অসিত মণ্ডল
নাটক:"একদিন হঠাৎ "
(বাস স্টপে বসে আছে দু'জন।
কাবেরী আর আকাশ। কাবেরী কলেজ পড়ুয়া, আকাশ অফিস যাত্রী। নির্দিষ্ট সময় অন্তর বাস আসছে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ বাসে উঠছে না। দুজনেই চুপচাপ। )
কাবেরী : এক্সকিউজ মি, এই যে শুনছেন?
আকাশ : আ-আমাকে বলছেন?
কাবেরী : আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি? এখানে আর কেউ আছে নাকি?
আকাশ : ও আচ্ছা, বলুন।
কাবেরী: আপনি ঘাড় বেঁকিয়ে মাঝে মাঝে ওভাবে ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন বলুন তো?
আকাশ: আপনার দিকে ,মানে?
কাবেরী : তা আমি ছাড়া এখানে আর কেউ আছে?
আকাশ: না না সেরকম কিছু নয়...
কাবেরী: নয় মানে! তাহলে কি? আরেকটা কথা , পরপর তিনখানা বাস বেরিয়ে গেল আপনি তো কোন বাসে উঠলেন না। আপনি যাবেন কোথায় বলুন তো?
আকাশ: সে প্রশ্ন তো আমিও আপনাকে করতে পারি।
কাবেরী: পারেন, কিন্তু করেননি। এবার বলুন তো? বাড়ি থেকে রাগ করে বেরিয়েছেন?
আকাশ: না, সেরকম কিছু...
কাবেরী: তাহলে, বৌদি বকাবকি করেছেন?
আকাশ : ( চুপ করে থাকে)
কাবেরী : শুনুন, আপনি একটা অন্যায় করেছেন। তার জন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে।
আকাশ : অন্যায়, মানে?
কাবেরী : মানে ঘোরোতর অন্যায়। আপনি বাস স্টপে একটা অপরিচিত মেয়েকে একলা বসে থাকতে দেখে তার সুযোগ নিয়েছেন। বারবার তার দিকে উদ্দেশ্যপূর্নভাবে তাকিয়েছেন। আপনাকে শাস্তি পেতেই হবে।
আকাশ : আপনার ভুল হচ্ছে। আমি আপনার জন্য বাস মিস করিনি।
কাবেরী : তাহলে কার জন্য করলেন?
আকাশ : না মানে আসলে আমার কোথাও যাওয়ার নেই।
কাবেরী : তার মানে? এতো ভয়ংকর ব্যাপার। আপনি বাস স্টপে মেয়ে দেখার জন্য বসে থাকেন ?
আকাশ : একদমই না, আসলে...
কাবেরী : এই যে মশাই, তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন তো।
আকাশ : মানে ? কোথায় যাব?
কাবেরী : সে কি অন্যায় করেছেন শাস্তি পাবেন না?
আকাশ : মানে আপনি কি বলতে চাইছেন? আরে আরে, হাত ধরছেন কেন?
কাবেরী : সব জানতে পারবেন, একটু অপেক্ষা করুন। চলুন তো, নদীর দিকে যাওয়া যাক ।
আকাশ : নদীর পাড়ে?
কাবেরী : তবে কি এই বাস স্টপে বসে থাকবেন ? আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি। একটা মেয়ে আপনাকে হাত ধরে ডাকছে, আর আপনি ক্যাবলার মত ..চলুন চলুন।
আকাশ : আরে আরে একি করছেন?
কাবেরী : আচ্ছা ভীতুর ডিম তো মশাই আপনি। একটু হাতটা ধরতেই অমনি লজ্জাবতী লতার মত গুটিয়ে যাচ্ছেন?
আকাশ : না মানে..
কাবেরী : ওই ওই দিকটা চলুন, ওখানে গিয়ে একটু বসি, ওই ছাতিম গাছের তলায়। ওখানে একটু নির্জনতা আছে।
কি হলো, দাঁড়িয়ে গেলেন কেন? চলুন?
আকাশ : হ্যাঁ , হ্যাঁ, এই, এইতো।
কাবেরী : আচ্ছা বীরপুরুষ তো আপনি! লজ্জা পাচ্ছেন, না ভয় পাচ্ছেন, ঠিক করে বলুন তো এবার। কেউ দেখে ফেলবে ?
আকাশ : না না, ঠিক আছে ঠিক আছে, চলুন বসা যাক।
কাবেরী : আচ্ছা এবার বলুন তো, ওরকম গোমড়ামুখো হয়ে এতক্ষন বসে থাকলেন কেন? পৃথিবীর সব দুঃখ কি আপনার একারই? আর মনে হচ্ছে অফিসটাও তো আজ কামাই হয়ে গেল।
আকাশ : হ্যাঁ, তা তো গেলই। আপনারও তো মনে হয় আজ কলেজ যাওয়া হল না।
কাবেরী : থাক না, আজ না হয় দুজনেরই দিনটা একটু অন্যরকম হলো। দুজনেরই যা হওয়ার ছিল তা হলো না। অন্য কিছু তো হতে পারে, বলুন?
( আকাশ আকাশে চোখ রাখে)
আকাশ : দেখুন আকাশটা কত সুন্দর! দিনান্তের অস্তমান সূর্যের আলোয় মেঘেদের কি অপূর্ব ভাস্কর্য। এই যে সেই অদৃশ্য শিল্পী! এই রং ক্যানভাসে ধরা অসম্ভব বলুন?
কাবেরী : আরে মশাই আছে কোন শিল্পী। আমরা হয়তো তাঁর ঠিকানা জানি না।আর শুনুন ,আকাশটা রোজই এমন সুন্দর থাকে। শুধু আমরা দেখি না। প্রাত্যহিক কাজের চাপে দেখার সময়ই পায় না। দেখার মনটাই কোথাও খুইয়ে বসে আছি ।অথচ সারাদিন ডিঙ্গি নৌকা বেয়ে মাছ ধরার পরেও কর্মক্লান্ত ওই মানুষটাকে দেখুন, দেখুন, বেলাশেষের আলোয় কেমন উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত ।দেখুন কেমন মনের আনন্দে গান গাইছে।
(আবহ সংগীত: 'মাঝি বাইয়া যাও রে ....')
আকাশ : একদম ঠিক বলেছেন। কতদিন এভাবে জলে ভেজা ঘাসের পাশে মেছো বকের বসে থাকা দেখিনি, দেখিনি পানকৌড়ির রোদ পোহানো, দেখিনি নদীর জলের ওপর মৃদু মন্দ বাতাসের এমন আনমনা আলপনা।
কাবেরী : এই যে মশাই, আপনি কবি হয়ে গেলেন নাকি?
আকাশ : না, মানে।
কাবেরী : আবার মানে!
আকাশ : আসলে এমন সুন্দর প্রকৃতির সান্নিধ্যে কোন সুন্দরী বিচারক যদি অপরাধীর জন্য এমন সুন্দর শাস্তি বিধান করেন তবে তো একটু আধটু কবিতা আসবেই তাই না?
কাবেরী : আচ্ছা, সব কথায় মানে মানে করে তোতলাতে থাকা ছেলে এখন বেশ গুছিয়ে কথা বলছে দেখছি।
আকাশ : জানেন,ক'দিন ধরেই মনের ভরকেন্দ্রে একটা অন্ধকার জমাট বেঁধে ছিল। শত আয়োজনেও রাতে ঘুম আসছিল না। ক্লান্তি আর অবসাদ ঘিরে ধরছিল । মনে হচ্ছিল ফুরিয়ে গেল আমার সবকিছু। এমনকি নিজেকে অবাঞ্ছিত অর্থহীন মনে হচ্ছিল।
কাবেরী : আর এখন এই মুহূর্তে?
আকাশ : এখন মনটা পাখির পালকের মতো হালকা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সব বিষাদ ভুলে গিয়ে এ আকাশ, বাতাস, নদীর জন্যেই বেঁচে থাকার দরকার আছে। আর...
কাবেরী : আর কি বলুন।
আকাশ : বলবো?
কাবেরী : আরে মশাই বলেই ফেলুন না।
আকাশ : " প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস। তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।"
কাবেরী : সর্বনাশ করেছে! ও মশাই, আপনি আমার প্রেমে পড়ে গেলেন নাকি?
আকাশ : না না প্রেম-টেম নয়। সরি সরি। কিছু মনে করবেন না। হঠাৎ করে ওই রবীন্দ্রনাথ মনে চলে এসে ....
কাবেরী : আচ্ছা মানুষ তো মশাই আপনি। বললেন আপনি, আর রবীন্দ্রনাথের উপর দোষ চাপাচ্ছেন? ঠিক করে, স্পষ্ট করে বলুন তো কি বলতে চাইছেন। কি মতলব আপনার?
আকাশ : আ-আমি.. মানে..
কাবেরী : আবার আমি, মানে..
আকাশ : আচ্ছা আমরা দুজন বন্ধু হতে পারি না?
কাবেরী : না পারি না। আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি। এই একটুখানি দেখা হলো আর ওমনি বন্ধু হয়ে গেলাম? আমরা তো কেউ কাউকে চিনিই না এখনো।
আকাশ : হ্যাঁ, হ্যাঁ তাইতো। শুনুন ,আমি আকাশ, আকাশ চ্যাটার্জি। বি ১১/১২১ লেক রোড। এই, এই রাখুন আমার কার্ড। এতে ফোন নম্বর আছে।আপনি?
কাবেরী : না না, থাক থাক। এসবের কোন দরকার নেই।
আকাশ : মা-মানে, দরকার নেই মানে?
কাবেরী: থাক না ওসব। দেখুন দেখুন বাতাসে ছাতিম পাতারা কেমন তিরতির করে কাঁপছে।আর নদীর জল ছুঁয়ে দুধ সাদা বকটা কেমন সুন্দর করে উড়ে গেল!
আকাশ : আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
কাবেরী : অবশ্যই, এত অনুমতি নেওয়ার কি আছে মশাই?
আকাশ : এই যে নির্জন বিকেল বেলায় নদীর পাড়ে একজন অপরিচিত মানুষের হাতের উপর হাত রেখে দিব্যি কথা বলে চলেছেন, যেন, যেন মনে হচ্ছে কতদিনের পরিচিত আমরা। এই হঠাৎ প্রাপ্তিরও কি কোন মানে নেই?
কাবেরী : আচ্ছা নাম পরিচয় মানে, এসব দিয়ে কি হবে বলুন তো? ওই যে বাতাসটা ছাতিম গাছের পাতা গুলোকে কাঁপিয়ে ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে দিচ্ছে , ওর কি কোন নাম আছে? কি নাম ওই বকটার? নামে কি আসে যায় বলুন তো? হোয়াটস ইন এ নেম?
আকাশ : না, মানে আপনাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না, তাহলে কিভাবে...
কাবেরী : কিভাবে কি?
আকাশ : আমি বলছিলাম আমাদের আবার দেখা হবে কিভাবে?
কাবেরী : দেখা হবে না।
আকাশ : মা- মা- মানে..?
কাবেরী : হবে না মানে? হবে না। নো মিনস নো।শুনুন ,জীবনের ভালো মুহূর্তগুলো ক্ষণিকের হওয়াই ভালো। তা না হলে এই অসাধারণ মুহূর্তগুলো আপন মাধুর্য হারিয়ে সাধারণের ভিড়ে মিশে হারিয়েযায়। শত চেষ্টা করেও, মাথা কুটে মরলেও, এই মুহূর্তটা আর ফিরে আসে না। মুহূর্তটাকে নিয়েই বাঁচুন না মশাই।
আকাশ : তা হয়তো ঠিক, কিন্তু তাই বলে এভাবে..
কাবেরী : এই যে মশাই, রহস্যের আড়ালেই রোমাঞ্চ লুকিয়ে থাকে। থাক না ,আমাদের দুজনের জীবনের এমন একটা দিন সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে।
আকাশ : সত্যিই আমাদের আর দেখা হবে না?
কাবেরী : একদম না। চলুন ,ওঠা যাক। আর শুনুন, আমাকে আর খোঁজার চেষ্টা করবেন না।
আকাশ : আচ্ছা আমি কি কোন অন্যায় করলাম?
কাবেরী : না না সে সবকিছু নয়। শুনুন, লাইফ ইজ এ লং সেন্টেন্স অফ সরো, পাংচুয়েটেড অনলি উইথ হ্যাপিনেস। আজ বিকেলটা ওই পাংচুয়েশন মার্ক এর মত ছোট্ট সুখ হয়ে থাক আমাদের দুজনেরই জীবনে । ভালো থাকবেন কেমন ? আর মন খারাপ করবেন না। কথা দিন।
আকাশ : না না, মন খারাপ করবো না। আপনিও ভালো থাকবেন।
আচ্ছা,একি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না তো আর। কোথায় গেলেন, কোথায় গেলেন আপনি? কি আশ্চর্য! কি স্পষ্ট সবকিছু!একি স্বপ্ন! নাকি বিভ্রম!
( আবহ সংগীত: স্বপন যদি মধুর এমন হোক না মিছে কল্পনা জাগিও না আমায় জাগিও না...)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন