বর্ণালী ভৌমিক দে
মেঘে ঢাকা রহস্যময় রেশম পথ
অতীতের ঐতিহাসিক বাণিজ্য পথ চাক্ষুষ করার স্বপ্ন নিয়ে পুজোর ছুটিতে রওনা দিলাম রেশম পথের দিকে। রেশম পথ বা সিল্ক রুট খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে তৈরী হয়েছিল। সেই সময় থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এশিয়ার উপমহাদেশীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপকে যুক্ত করে এই পথ। অতীতে এর বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। একটি কবিতায় এটিকে সমরখন্দের সোনালী পথ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এক সুন্দর সকালে ট্রেন থেকে নামলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। উত্তরবঙ্গে এলেই মনটা খুশিতে ভরে যায়। কোথা থেকে উড়ে এসে নাকে লাগে পাহাড়ী নদীর ফেনিল গন্ধ আর চোখে ভেসে ওঠে চা পাতার সতেজ সবুজ। নির্দিষ্ট সময়ে গাড়ি এসে দাঁড়ায় আর আমরা গাড়িতে করে চলতে থাকি অজস্র পাহাড়ী বাঁক পেরিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। পথের বাঁকে বাঁকে উম্মোচিত হতে থাকে একের পর এক অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য।
আমাদের প্রথম রাত্রিবাস ছিলো বহমান ঋষিখোলার পাড়ে । সেই মতো আমরা ঋষিখোলা এসে পৌঁছাই ঠিক দুপুরে।একটি পাহাড়ী বাঁক ঘুরতেই সামনে দেখতে পাই সুন্দরী নদীটিকে। সামনের প্রান্তরে ফুটে রয়েছে শত শত ফুল।তার মাঝখান দিয়েই বয়ে চলেছে ঋষিখোলা। নদীর খুব কাছে চলে এসে দেখলাম নদীর ওপর রয়েছে একটি বাঁশের সাঁকো। সাঁকো পেরিয়ে গেলেই ওপারে ছোটো ছোটো কাঠের কটেজ। ঋষিখোলায় এখনও বড়ো হোটেল গড়ে ওঠেনি। কটেজে পৌঁছানোর জন্য নদীর ওপর দিয়েই চললো আমাদের গাড়ি। খরস্রোতা নদীর ওপর দিয়ে যাওয়ার অনুভূতি অনন্য। নদীর স্বচ্ছ জলে পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি এঁকে ছিলো আগেই ।গাড়ি চলার জন্য যে ঢেউ সৃষ্টি হয়েছে তাতে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে এই অনিন্দ্য সুন্দর ক্যানভাস।ওপারে ফুটে থাকা ফুলের মাঝে উড়ে বেড়াচ্ছে রং বেরংয়ের প্রজাপতি।নিজেদের কটেজে পৌঁছে আমরা স্নান সেরে ভাত আর মুরগীর মাংশ সহযোগে দুপুরের খাবার খেয়ে নিয়ে ছুটলাম ঋষিখোলার ধারে। অজস্র পাথর ডিঙিয়ে কাছে গিয়ে একটি পাথরে বসে পরলাম। নিরবে শুধু দেখে যাওয়া খরস্রোতা পাহাড়ী দুরন্ত নদীটিকে। জল বয়ে চলেছে নদীর সহজাত নিম্নগামীতায়।হাত দিয়ে অনুভব করলাম কনকনে ঠাণ্ডা জলকে। আরো কিছুক্ষন নদীর সাথে খেলা করে ফিরে এলাম আমরা। বাকি সময় কেটে গেলো বারান্দায় বসে প্রকৃতির অপূর্ব রূপ দেখতে দেখতে। তখনও জানি না রাতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরো কতো বিস্ময়। ধীরে ধীরে সন্ধ্যে নামে চরাচরে। দুপুরের পাহাড়গুলো গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যেতে থাকে ক্রমশ। অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করে আমরা ঘরে ফিরে আসি।কিছুক্ষন গল্প আড্ডায় সময় কাটিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমের তোরজোড় শুরু করি। নদীর কুলকুল ধ্বনি শোনা না গেলেও রাত জাগা পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে।হঠাৎ হইহুল্লোড় শুনে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি একদল কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে নদীর পাড়ে আগুন জ্বালিয়ে ক্যাম্প ফায়ারিং করছে। একজন গিটার বাজিয়ে গান ধরেছে আবার কেউ কেউ নাচ গানে মাতিয়ে রেখেছে চারদিক । খোলা বারান্দায় বসে রইলাম আরো কিছুক্ষন এই সুন্দর দৃশ্যগুলি দেখার জন্য। আগুনে ঝলসানো মুরগীর মাংশের সাথে ওদের এই আনন্দঘন পর্বটি চলে আরো অনেকক্ষণ। দূরে কোথাও আচমকা ডেকে ওঠে বন্য কোনো প্রাণী । একটু গা ছমছমে পরিবেশে আর বেশিক্ষন বসে থাকা উচিৎ নয় মনে হতেই উঠে পরলাম। পরের দিন উপস্থিত হলো আমাদের ফিরে যাওয়ার মন খারাপের সময় নিয়ে। ফিরে যাওয়ার আগে নদীর পাড়ের ফুলের গাছগুলির ওপর হাত রাখলাম পরম মমতায়। কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ফিরে এলাম গাড়িতে গন্তব্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে । একদিকে সুউচ্চ পাহাড় ও অন্যদিকে গভীর খাদ নিয়ে এগিয়ে চললাম। পাহাড়ের ঘন জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার নিবিড় গুঞ্জন। মাঝে মাঝে দৃষ্টি সীমায় ধরা দিচ্ছে বন্য ঝর্ণা। কখনো কখনো রাস্তার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে এই ছোটো জলধারারা।
ঋষিখোলা থেকে এগিয়ে রংলীতে সিকিম যাওয়ার জন্য পারমিট করাতে হয় প্রতিটি গাড়িকে । রাস্তার পাশে পাশে গাড়ির সারি। পারমিট করানোর লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে অগণিত পর্যটক।এখানেই কেটে গেলো বেশ অনেকটা সময়। অবশেষে পারমিট পেয়ে আমরা পদমচেনের দিকে এগিয়ে চললাম। পথে পরলো কিউখোলা ওয়াটার ফলস্। ঝর্ণার জল প্রবল গর্জনে নিচে নেমে আসছে। কিছুক্ষন ঝর্ণার অপরূপ শোভা দেখলাম গরম চা খেতে খেতে। পথের বাঁকে হারিয়ে যেতে যেতে পদমচেন হোমস্টেতে চলে এলাম। মধ্যাহ্নভোজ শেষে আমরা প্রথমেই অতিথিশালার মালিকের শাকসবজি দেখতে গেলাম। গ্রীন হাউস তৈরি করে ভেতরে শাকসবজির ক্ষেত করা হয়েছে। তবে এই ক্ষেতগুলোতে মূলত ব্রকলির চাষ করা হয়।। রান্নাঘরে এইসব তাজা সবজি রান্না করে পর্যটকদের খেতে দেওয়া হয়ে থাকে। গ্রীন হাউসের সবুজ আলোতে সবুজ শাক সবজি হাতে তুলে দেখতে থাকলাম মহা আনন্দে। ফিরে এসে বেরিয়ে পরলাম পদমচেন জনপদটি ঘুরে ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম চীন বর্ডারের কাছে অবস্থান বলে এখানে ছোটো ছোটো ছাউনী তৈরী করে সেনাবাহিনী মোতায়েন আছে । আরও এগিয়ে গিয়ে একটি মনাস্ট্রির দেখা পেলাম। তবে আজকের দিনের জন্য মনাস্ট্রি বন্ধ ছিল তাই ভেতরে প্রবেশ করতে পারলাম না। মনাস্ট্রী থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হলো তাই ইচ্ছে না থাকলেও ফিরে আসার পথ ধরতেই হলো। আমাদের হোম স্টের সামনে ছিলো বিশাল মাঠ আর তার ওপারে পাহাড়ের সারি । পাহাড়ী বৃষ্টি দেখতে দেখতে গল্পে সময় কেটে গেলো। নেট কানেকশন না থাকার জন্য সমস্ত পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম যা আমাদের প্রকৃতিতে ডুবে যেতে আরো সাহায্য করলো। হিমালয় আর আমি মুখোমুখি একটি ঝি ঝি ডাকা সন্ধ্যে কাটিয়ে দিলাম এক স্বর্গীয় অনুভুতি মেখে ।এখানে রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা তাই তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে গরম লেপের আশ্রয়ে প্রবেশ করতে হলো।
পরের দিন আমরা রেশম পথের বাঁকে হারিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে যাব।পদমচেন থেকে আমাদের গাড়ি ভারতের সবচেয়ে বিপদজনক পথ রেশমপথের দিকে চলেছে চুলের কাটার মতো বাঁক পেছনে ফেলে ফেলে।এখানে মেঘ চরে গাভীর মতো। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি আমাদের পথ ঘিরে রেখেছে সাদা সাদা মেঘেদের দল। এভাবেই আমরা একসময় পৌঁছে গেলাম জুলুক। জুলুক সিকিম রাজ্যের পাকিয়ং জেলার রংলিতে নিম্ন হিমালয়ের রুক্ষ ভূখণ্ডে প্রায় দশ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। পথের অপরূপ সৌন্দর্যের অধিকারী এক স্থান।রাস্তার চেন ধরে জেলালা পাস হয়ে লাসা পর্যন্ত পৌঁছানো যেতো এই পথে । জুলুক পাহাড়ী ছোটো গ্রাম কিন্তূ এখানে অতিথিশালা রয়েছে অনেক। দূর থেকে মেঘের শামিয়ানায় ঢাকা জুলুক দেখে আমরা কুপূপ লেকের দিকে যাত্রা শুরু করি । পথে পরবে থাম্বি ভিউ পয়েন্ট। জিকজ্যাক ভিউ পয়েন্ট থেকে কুড়ি পঁচিশ মিনিটে চলে আসা যায় থাম্বি ভিউ পয়েন্টে। প্রতিটি হেয়ার পিন বাঁক পেরোনোর সময় শিরশিরে অনুভূতি হতে থাকলো। অবশেষে পৌঁছলাম থাম্বি ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে নিচের ফেলে আসা পথ পুরোটাই দেখা যায়। ওপর থেকে মেঘ ঘেরা নীচের পথ দেখলাম মন ভরে ।ভিউ পয়েন্ট থেকে বাঁদিকে দেখা যায় পুরো ঘুমন্ত বুদ্ধকে। দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ হিমালয়ের বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম।সামনের দিকে লক্ষ্মণ চকে এসে গাড়ি থেকে নামলাম বরফের দেখা পেয়ে । দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর বরফে ঢাকা । একটা দোকান দেখে গরম গরম চা আর মোমো খেয়ে নিলাম সকলেই। পরবর্তীতে নাথাং ভ্যালি হয়ে চলে এলাম কুপুপ গ্রামে । কূপূপ গ্রামের পাশেই নীল জলের লেক কুপুপ। এই লেক দেখতে অনেকটা হাতির মতো তাই একে এলিফ্যান্ট লেকও বলা হয়ে থাকে । চারিদিকে বরফ আর ঘন নীল জল নিয়ে নিস্তব্ধ পরিবেশে এই লেক অসাধারণ দেখতে। পাহাড়ে ঘেরা লেকের ধারে বেশ জোরেই ঠান্ডা হাওয়া বইছে। লেকের বরফ ঠাণ্ডা জলে হাত দিলাম । আরো কিছুটা ওপরে রয়েছে ভারত চীন সীমান্ত। এই জন্য এই অঞ্চলে প্রচুর সেনাবাহিনীর বাংকার দেখা যায়। আমরা আর ওপরে গেলাম না এখান থেকেই ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার সময় হঠাৎ আবহাওয়া খারাপ হতে থাকায় পাশের পাহাড়গুলো ঘন কুয়াশায় ঢেকে যেতে থাকে। এতো দ্রুত আবহাওয়া পরিবর্তন পাহাড়েই সম্ভব। এই পথেই রয়েছে পুরনো বাবা মন্দির। বাবা হরভজন শিংয়ের জীবনী বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আমরা আগেই পড়েছি তাই এই মন্দির দেখার আগ্রহ ছিলো বরাবর। অনেক সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উপরে উঠে এই মন্দিরে প্রবেশ করতে হয়। বাবা হরভজন শিং যে বাংকারে কর্মরত ছিলেন সেইটি মন্দিরে পরিণত করা হয়েছে। মন্দিরের একদিকে রয়েছে তাঁর বসার চেয়ার এবং দেওয়ালে ওনার ফটো টাঙ্গানো রয়েছে বেশ কিছু। একটি আসনে বাবার প্রতিকৃতি রেখে পুজো করা হয়ে থাকে। পাশের ঘরটি ছিলো বাবা হরভজন শিংয়ের শয়নকক্ষ এখানে তার বিছানা সাজানো রয়েছে আজও। যে ইউনিফর্ম তিনি ব্যবহার করতেন সেটিও দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে। এছাড়াও তার শিরত্রান এবং জুতো পরিপাটি করে সাজানো আছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈন্যরা এখনও তার স্মারক উপস্থিতি অনুভব করে। যে এলাকায় বাবা হরভজন সিং-এর মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল এবং যেখানে মন্দিরটি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলি পোস্ট করা হয়েছে, তারা যখনই গুরুত্বপূর্ণ কাজে বের হন তখন বাবার আশীর্বাদ চান।এটাও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা হয় যে বাবা সর্বদা তাদের সৈন্যদের সতর্ক করবেন বিদেশী দেশ থেকে কোন প্রত্যাশিত আক্রমণ ঘটার আগে। বাবার সেবা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তার মৃত্যুর পর শক্তিশালী আধ্যাত্মিক উপস্থিতির সম্মানে, তাকে একজন অনারারি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত করা হয়েছে ।আকাশ খুব খারাপ থাকায় এবং ঝিরঝিরে বৃষ্টির কারণে আমরা খুব তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এলাম । পেছনে পরে থাকলো উঠে যাওয়া চুলের কাটার মতো পথের পাহাড়ী বাঁক।এবার আমাদের গন্তব্য আরিতার লেক। যা দেখলাম সেই স্মৃতি আজীবন মনের মণিকোঠায় জাগ্রত হয়ে থাকবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন