অলোক বিশ্বাস

 



ফরাসি কবি আঁদ্রে এঁতোর Manifeste de surrealisme (Manifesto of Surrealism)


গ্রন্থটি প্রকাশের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে পরাবাস্তববাদ নিয়ে আলোচনা এক বিশেষ মাত্রা পাচ্ছে। যারা নিজেদের পাঠপ্রক্রিয়ায় বিশ্ব সাহিত্যের জানালা দরোজাগুলো খুলে রেখেছেন, তাঁরা ফরাসি কবি গিয়োম আপোলিনের কবিতার সাথে পরিচিত আছেন এবং অবগত আছেন যে "স্যুররিয়াল" শব্দটি তিনি প্রথম তাঁর আত্মজৈবনিক Le poete assassimé শীর্ষক উপন্যাসটিতে ব্যবহার করেন। তাছাড়া পরাবাস্তববাদী কাব্যধারার আরেক পূর্বগ লোত্রেয়াঁমর Les Chants de Maldoror, যে গ্রন্থের শিকড় রয়েছে শার্ল বোদলের ও আর্ত্যর র‌্যাঁবোর কবিতা ও কাব্যভাবনায়। গত শতাব্দীর বিশ ও তিরিশ দশকের মধ্যে পরাবাস্তববাদী আন্দোলন দানা বাঁধে। এই আন্দোলনকে সেই সময়ের নন্দনতত্ত্বের ট্র্যাডিশন ও ডাডাবাদের সৃজনশক্তিহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

আমরা জানি, ডাডাবাদের আন্দোলন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ পাশবিকতা ও যুক্তিবাদের সীমাবদ্ধতার ফলশ্রুতি। পরাবাস্তববাদী লেখকেরা এমন এক অতিবাস্তবের সৃজনে উন্মুখ হলেন যেখানে অবচেতনের উপলব্ধিমালা ও ইন্দ্রিয়-প্রতীত, দৃশ্যমান জগতের বাস্তবতা মিশে যায়। পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের উদ্ভাবনী শৈলীর গভীর প্রভাব আধুনিক চিত্র-শিল্প, কবিতা, উপন্যাস ও সিনেমায় লক্ষ্য করা যায়। যদিও পরাবাস্তববাদীরা ডাডাবাদকে বর্জন করেছিলেন, ডাডাবাদের উপস্থাপন প্রণালী থেকে শিখেছিলেনও অনেক কিছু। ব্রতোঁ তাঁর অনুগামীদের ডাডাবাদী বিচারশক্তিরোহিত মনশ্ছবি গঠনের পরিবর্তে অপ্রমোত্ত, বাস্তবোচিত মনশ্ছবি সৃজনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন; উদ্বুদ্ধ করেছিলেন "অজানা মন” কে আবিষ্কার করতে যাতে নাকি আসল চিন্তাপ্রবাহের হদিশ পাওয়া যায়।

জিগমুন্ট ফ্রয়েড এর অবচেতনের গভীর অনুসন্ধান ব্রতোঁ ও তাঁর অনুগামীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সব পরাবাস্তববাদীরাই তাদের স্বপ্ন-জগতের কথা লিপিবদ্ধ করেছিলেন এবং স্বতঃস্ফূর্ত, ইচ্ছানিরেপক্ষ লেখনীতে (automatic writing) আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তাদের মূল অভিপ্রায়ই ছিল কল্পনাকে যুক্তিবাদের কয়েদখানা থেকে মুক্ত করা। তারা শিল্পকে নান্দনিক ও উপদেশধর্মী আচ্ছন্নতা থেকে বার করে আনতে চেয়েছিলেন। তাই তাদের লেখাতে এসেছে উদ্ভট বিষয়বস্তু, স্বপ্ন, চিত্তবিভ্রম, এবং অবচেতনের কথা। সাধারণ ও পরিচিত বিষয়কে অভিনব ও যুক্তিবিরুদ্ধ সম্পর্কে সংস্থাপনের মাধ্যমে প্রথাসিদ্ধ বাস্তবের ছবির অগভীরতাকে বর্জন করতে চেয়েছিলেন। ফ্রান্সের অগ্রগণ্য পরাবাস্তববাদী লেখকেরা La revolution surrealists এবং Le surréalisme au service de la revolution শীর্ষক জার্নালে তাদের লেখা ছাপাতেন। এই কাব্য আন্দোলনের অগ্রভাগে ব্রতোঁ ছাড়াও ছিলেন পল এল্যুয়ার, রনে শার, লুই আঁরগ ও আঁতোঁন্যাঁ আর্তো এর মতো কবিরা।

ব্রতোঁ তাঁর ম্যানিফেস্টোতে পরাবাস্তববাদের দুটি সংঘা দিয়েছিলেন। একটি প্রকাশ-পদ্ধতি সংক্রান্ত, আরেকটি বাস্তবের প্রকৃতি ও মাত্রা সংক্রান্ত। তিনি মনে করতেন চিন্তাকে যদি যুক্তির শাসন এবং নৈতিক ও নান্দনিক মূল্যায়নের মানদণ্ড থেকে মুক্ত করা যায় তবে চিন্তার প্রকাশ এমন এক রূপ নেবে যা সর্বজন- স্বীকৃত উপস্থাপন রীতির আওতার বাইরে।

ব্রতোঁ তাঁর দ্বিতীয় সংঘাকে "এনসাইক্লোপিডিক" আখ্যান দিয়েছিলেন। তিনি পরাবাস্তববাদকে এমন এক ভাবানুষঙ্গমালার চেতনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যা এতদিন কবিতায় অবহেলিত হয়েছে, অথচ যা স্বপ্নে, যৌন আকর্ষণে ও যা চিন্তাপ্রবাহের স্বতস্ফূর্ত ও অবাধ স্বক্রিয়তায় অন্তস্থিত। এই চেতনা এমন এক তীব্র স্নায়বিক সংবেদন সৃষ্টি করে যা শিল্পের নতুন দিগন্ত খুলে দেয় ও জীবনের মূল ও গভীর সমস্যাগুলো সমাধানে সাহায্য করে। তাঁর দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টোতে ব্রতোঁ একটি মানস-প্রেক্ষিতের কথা বলেন যেখানে জীবন ও মৃত্যু, বাস্তব ও কল্পলোক, অতীত ও ভবিষ্যত, এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য আর পরস্পর বিরোধী বলে মনে হয়না।

পরাবাস্তববাদী মানসিক অবস্থা প্রকাশ করবার জন্য ভাষা অপরিহার্য কেননা পরস্পর বিরোধী শব্দের সংশ্লেষ ঘটিয়ে ও চিহ্ন (signifier), যা চিহ্ননের (signified) মধ্যে ছাঁচে-ঢালা সম্পর্কে জমে আছে, তাকে মুক্ত করে, ভাষা স্বপ্ন-জগতের ইঙ্গিত দিতে ও যা অযৌক্তিক তার প্রকাশ করতে সমর্থ।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা যদি ভাষা স্তরে ঘটে, তবে দেখবার দৃষ্টিকে অকলঙ্ক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু ও ঘটনাকে পূর্বপরিকল্পিত ধারনার অনুষঙ্গ থেকে বিযুক্ত করতে হবে। পরাবাস্তববাদীরা আদিম সমাজ ব্যবস্থায় মৌল, পবিত্র জীবনের রূপ খুঁজে পেয়েছিলেন।

ধ্বনিমাধুর্য, গতিময়তা, বাকনৈপুন্য ও লাবণ্য, রুচি এবং গঠন-সংক্রান্ত কৃৎকৌশল হচ্ছে ঐতিহ্য-নিষ্ঠ কবিতার বৌদ্ধিক ও ইন্দ্রিয়-সংবেদী প্রকরণের সমষ্টি মাত্র; ব্রতোঁর মতে এগুলো হচ্ছে জরাজীর্ণ কাব্যের বৈশিষ্ট্য, যা এতদিন মানুষকে আনন্দিত ও মুগ্ধ করে রেখেছে। নির্মাণ, অন্তমিল ও ছন্দের প্রতি ব্রতোঁর গভীর আনাস্থা ছিল; একই সাথে তিনি উনবিংশ শতকের অতীন্দ্রিয়বাদী কাব্যতত্ত্ব (poetics of transcendence) বিচার ধারাকে বর্জন করেছিলেন। ব্রতোঁর নিজের কবিতা এক প্রতিকাব্যতত্ত্বকে (antipoetics) গড়ে তুলেছিল। তিনি কবিতার বহিরঙ্গসজ্জার দিকটা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে গেছেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন: "কবিতা? তুমি যেখানে কবিতা আছে ভাবছ, সেখানে তা নেই। কবিতার অস্তিত্ব রয়েছে শব্দ, শৈলী, ইত্যাদির বাইরে।” এই শৈল্পিক অন্তর্ঘাত যুক্তির বিরুদ্ধে ব্রতোঁর যুদ্ধ ঘোষনার ফলশ্রুতি।

ব্রতোঁর কবিতার আলোচনায় দুটি পারিভাষিক শব্দ অনিবার্যভাবে এসে পড়ে। একটি হচ্ছে dépaysement, আরেকটি merveilleux। প্রথমটি শব্দটির সন্তোষজনক বাংলা বা ইংরেজি সমার্থক শব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন। একজন ব্যক্তি জীবনে প্রথম কোনো অস্বস্তিকর বা রহস্যময় পরিস্থিতিতে পড়ে যে বিভ্রান্তিকর ও স্থৈর্যচ্যুত অবস্থায় পড়ে সেই অবস্থাকে dépaysement বলে। "বিস্ময়কর,” “অদ্ভুত,” “অতিপ্রাকৃতিক” Merveilleux এর সমার্থক শব্দ হতে পারে। জাঁ পিয়ের কভিন তাঁর The Poetics of André Breton বলেছেন, " Without dépaysement, there is no merveilleux, no encounter with the marvelous, the objective of all surrealist activity." রহস্যময় অজানার মুখোমুখি হওয়াটাই পরাবাস্তববাদী কবিদের মূল লক্ষ্য। ব্রতোঁর কাছে কবিতা ও জীবন সমার্থক। সৃজনপ্রক্রিয়া এক দুঃসাহসিক যাত্রা।

কবিতার ব্যাকরণকে ব্রতোঁ বর্জন করেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা L'Union libre [Free Union] পড়লে বোঝা যায় ব্রতোঁ ভাষার ব্যবহারে কী পরিমাণ ঝুঁকি নিয়েছিলেন। ষাট পংক্তির কবিতাটিতে ব্রতোঁ নারী শরীরের মহিমা-বর্ণন করেছেন। চিত্রকল্পগুলোর উপস্থাপন ও মিশ্রণে কবি বাহান্ন বার à ও একশো আট বার de ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া অন্যান্য পদান্বয়ী বা সম্বন্ধবাচক অব্যয় (preposition) ছড়িয়ে আছে কবিতাটির শরীরে। সংযোজক অব্যয় (subordinating এবং coordinating conjunctions) ও প্রধান অনুবাক্যের (main clause) প্রয়োগ ছাড়াই শুধুমাত্র পুনরাবৃত্তির (repetition) সাহায্যেই রতিরসের চিত্রকল্পগুলোর সুবিন্যাস ঘটিয়েছেন। আমার উদ্ধৃতি জাঁ পিয়ের কভিন এর অনুবাদ থেকে:

[Woman of mine with woodfire hair

With thoughts like flashes of heat lighting with hourglass waist

Woman of mine with an otterlike waist between the tiger's teeth

Woman of mine with a rosette mouth like a posy of stars of ultimate magnitude

With teeth like a white mouse's spoor on white earth

With a tongue of rubbed amber and glass

Woman of mine with a tongue like a stabbed communion host

With the tongue of a doll that opens and shut its eyes

A tongue of incredible stone.

পরাবাস্তববাদী কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন পল এল্যুয়ার। উনিশশো বাহান্ন সালে এল্যুয়ার এর মৃত্যু উপলক্ষে লেখা একটি শ্রদ্ধাঞ্জলিতে কবি অরুণ মিত্র এল্যুয়ারকে "ধ্যানমগ্ন” কবি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। অরুণ মিত্র লিখেছেন, "(পল এল্যুয়ার) নিজের মধ্যে নিজে ডুবে আছেন। সমস্ত পৃথিবী, বস্তুপুঞ্জ হৃদয়ের গভীরে জারিত হয়ে এক বিশুদ্ধ রূপান্তরে জন্ম নিচ্ছে। সেই জন্য স্যুররেয়ালিস্ট মগ্নচৈতন্যের স্রোতে তিনি যত স্বাভাবিক ভাবে গা ভাসাতে পেরেছিলেন অন্য অনেকে তা পারেননি।" পরাবাস্তবের চৈতন্যের বিচ্ছুরণ রয়েছে এল্যুয়ার এর অসংখ্য কবিতায়। অরুণ মিত্র অনুদিত Mes heures কবিতাটির কয়েকটি পংক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে এই নিবন্ধটি শেষ করছি।


আমি ছিলাম মানুষ আমি ছিলাম পাথর

আমি ছিলাম মানুষের ভিতরের পাথর পাথরের ভিতরে মানুষ

আমি ছিলাম আকাশে পাখি পাখিতে শূন্য

আমি ছিলাম শীতে ফুল সূর্যে নদী

শিশিরের ভিতরে চুনি

ভ্রাতৃত্বে একক ভ্রাতৃত্বে মুক্ত।




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোমা দত্ত

মঞ্জরী গোস্বামী