সৌমী আচার্য্য
খালাস
রাতে এসে টোটে বউয়ের গায়ে বেকায়দা ঠেলা দিল, ওঠ হারামজাদি, সন্ধ্যে হতে না হতে ঘুম। ওঠ বলছি। চম্পার গায়ে মনে কোনো ব্যথা এখন আর হয়না। ওসব বিয়ের দুমাসেই ঘুচেছে। উঠে দেখে বাজারের ব্যাগে তাজা রক্ত। মেঝেতেও গড়িয়েছে। টোটে বাইরের একটুকরো চলটা ওঠা বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্যান্ট ছেড়ে উদোম হয়ে তারে ঝুলতে থাকা হাফপ্যান্টটা টেনে পরে নিল। চম্পা ততক্ষণে ঘরের আলো নিভিয়েছে।
-কী রে আলো বন্ধ করলি কেন? দেখছিস না জামা প্যান্ট ছাড়ছি।
-দত্তকাকিমা বলেছে, লাইট বন্ধ করে জামাকাপড় না ছাড়লে পাড়ার ছেলেদের দিয়ে পিটিয়ে তোমায় খোজা বানিয়ে ছাড়বে।
-কী যতবড় মুখ মুখ নয় ততবড়ো কথা ওই ঢেমনির! হচ্ছে! এবার সব খালাস হবে একে একে। উকিলের বউ কিনা! শালার কালোটাকার গরম পিছনে গুঁজে দেব।
অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনতে শুনতে ব্যাগটা খুলে অবাক হয় চম্পা। খাসি! সাথে দামী চাল। মিষ্টি দই, টকদই, শাহি গরমমশলা, মিঠা আতর, রসগোল্লা, পান, মদের দুটো বোতল, বাদামের প্যাকেট, আলুভাজার প্যাকেট। এত পয়সা খরচা করল কী করে? দুদিন ধরে ঘরে প্রায় সব বাড়ন্ত। বেশি করে জল দিয়ে চাল আর নুন একসাথে ফুটিয়ে নিচ্ছে। বাড়ির সামনের ড্রেনে কলমি হয়েছে। খোঁড়া কুকুরটাকে ওখানে পেচ্ছাপ করতে দেখলেও, ভালো করে ধুয়ে রান্না করার পর আর ঘেন্না হয়নি।
-বিরানির চাল এনেছি সুন্দর করে রানবি। মটন বিরানি, মটন কষা। উফ্ কতদিন পর খাবো। যা আগে একটু চাট বানিয়ে দে বাদাম দিয়ে।
চম্পা রান্না করতে থাকে। সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বেশ কয়েকটা বাড়ি জুড়ে। রতন দাস একমনে কীর্তন শুনছিল ফোনে। গন্ধটা তাতিয়ে দিল।
-এ্যাই সুরমা! কী রান্না করছ?
-আলু মিষ্টিকুমড়ো।
-তাহলে এমন গন্ধ!
-যাদের ঘরে অঢেল পয়সা তারাই করছে হবে। আমার মতো পোড়া কপাল তো সবার না।
-সব সময় এত ট্যাকস্ ট্যাকস করো কেন?
-সত্যি বললে যদি গায়ে লাগে তাহলে আমার কিছু করার নেই।
দাঁতে দাঁত চাপে রতন। একেক সময় ইচ্ছে করে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে দিলে শান্তি পাওয়া যেত। সারাক্ষণ খোঁচাতে থাকবে। ওর বড়দার মতো পাসপোর্ট অফিসে বসে লোকের ঘাড় ভেঙে গাদা গাদা টাকা ইনকাম করতে পারে না বলে যত রাগ। কোনো নীতিবোধ আছে মহিলার! শুধু পয়সা চেনে। সুন্দর চেহারার পিছনে একটা ডাইনি বসে আছে। মনের ভিতর গজরাতে গজরাতে বাড়ির গেট খুলে রাস্তায় নেমে আসে। লুঙ্গিটা বাঁহাতে একটু উঁচু করে ধরে রবির দোকানের দিকে হাঁটা দেয়। দোকানটায় পৌঁছে সবে একটা ডালমুটের প্যাকেট কিনে মুখে ঢেলেছে ওমনি বাঁ কাঁধে চাপ।
-রতন বয়সটা যে পঞ্চাশের কোটায়। একটু সংযত হতে হবে তো।
পাড়ার বিজ্ঞ হোমিওপ্যাথ নিকুঞ্জ বটব্যাল। সবেতেই নিজের ঢাক পিটিয়ে শান্তি পায় লোকটা।
-বুঝলে গতকাল সল্টলেক থেকে এক পেশেন্ট এসেছে, ওই আমাদের দত্ত বাড়ির বড় মেয়ে পাঠিয়েছে। ওর বাঁ পায়ের চোটটা সারানোর পর থেকেই আমার ফ্যান তাই আবার লোক পাঠিয়েছে। বুঝলে একেবারে ক্রনিক পাইলস্। আমি বলে দিয়েছি ওসব এ্যালোপ্যাথিতে সারে না।
-আজ্ঞে আমি আসি। রাত হল অনেক।
-শোনো রতন। তোমার ছেলের গতিবিধির দিকে একটু নজর রেখো। পাড়ায় নানারকম লোকের বাস। কোথায় যাচ্ছে কী করছে একেবারে না দেখলে চলে?
ভুরু কুঁচকে যায় রতনের, কেন বলুন তো! কোনো খারাপ আচরণ দেখেছেন? নিকুঞ্জ কোনো উত্তর না দিয়ে বলে, আমার মনে হল তোমায় বলি, বললাম, মনে রেখো ক্যানসার সারানোর ওষুধ হোমিওপ্যাথিতে নেই কিন্তু যাতে না হয় তার জন্য প্রিকর্শান নেবার ওষুধ আছে। সবকিছু হাতের বাইরে যাবার আগে রাশ টেনে নাও। রতন দাস যে কথাটা শুনে দাঁত কড়মড় করে গলির অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সেটা নিকুঞ্জর মনে কোনো প্রভাব ফেলল না। গিন্নির ফরমাশের জিনিসগুলো নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিল। দোকানে বসে রবি সব মন দিয়ে শুনছিল। ওর মুখে একটা ক্রূর হাসি। ফোনে কাউকে ধরল।
-হ্যাঁ রে অভিজিৎ এর খবর কী? ও তাই! আচ্ছা! আচ্ছা! বাড়ুক বাড়তে দে। সময় এলে ডানা ছাঁটা যাবে। রাখছি কাস্টমার এসেছে।
রবি ভালো করে তাকিয়ে দেখল, টোটে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারছে না। ঘোলা চোখে বলছে, শালার সাতরকম প্যাকনা। এ্যাই ব্যাট্টাচ্ছেলে রবি কেওড়াতলা মহাশ্মশান দে, বিরানিতে লাগবে। গোলাপজল ছিটিয়ে দিতে হবে, না হলে মরার গায়ে ভালো গন্ধ হবে কী করে? শালা আসলে বিরানী তো মরা দিয়েই বানানো। মুরগি মরা। না না আজ তো খাসি মরা। এ্যাই রবি এ্যাই শালা কুচটে রবি, বলতো মানুষের মরা দিয়ে কি বিরানি হয়? রবি এতটুকু চটে না। বরং শান্ত থেকে বলে, তা কাজটা কে দিল রে? মধুদা নাকি ফাল্গুনী! টোটে ফ্যাচ ফ্যাচ করে হেসে বলে, তোকে শালা কেউ খালাস করে না কেন রে? তুই শালা বহুত খচ্চর। মালপত্র নিয়ে টলতে টলতে বাড়ি ফেরে টোটে। সাধের বিরানি ফেলে ছড়িয়ে কোন রকম খেয়ে উল্টে পড়ে থাকে বারান্দায়।
সকালের আলো ফোটার আগে চম্পা ঘরবাড়ি পরিস্কার করে কাজে চলে যায়। নৃপেণ দত্ত বাড়ির গেটের তালা খুলতে খুলতে চম্পাকে বাসি চোখে গিলতে থাকে। এসব পাত্তা দেয় না চম্পা। চেম্বার পরিস্কার করে তবে রান্নাঘরে ঢোকে। দত্তগিন্নী আগুন চোখে তাকিয়ে।
-হ্যাঁ রে লজ্জাসরম কিছু নেই না? না তোর না তোর বরের। ইচ্ছে করে ক্লাবের ছেলেগুলোকে ডেকে বলি। কী করতে যে মরণের আমার বাড়ির পিছনে তোদের বসাল তা বুঝিনা।
চম্পা ঘাড় গুঁজে চিংড়ি ছাড়াতে থাকে। দত্তগিন্নী গজরায়, একজন ল্যাংটা হয়ে প্যান্ট ছাড়ে তো আরেকজন লীলাখেলা শুরু করে বারান্দা থেকে। ইচ্ছে করে করিস তোরা এসব তাইনা! চম্পা মনে মনে হাসে। হাত চালায় দ্রুত। সিঙ্কে চিংড়ি ধুতে যেতেই, দত্তগিন্নী ফেটে পড়ে, তোর গলায় চাকা চাকা কিসের দাগ! সত্যি করে বল!
-কাকিমা তোমার বাড়ি কাজ করি বলে কি নিজের সব কথা বলতে হবে? আমায় না দেখে আমার কাজ দেখো। সারাদিন তোমার আর কোনো কাজ নেই না! আমার বাড়ির দিকে দূরবীণ লাগিয়ে বসে থাকো কেন?
-কী কী! বড্ড বার বেড়েছে নাহ্! দাঁড়া আজ তোর হচ্ছে।
-কর্তা গিন্নীর স্বভাব পুরো এক। বয়স বাড়লে বর বউয়ের মুখটাও এক রকম হয় তোমাদের স্বভাবটা এক হয়েছে।
দত্তগিন্নীর চিৎকার সপ্তমে ওঠে। চম্পা কচুরী, ছোলার ডাল আর ছানার জিলিপি সাজিয়ে নৃপেণ দত্তের সামনে রাখে।
-কী হল আজ সকাল সকাল শুরু হল যে।
-নিজের বউকে ঠাণ্ডা করতে পারেন না বলে সে কারোর আগুন সহ্য করতে পারেনা, তাই চিল্লায়।
নৃপেণ দত্ত কটকটে চোখে তাকিয়ে বলে, তোকে ঠাণ্ডা করতে পারি জানিস? এত চোপা কেন তোর? চম্পা বাঁকা হেসে দ্রুত সরে আসে। দরকার পড়লে একটু ছোঁয়াছুঁয়ি নিজে থেকেই করতে পারে কিন্তু গতকাল রাতের স্মৃতি যতক্ষণ টাটকা আছে ততক্ষণ এইসব বুড়ো হাবড়াকে ফিরেও দেখতে চায় না। দত্তগিন্নীর শাপশাপান্ত মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরে। ক্লাবের থেকে রথি, চন্দ্র, নেপা, বিকি, রকি আঁশটে চোখে জরিপ করে ওকে। বিকি পকেট থেকে বিড়ি বার করে ধরায়।
-আর কতটা বাড়তে দিবি ভেবেছিস? মধুদাকে এবার জানালে হতনা!
রথি ঘাড়ের পাশটা চুলকে বলে, মধুদা আমাদের কাজের কী করল সেটা আগে বল। আর কতদিন ফেউ হয়ে ঘুরব? বয়স তো বেড়েই চলেছে। বিকি আবার আঁশটে চোখে তাকায়, কেনরে? তোর কটা ডিগ্রি রয়েছে যে মধুদাকে সব ফেলে তোর কাজের কথা ভাবতে হবে? আগে এই কেসটা নিয়ে ভাব। পাড়ার ভিতর এইসব ছিনালি চলতে দেওয়া যায়না।
-কে কী করবে তাই দেখে বেরালে আমার ঘরে তো আর হাঁড়ি চড়বে না রে। বাবার হাঁপানির টান। মার সব্জি বিক্রির টাকায় দিন চলে তবু রাত কাটে না।
রথির ঘাড়টা নেপা বেশ জোরেই ধরে, ভাই তুই নিজের কান্নাটা বন্ধ কর। এদিক ওদিক কাজের পর মধুদা যথেষ্ট টাকা দেয়। তাছাড়া প্রতিদিন রাতের রুটি তরকা, সপ্তাহে একদিন মাংস মদ সবই তো দিচ্ছে, বিনিময় ওর কথাগুলো শুনতে হবে না! এই বিকি ফোনটা লাগা মধুদাকে।
মধুময় সামন্ত বাড়িতে বসার ঘরে বসে নিজের ছোটো ভাইয়ের দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ভাইটিও জড়োসড়ো। খানিকপর উদার স্বরে বলে, তোকে তো গ্রামের বাড়ি, বাজারের দুটো ঘর সব ছেড়ে দিয়েছি কেবল এই পঁচিশ বিঘে আমি দিতে পারব না। এটা তোকে ছাড়তে হবে। কেস করতে পারিস তবে আমার দলের ছেলেরা আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। আমার টেনশান ওদের কাঁদায়। তাই যা করবি বুঝে করিস। তাছাড়া দেখ। তোর মেয়ে আমারও মেয়ে ওর বিয়েতে শহরের সবচে বড় এসি ব্যাঙ্কোয়েট আমি ভাড়া করে দেব, ক্যাটারিং নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না, মেয়ে জামাইকে হানিমুনে পাঠানোর খরচাও আমার। এরপরেও তুই পঁচিশ বিঘের ভাগ চেয়ে অশান্তি টেনে আনছিস? যা ভিতরে যা। তোর বউদি ইলিশ রেঁধেছে খেয়ে বাড়ির জন্য নিয়ে যা। ছোটভাই মাটি কামড়ে চলে গেল। ফোন তুলে নিজেই ফোন করল মধু।
-বিকি বল!... শোন বিকি খালাস তাকে করতে হয় যার কারণে আরও দশটা সমস্যার সমাধান হয় বুঝলি? সন্ধ্যায় আসিস কথা আছে।
ফোন রেখে আবার ফোন করে। ফোনটা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাগানে যায়। ডাইনিং টেবিলে ছোটো দেওরকে খাবার দিতে দিতে শতরূপা বিষন্ন চোখে বাগানে তাকায়। স্মিত হাসির রেখা তার বরের মুখে আলোর থোকা থোকা ফুল ফুটিয়ে রেখেছে। ক্রূর মানুষটা কখন এমন প্রেমিক হয় সে জানে।
-দাদা, ওই মেয়েছেলেটার কাছে এখনও যায়?
-হ্যাঁ, বিয়ে না হলে সব প্রেমই টিঁকে যায়।
-বউদি, চিরকাল তোমায় নিজের দিদির মতোই দেখেছি, তোমার অসম্মান ভালো লাগে না।
-কী লাভ ভাই! এর থেকে তো মুক্তি নেই।
-আছে উপায়, তবে জানিনা আদৌ সম্ভব কিনা।
শতরূপা জানলা দিয়ে দেখতে থাকে। মনে মনে লিপ রিড করার চেষ্টা করে। ঠিক আছে তাহলে মনে রেখো এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এভাবে তো চলবে না। তুমি ছেলেকে একটু সামলে রাখো। শতরূপা জানে তার মেয়ে এই অগাধ সম্পত্তির সবটা পাবে না। তারক খাওয়া সেরে ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ি গিয়েই আবার বেরিয়ে আসে। স্বপনের দোকানে ঢুকে বলে, একটু বাইরে আয় কথা আছে। স্বপন বাইরে আসে। বাজারের পাশে বয়ে যাওয়া খালের ধারে দাঁড়িয়ে দুজনে বিড়িতে টান দেয়। তারক সবটা বলা শেষ হলে বলে, দেখ স্বপন আমি সরাসরি দেখা করতে পারব না। আর বিষয়টা এমন ভাবে করতে হবে যাতে প্রমাণ না থাকে। ওই মেয়েছেলেটার সাথে কোথায় দেখা করে না করে সব আমি বলে দেব। কেবল মনে রাখিস বিষয়টা কাকপক্ষীতেও টের না পায়। স্বপন বিড়িতে শেষ টান দিয়ে বলে, বুঝেছি! টাকা খসবে জলের মতো এটা জেনে এইসব কাজে নামিস। তবে ফোনে এসব বলা সেফ না। দেখা করেই তোকে বলতে হবে। কোথায় কী ভাবে সে আমি বলে দেব। মনে রাখিস ফাল্গুনী অল্প বয়েসের রগচটা ছেলে। দলে সবে চার বছর। আজ রাতটা ভেবে নে।
টোটে এ্যাকশানে যাবার আগে চম্পাকে আদর করতেই চেয়েছিল কিন্তু চম্পা কাজের ছুঁতোয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। দত্ত বুড়োটা যে ওর গায়ে হাত টাত দেয় এটা টোটে জানত, বউকে বলেছিল, দিলে দিক টাকাটা বুঝে নিবি। আমাদের ঘরে শরীর নিয়ে বাছবিচার করলে, সতীপনা দেখালে চলে না, পেটটাই বড়ো বুঝলি! তাই যখন তখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে কিছু বলতে পারেনা টোটে। যাকগে কাজ খালাস করে ফিরে পিঠে দুঘা দিলেই হবে। ঘরের দরজায় তালা দিয়ে হেঁটে শিবতলায় চলে আসে। মালটার এখান দিয়েই ফেরার কথা। শিবতলার এই জায়গাটা রাত আটটার ভিতরেই শুনশান। ফি বছর একটা দুটো লাশ এখানেই জমা হয়। আত্মহত্যার বাসাবাড়িও এই বটগাছ। তাই সুবিধাজনক পরিবেশ এ্যাকশানের। কিন্তু দূরে বেশ কয়েকটা মোটর বাইকের আলো দেখা যাচ্ছে দেখে, গাছে উঠে পড়াটাই বুদ্ধিমানের মনে হল টোটের। গাড়িগুলো বটগাছের নীচেই দাঁড়িয়েছে। নিজের ফোনটা আগে সাইলেন্ট করে নিল। ছেলেগুলো চাপা স্বরে কথা বলছে।
-রতন বাড়ি ফিরবে এই পথে ওর পিছনে তোরা দুজন যাবি। চেম্বার ঠিকঠাক লোড করেছিস তো!
-হ্যাঁ!
-আমরা সোজা চাকিপাড়ায় যাব। মালটা বেহেড হলেই ফোন আসবে, বাড়ির বাইরে গাড়ি থাকবে উঠতে যাবার আগে ধাক্কাটা দিতে হবে। পুরো এক্সিডেন্ট মনে হয় যেন।
-ধরা পড়ার চান্স নেই তো!
-উঁহু লোকজন ঠিক করা আছে।
টোটে টানটান হয়ে ওঠে। ঘটনাটা কী? এরা কারা? কার উপর এত রিষ্! ধাঁধাঁ লাগে টোটের। কিন্তু ও যদি কাজ না করতে পারে তাহলে তো ঘাড়ে মাথা থাকবে না। মধুদা কথার খেলাপ সহ্য করেনা। এসব ভাবতে ভাবতেই রতন ভুটভুটি করে রাস্তাটা পার হয়ে যায়। দুটো ছেলে পিছনে যায় হেঁটে। বাকি গাড়িগুলো চাকিপাড়ার দিকে যেতেই গাছ থেকে নেমে পড়ল টোটে। দ্রুত পা চালাল।
থানার বড়বাবুর ঘরে ফাল্গুনী গুপ্ত বসে আছে। বাইরে জনতার ভীড়। নাকটা একটু চুলকে ফাল্গুনী বলল, স্যার টোটের মতো দুষ্কৃতী খালাস হলে কার কী যায় আসে? ওর কচি বউটাকে সামলানোর লোকের অভাব না। কিন্তু মধুদার কেসটা জরুরি। উনি দলের পুরোনো নেতা। এই পুরো এলাকার কাজ দেখেন। তার এমন অকাল মৃত্যু মানতে পারছি না। এটা আপনি দেখুন। গাড়িগুলো রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গিয়েছে বুঝলাম তবু এটা কি আদৌ দুর্ঘটনা নাকি এর পিছনে ষড়যন্ত্র আছে। অপনেন্টকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। চাপে রাখুন। আপনাকে আমার দল দেখবে। তবে একটা ছোট্ট কথা স্যার। ব্যাপারটা আপনি জাস্ট মাথায় রাখুন। যে বাড়ির সামনে মধুদার এক্সিডেন্ট হয় সেই বাড়ির লোক পাসপোর্ট অফিসে বড় র্যাঙ্কে আছে। মধুদা কি বিদেশ যেতে চাইছিল? নাকি কাউকে পাঠাতে চাইছিল? সে আপনি তদন্ত করে দেখবেন জানি তাও বললাম। ক্লাবের ছেলেগুলোকে তুলেছেন ঠিকই আছে, ধোলাই এমন দেবেন যাতে কিছু অন্ততঃ বার হয়। শুনলাম ওরা নাকি বলছে মধুদার লোক ওরা!
-শুধু বলছে না। কিছু কল রেকর্ডও দেখিয়েছে। সেটাও প্রমাণ ফাল্গুনী বাবু। তবে বুদ্ধিমান লোক সরাসরি কিছু ক্লু রাখেনি সবটাই ভাববাচ্য। তাই মধুবাবুর কল রেকর্ড ক্লিন। আপনার কথা বুঝতে পারছি কিন্তু একই দিনে দুটো ঘটনাতে এলাকা ভীষণ তেতে আছে।
চিবিয়ে হাসে ফাল্গুনী, স্যার ক্লাবের ছেলেগুলো আছে তো আপনার হাতে। চলি স্যার। বাড়িতে একবার ফোন করে নিন। ম্যাডাম কিছু বলবেন হয়ত।
প্রকৃতি মানুষকে চমৎকার এক গুণ দিয়েছে সে দীর্ঘদিন কোনো ঘটনা মনে রাখতে পারেনা। তাই চম্পার বারান্দায় ঘেরা পড়লে দত্তগিন্নী স্বস্তির শ্বাস ফেলে। রাত বিরেতে কারা আসে গাড়ি থামিয়ে তাই নিয়ে কৌতুহল চাপা রাখে বুকে। চম্পার সামনের ঘর মুদিখানায় রূপান্তরিত হয়। রতনের ছেলে অভিজিৎ এই ঘটনার কয়েকমাস পর চোর সন্দেহে গণ পিটুনি খায় বাজারের পাশের খালপাড়ে। পুলিশ দু একজনকে এ্যারেস্ট করলেও তারা বেল পেয়ে যায়। রতনের বউ সুরমার চোখের তলায় কালি, মুখে কথা নেই। রতন বিরক্ত।
-আর কতদিন ওই ঘটনা মনে পুষে রাখবে? মরছে তো একটা ঠাণ্ডা মাথার শয়তান বাদ দাও না। তোমার দাদাকেও পুলিশ যখন ক্লিনচিট দিয়েছে এত চিন্তা কিসের?
সুরমা কথা বলে না। ছেলের ঘরে গিয়ে ওষুধ খাওয়ায়, চোখ জলে ভরা। রবির দোকানে নিকুঞ্জ ডাক্তার ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে, আগেই বলেছিলাম ছেলেকে সংযত করতে কথা শুনলে তো! তাছাড়া এই নার্ভের রোগে হোমিওপ্যাথি সেরা, এমন ওষুধ আছে না! রবি ব্যস্ত হয়ে ফোন করে। অকারণ বকবক করে নিকুঞ্জকে এড়াতে। রকি, বিকি ফাল্গুনীর দলে ভিড়েছে। নতুন করে মানিয়ে নিচ্ছে। কেবল রথি মানে রথীন্দ্র হালদার অকেজো বাঁপা টেনে টেনে সব্জি ভ্যানে নিয়ে ঘোরে। পুলিশের মার খেয়ে ক্ষতবিক্ষত রথিকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে ওর মা ওখানে অজ্ঞান হয়ে যায়। তাই রথি সুস্থ হয়ে মাকে আর বেরোতে দেয়নি। নিজেই সব্জি বিক্রি করে। বছর খানেক যেতেই একদিন রথি একটা ফোন পায়। আননোন নম্বর থেকে। চাপা গলা।
-ফাল্গুনী তোমার এমন দশার জন্য যে দায়ী সেকথা নিশ্চই জানো। দেখো আমি কে, কী এই বৃতান্ত জানতে চেও না। তবে আমাদের কাজের ধরণ বোধহয় তুমি জানো। মধুবাবুর মার্ডার কেসটা পুরোপুরি এ্যাক্সিডেন্ট যাতে মনে হয়। সেসব আমরাই করিয়েছি। তুমি রাজি হলে পাঁচ লাখ পাবে। রাজি হলেই ব্যাঙ্কে দুলাখ ঢোকার ম্যাসেজ পেয়ে যাবে। কাজ শেষে বাকিটা।
-কাজটা কী?
-ওই যা রোজই কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো ভাবে করছে, খালাস।
দাপুটে ফাল্গুনী একাই সকালে এক্সারসাইজ করে সাঁতার কেটে ফেরে। রথি তাকিয়ে দেখে জলের ভিতর ফাল্গুনী না যেন আস্ত কুমীর। ওর বুকের ভিতর বসে কে যেন ফিসফিস করে, বেঁচে থাকলে কতগুলো কে খালাস করবে এই শয়তান কে জানে! সামনের নির্বাচনে জিতে যাবার আগেই...ফাল্গুনী হঠাৎ চমকে ওঠে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন