সুদীপ্ত সরকার
মনকেমনের দেশে
বাঁশের দরমা ঘেরা একটা ছোট্ট চালাঘর, চারপাশ তার সবুজ পাহাড়ে ঘেরা, সামনে এক বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা আঁচল পেতে থাকে, পাহাড়ের পিছন থেকে লাল রঙের সূর্য ওঠে, কুটিরের ঠিক পেছনে নাছোড়বান্দা এক ঝরনা। ঝরনা ভেঙে কুটিরের পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে একটা পাহাড়ি নদী, বর্ষা এলে তার শরীরে রূপ-লাবণ্যে যৌবনের উচ্ছাস। নদীর উপর বাঁশের সাঁকো আর সাঁকো পেরোলে অতিঘন জঙ্গল। কী, ঠিক এমনই একটা ছবি ছোটবেলায় আমরা প্রায় সবাই এঁকেছিলাম, তাই না? জানি না তখন কী ভেবে আঁকতাম...... পাতা জুড়ে লাল-সবুজ-সাদা-নীল, কেবল রঙের খেলা খেলতাম!
ঘুরে এলাম সেই ছবির দেশ, রঙের দেশ থেকে.......যার নাম টোডে-টাংটা বা চুমং।
টোডে এবং টাংটা হল পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং জেলার কালিম্পং সদর মহকুমার গোরুবাথান সিডি ব্লকের দুটি ছোট্ট গ্রাম। টোডে-টাংটা হল একটি খাসমহল যেখানে আশেপাশের অনেক গ্রাম টোডে বাজার নামে পরিচিত প্রধান বাজারের উপর নির্ভর করে। টাংটা গ্রাম, টোডে বাজার থেকে প্রায় ৩.৮ কিলোমিটার দূরে যা ভুটানের খুব কাছে অবস্থিত। টাংটা নদী, স্থানীয়ভাবে সীমানা নদী নামে পরিচিত, দুটি দেশের মধ্যে একমাত্র সীমান্ত হিসাবে কাজ করে গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। টাংটা নদী শুধুমাত্র একটি সীমানা তৈরি করে না, এটি একটি প্রধান নদী যা তার পথে আরও অনেক নদী, স্রোত এবং উপনদী দ্বারা মিলিত হয় এবং পরে জলঢাকা নদীতে পরিণত হয়, যা আমাদের দেশের বিভিন্ন অংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
যদিও পাহাড়ি অঞ্চলগুলিকে স্বাদু জলের উৎস বলে ধরে নেওয়া হয়, এই অঞ্চলগুলির অনেক অংশের উৎসগুলি বছরের পর বছর ধরে শুকিয়ে গেছে, তবে এখনও, টোডে-টাংটা'র অনেকগুলি সক্রিয় উৎস রয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে ১৩৬৫ মিটার উচ্চতাসহ টোডে-টাংটা'র নিজস্ব একটি পরিবর্তনশীল এবং অনন্য আবহাওয়া রয়েছে। বর্ষাকাল, মে মাস থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত জায়গাটিতে লেগে থাকার কারণে কেউ কেউ একে কঠোর বলে মনে করতে পারেন। বর্ষাকালে, বেশিরভাগ সময় জায়গাটি প্রাকৃতিক কম্বল অর্থাৎ ঘন কুয়াশায় আবৃত থাকে। দিনগুলি বেশিরভাগই বৃষ্টিপাত দ্বারা ভেসে যায়, যা কখনও কখনও কয়েকদিন ধরে চলতে পারে এবং অবশেষে সর্বত্র ভূমিধসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দিগন্তের সুন্দর সূর্যালোকে ভোরবেলাকে স্বাগত জানানো যেতে পারে, কিন্তু দিনেরবেলা এবং সন্ধ্যা কখনোই নির্ধারণ করা যায় না এ পরবর্তীতে ঠিক কী ঘটতে পারে। জনসংখ্যার অধিকাংশই এলাচ চাষের উপর নির্ভরশীল, যা বিশেষত বর্ষাকালে করা হয়। কালো এলাচ উৎপাদনের জন্য এলাকাটি বিখ্যাত। এলাচের উৎপাদন বংশপরম্পরায় চলে আসছে। এই জায়গায় শরৎকাল বেনামে স্বল্পস্থায়ী হয় কারণ নভেম্বরের শেষের দিকে শীত ট্রল করে। নভেম্বর এবং ডিসেম্বর মাসে, যখন শীতকাল তার শীতল পরিবেশ বাছাই করে, বেশিরভাগ গ্রামে এলাচ তোলা হয়। পরিস্কার আকাশ, দৃশ্যমান রোদ এবং অবিরাম পাহাড়ের দর্শনীয় দৃশ্যসহ শীতকাল মার্চের শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ হয়। কাছাকাছি পার্বত্য অঞ্চল বেশিরভাগ সময় তুষারে ঢাকা থাকে এবং কিছু গ্রামে কঠোর শীতকালে তুষারপাত হয়। বছরের এই সময়টি (নভেম্বর - মার্চ) এমন জায়গায় থাকার জন্য সেরা। যেখানে দিন শুরু হয় নাম না জানা হরেক পাখির নানান সুরের ডাকে, দিন শেষে বন্য ঝরনা ঝরঝর স্বরে সেতারের ঝঙ্কার তোলে। যেখানে রৌদ্র এলে নদীর জলে শতসহস্র হীরক কুচি খিলখিলিয়ে ওঠে, বর্ষা এলে সবুজ বনরাজি মাতাল হয়ে নাচে। যেখানে রাতের বেলা চাঁদের মায়া আর অমাবস্যা তারায় ঘেরা। সেখানে নেই কোনও শহুরে ক্লান্তি, নেই শহুরে মনকেমন। আছে কেবল গাছগাছালি আর পাখপাখালির হাসি, গান আর সুরের মেলা। এমন সময় গেছে, কান পেতে কেবল সবুজ নির্জনে বসে থেকেছি নিঃশব্দ অমাবস্যার রাতে স্তব্ধতার গান শুনব বলে। রাতের আকাশে দূরের নক্ষত্ররা ছাড়া বাকিদের সবার যেন ছুটি। পাশাপাশি আর ঘেঁষাঘেঁষি করে গায়ে আলসেমি মেখে অন্ধকার ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে শাল, সেগুন, পাইন, আরও নানান জংলী গাছের সারি। নিশ্ছিদ্র সবুজে ঘেরা এই বনানী, মনে হয় পরম নিশ্চিন্ত সুখে পাহাড়ের কোলে নিদ্রা গেছে আজকের পালা সাঙ্গ করে।
যদি কখনো হারিয়ে যাই, পাহাড়ে খুঁজো আমায়...
দূর পাহাড়ের গাছেদের সারি শনশন শব্দে হিমেল বাতাসের আগমনী গান শোনায়। রাতচরা, ঘুঘু, পেঁচা বা কোনো দলছুট এই অখণ্ড নীরবতা ভেঙে মনে করিয়ে দেয় জীবন বহমান, কোথাও কিছু থেমে নেই। দূর দিগন্তের পাহাড় ছুঁয়ে ভেসে আসা হিমেল হাওয়ার দাপট বাড়তে থাকে, পাতার মর্মর সুরের রিংটোন অবিরাম বাজতে থাকে কর্ণকুহরে। ক্রমশ রাত দীর্ঘায়িত হয় নতুন ভোরকে বরণ করে নেবে বলে।
যদি থাকতো একখানি ঘর এমন... রয়েছে আঁচল পেতে...
আপনারাও ঘুরে আসতে পারেন কালিম্পং জেলায়, এক্কেবারে ভুটান বর্ডারে অবস্থিত এই টোডে-টাংটায়।
কীভাবে যাবেন?
ন্যাচারাল স্পা অরণ্য, নদী, পাহাড় আর একটা আকাশ সাথে...
শিয়ালদহ থেকে রাতের কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস ধরে ভোরবেলা নিউ মাল জংশনে নামুন, বা নর্থবেঙ্গলগামী যেকোনো ট্রেন ধরে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামুন। তারপর আর কি! আগে থেকে যোগাযোগ করা থাকলে হোমস্টে-এর গাড়ি আপনার জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করবে।
ওতোপ্রোতো বেঁধেছে আমার দুই পাড়...
থাকবেন কোথায়?
চুমং রিভার নেস্ট। যোগাযোগ : +91 90625 17518, +9759062517518
প্রাঞ্জল লেখনী
উত্তরমুছুন