তর অতিক্রম করলো, সে বিচারের দায় পাঠকের। তবে, প্রতিটি লেখাই যে মুগ্ধতার মাত্রা ছোঁবে, বলাই বাহুল্য।
"The sky wept feathers of crimson doves,
While the clock sang dirges to forgotten loves." আমাদের ঘড়িটা বিস্মৃত প্রেমের লোকগান গেয়ে উঠুক। আমাদের লেখাগুলোর উপর দিয়ে উড়ে যাক লাল পালক। সাইকেল ঢালু পথে নেমে আসুক বৃষ্টি নদে। পথ প্রায় নেই। তবু তো বিছানা পাতা থাক পরাবাস্তব ঝরাপাতার...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন