সুস্মিতা সাহা
বাইশে শ্রাবণ ও খিস্তি এবং সৃজিত -
খিস্তি - শব্দটি শুনলেই আমার গা শিরশির করে - আশৈশবের লালিত পালিত তুলতুলে নীতিবাগীশ মনটি একেবারে খচমচ করে ওঠে।
উফ্ফ কেউ শুনে ফেললো না তো খিস্তি শব্দটি উচ্চারণ করে ফেলেছি মনে মনেই। সেই মহিলা সিনেমা হলে বসে টানটান হয়ে দেখেছিল বাইশে শ্রাবণ - মুভিটি। তারপর?
মুভিটি'র আদ্যন্ত একরাশ গালাগাল - সোজা চলতি বাংলায় -খিস্তি- মানে যে বিষয়টি আমার এলাকার বাইরে সুদূরে। পরিশীলিত ভাষায় ছাড়া আমার পড়তে, লিখতে, শুনতে কিছুই ঠিকঠাক লাগে না কিনা আর সুরা সেবনের কান্ড কারখানা দেখলে তো আরোই খারাপ লাগে।
তবে? এতো কথা বলছি কেন?
এক, পরমব্রত আছে সিনেমায়, আমার বড্ড প্রিয় একজন। সে কেউ তাকে ন্যাকা বলুন বা পাকা, আমার খুব ভালো লাগে।
দুই, যাই হোক্ সৃজিত স্যার মাঝে মাঝে দুটি/ একটি সিনেমা ভালোই বানান।
বাকি সব কথার মধ্যে সার কথা হোলো যে এ সিনেমা সিরিয়াল কিলার নিয়ে রহস্যের অনুসন্ধান করতে চায়। তার জন্য দরকার এক ডাকসাইটে পুলিশ অফিসার যিনি ইতিমধ্যেই সাসপেন্ড হয়ে বসে আছেন আর দর্শনের বুলি আওড়ানো ছাড়া বোতলের পানীয় গলায় ঢালছেন আর ঐ যে যা দিয়ে শুরু করলাম, হ্যাঁ তেড়ে গালি।
আবীর ও রাইমার যুগলে ভারি চমৎকার একটি সাব প্লট আছে বৈকি, আরো নানান রকম গোলমালের পরে মানে খুনখারাপির পরে অবশেষে সেই উপসংহার।
অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে - ক্যামেরায় উপর থেকে শট নেওয়া হয়েছে - ভিজে যাচ্ছেন এক মুখ চুল দাড়ির সিনিক সেন্টিমেন্টাল সিরিয়াস সিরিয়াল কিলার এবং এক কালের রাগি পুলিশ অফিসার - রক্তের লাল ধারায় ধুয়ে যাচ্ছে তার জমে থাকা কষ্ট - দুঃখ - যাবতীয় অপমান ও অবুঝ অভিমান।
আবহে সেই মানুষটির লেখা কবিতার পংক্তি ...
আর হ্যাঁ, ছবির নাম 'বাইশে শ্রাবণ'।
গত দুদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে যে।
আর এই বৃষ্টির সজল ধারায় কবি যাচ্ছন শেষের পথে আর লিখছেন - ''শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে?''
তিনি রবীন্দ্রনাথ।
শ্রাবণের ধারার মতো ঝরে পড়ুক তাঁর আশীষ আমাদের মাথায় চিরকাল।
'ও জানেমন জীবনানন্দ'
মল্লিকা সেনগুপ্ত বরাবরই সাহসী কবি,আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ।
তবে তাঁর জীবনানন্দকে নিয়ে করা 'ও জানেমন জীবনানন্দ' সম্বোধন দেখে একেবারে হতবাক হয়ে গেছিলাম প্রথম বারে, তারপর অবিশ্যি বেশ মজাই লেগেছে।
আমার ব্যক্তিগত জীবনে জীবনানন্দ অবশ্য তেমন একটা মজার বিষয় ছিলেন না কখনোই। উফ্ফ, তাঁর মাল্যবান তো একদম মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল একসময়ে। তখন এমনতরো নতুন ধরণের উপন্যাসের ভাষার সঙ্গে পরিচিতি গড়ে ওঠে নি বিশেষ, সদ্য মাস্টার্স শেষ করে গবেষণার বিষয় ভেবেছিলাম তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে।
তারপর ধীরে ধীরে সব শেষ হোলো - এখন 'আট বছর আগের একদিন' কবিতা নিয়ে অন্যরকম ভাবনা চিন্তা কাজ করে মাথায়।
জানি না আজো কতটা বুঝতে পেরেছি তাঁর নিরুপম যাত্রার অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে - তবু তিনি আছেন আমার সঙ্গে - এক জটিল আকর্ষণের সূত্র ধরে।
তিনি থাকবেন আরো অনেক দিন,
আজ তাঁর জন্মদিন, মৃত্যুর আগে তাঁর চাওয়া পাওয়া হয়তো একদিন মিলে যাবে আত্মমগ্ন পাঠকের জীবনের পাল ছেঁড়া এলোমেলো চলনের সঙ্গে।
'এবার সাতকাহন'
সাইকেলে প্যাডল করতে করতে মাঠ পেরিয়ে চলে যাচ্ছেন একজন মানুষ - তিনি চা বাগানের কর্মী - তিনি অমরনাথ, আমার খুব প্রিয় চরিত্র দীপার বাবা। যৌবনে পা দিয়েছি তখন, দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতো 'সাতকাহন' উপন্যাসটি। বিয়ে করবো না,চাকরি করে বাবা মাকে দেখবো, এই ভাবনার সঙ্গে কীভাবে যেন ধীরে ধীরে মিশে যেতে থাকলো দীপাবলির চরিত্রটি এবং অমরনাথ ও সত্যসাধন মাস্টারমশাই।
অমরনাথ খুব বেশি পড়াশোনা শেখেন নি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার হবার মতোন ডিগ্রি তাঁর নেই। তবে নিজের মেয়েকে আকাশ চেনাতে যেটুকু মন ও বিদ্যা লাগে তা তাঁর যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।
দীপাকে জীবনে অনেক ঝড়ঝাপ্টা সহ্য করতে হয়েছে , প্রায় সবসময়ই হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন পিতা অমরনাথ। যদিও তিনি জন্মদাতা পিতা নন, দীপা তো তার মৃতা শ্যালিকার কন্যা। সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ কিশোরী হয়ে উঠেছে, বাল্যবন্ধু হিসেবে যে ছেলেদের সঙ্গে সে খেলা করেছে শরীরে বয়ঃসন্ধির পরিবর্তন দেখা দিলে মা ও ঠাকুমা খেলতে যেতে বারন করে ঠিকই কিন্তু অমরনাথ আধুনিক মানুষের মতোই ছেলে ও মেয়েতে পার্থক্য করেন না।
এই অমরনাথ শুধু ঘাড় থেকে নামানোর জন্য দীপাকে গৌরীদান করেন!
চা বাগানে অবদি সকলে বাধা দেয় এতো ছোট বয়সে পড়াশোনা শেষ না হতেই বিয়ে দিতে, অথচ আর পাঁচ জন গড়পড়তা কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার মতোই অসুস্থ একটি ছেলের সঙ্গে বিবাহ দেন!
আবার এই অমরনাথ বিধবা দীপাকে রঙিন শাড়িতে দেখতে চান, মাছ মাংস খেতে দিতে চান।হয়তো পারেন না সমাজের চাপে কিন্তু বুকের ভেতর তার ক্রমাগত রক্ত ক্ষরণ হতে থাকে।
অপরাধ কি অমরনাথের একটাই? তা তো নয়, দীপার এক রাতের শ্বশুর বাড়ির সম্পত্তির ভাগ নেওয়ার জন্য যে অমরনাথ এগিয়ে যান তিনিই দীপার মনের সব আঁধার দূর করে আলো জ্বেলে দেন ,তিনিই বলেন '' তোর একফোঁটা চোখের জল একশ ফোঁটা রক্তের চেয়ে দামী।''
একেবারে দোষ গুণে জড়ানো এক পিতা আমাদের চোখের সামনে কখনো অসহায়, কখনো দৃঢ়, কখনো আবেগপ্রবণ হয়ে দীপার জীবনের ঠিক ভুলের সাক্ষী হয়ে ওঠেন।
দীপা যে শেষ পর্যন্ত দেশের একজন দায়িত্বশীল সরকারি অফিসার হতে পারে তার পেছনে অমরনাথের অনুপ্রেরণা অনেকখানি। অভিমান ও তীব্র হাহাকারে যাঁর বুকে মাথা রেখে দীপা সেই চেনা ঘামের গন্ধ টুকু পায় তিনি অমরনাথ।
আর এখানেই তো সমরেশ মজুমদারের কৃতিত্ব। অমরনাথ মেয়ের শ্বশুর বাড়ির কত্রী সম পরিচারিকার শারীরিক আবেদনের আকর্ষণ এড়াতে পারেন ঠিকই তবে তার খচখচানিটা লেখকের ধারালো চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। বাবা মানেই কি আর দেবতা?
না,তিনি চরিত্রহীন পুরুষমানুষ নন কখনোই, তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী রক্ষণশীল তো বটেই। আশ্চর্য লাগে, আবার ভাবি আশ্চর্য কিসের জন্য?
এমনটাই তো বাংলার ঘরে ঘরে। সহায়হরি থেকে শুরু করে নিরুপমার বাবা - সকলেই যে নিরুপায়।
তবে তাঁরা শুধু বিয়ে দিয়ে পার করতে পারেন, পারেন না বিধবা মেয়েকে আবার মাধ্যমিক পাশ করাতে।অমরনাথ সেই কাজটি করতে পেরেছেন। আরো আরো বড় হতে হতে দীপার মাথা যখন চা বাগানের আকাশ ছুঁতে চাইছে তখনো পাশে আছেন তিনি। অসুস্থ, বিবেক দংশনে ভোগা এক জীর্ণ মানুষের মুখ থেকে সেই জোরালো কথাগুলি বেরিয়ে আসে সততার জোরে '' তেমন ছেলে পেলে তুমি আবার সংসারী হবে''। বিধবা মেয়েকে পুনর্বিবাহ করতে বলে প্রমাণ করে দেন যে ভাবনা চিন্তায় তিনি কতটা প্রগতিশীল ছিলেন।
এইটুকুই তো অনেক পাওয়া দীপাবলির জন্য।
কার্তিকী অমাবস্যার রাতে একটি মাটির প্রদীপ জ্বালাতে আর কি লাগে দীপার? এক জোড়া হাতের স্নেহের স্পর্শ পেতে এই তো অনেক।
'সাতকাহনে'র অনেকগুলি পাতা জুড়ে যিনি স্বমহিমায় এবং বৈপরীত্য নিয়ে বিরাজ করেন তিনিই অমরনাথ। আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ, একজন পিতা। এগিয়ে চলে দীপাবলি - আলো জ্বলছে আলো জ্বলুক।
অমরনাথ আছেন তো আকাশের এক জ্বলজ্বলে তারা হয়ে। শুধু লেখাটা শেষ করার মূহুর্তে বুকের মধ্যে কুনকুন করে বাজে একটা যন্ত্রণা, দীপার বাড়ির বারান্দায় বসে খোলা মাঠ আর দেখা হোলো না তাঁর।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন